তিনটি পর্ব ধরে আলোচনা হবে। প্রথম পর্বে রোগ ও চিকিৎসা, দ্বিতীয় পর্বে রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ ও তৃতীয় পর্বে কীটনাশক ও লার্ভাভোজী মাছের ব্যবহার।
১। ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ কি?
উঃ সাধারণভাবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন (৮০%) অথবা সাধারণ জ্বরের মত সামান্য উপসর্গ। বাকিদের রোগ হয় আরো জটিল(৫%), এবং স্বল্প অনুপাতে এটি প্রাণঘাতী হয়। ইনকিউবিশন পিরিয়ড (উপসর্গসমূহের সূত্রপাত থেকে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়) স্থায়ী হয় ৩-১৪ দিন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয় ৪-৭ দিন।
ডেঙ্গু সাধারণত তিন ধরনের হতে পারে: (ক) ক্লাসিক্যাল জ্বর; (খ) হেমোরেজিক জ্বর -এ ক্ষেত্রে রোগীর ত্বকের নিচে রক্ত জমাট বাঁধে এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন পাকস্থলী ও অন্ত্রে রক্তক্ষরণ ঘটে; এবং (গ) ডেঙ্গু শক সিনড্রোম – এটি ডেঙ্গুর মারাত্মক অবস্থা। এ অবস্থায় রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে৷
- ক্লাসিক্যাল জ্বর: তীব্র জ্বরের সঙ্গে কাঁপুনি, জ্বর ১০৩ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট উঠতে পারে৷ মাথাব্যথা(সাধারণতঃ দু’চোখের মাঝে); মাংসপেশি এবং গিঁটে প্রচণ্ড ব্যথা; গলা ব্যথা; খাওয়ায় অরুচি; বমিবমি ভাব বা বমি হওয়া; জ্বর শুরু হওয়ার তিন চার দিন পর ত্বকে র্যাশ। লাল লাল ফুসকুড়ি বের হয়।
- হেমোরেজিক জ্বর: উপরিউক্ত মৃদু ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের সাথে আরো কিছু সমস্যা হয় ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের ক্ষেত্রে – খাওয়ায় অরুচি, তীব্র পেটে ব্যথা হয়; রক্ত বমি; ত্বকে র্যাশ (লাললাল ফুসকুড়ি) বের হয়; নাক দিয়ে রক্ত পড়া; মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া; পায়খানার সঙ্গে রক্ত পড়া; প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত পড়া; লসিকা গ্রন্থি ফুলে যায়; চোখ লাল হয়ে যায়।
- ডেঙ্গু শক সিনড্রোম: ঘন ঘন বমি হওয়া; নাড়ীর গতি বেড়ে যায়; রোগীর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়; জ্ঞান হারানো; রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া; এতে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু থেকে যা জটিলতা হতে পারে: নিউমোনিয়া; অস্থিমজ্জার স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হওয়া; চোখের প্রদাহ; অণ্ডকোষের প্রদাহ; ডিম্বাশয়ের প্রদাহ; শক; রক্তপাত; রক্তশূন্যতা।
২। ডেঙ্গু হয়েছে যে নিশ্চিত বোঝা যাবে কি করে?
উঃ নিশ্চিত ডেঙ্গুরোগী হিসেবে গণনা করার জন্য ল্যাবরেটরী পরীক্ষা দরকার।
- সম্ভাব্য ডেঙ্গুরোগী: ২-৭ দিনের জ্বরের সাথে সাথে নীচের যে কোন দু’টি বা ততোধিক লক্ষণ: (১) মাথাব্যথা(সাধারণতঃ দু’চোখের মাঝে); (২) মাংসপেশিতে ব্যথা; (৩) গিঁটে ব্যথা; (৪) ত্বকে র্যাশ (লাললাল ফুসকুড়ি); (৫) রক্তক্ষরণের লক্ষণ।
- নিশ্চিত ডেঙ্গুরোগী: নিশ্চিত ডেঙ্গুরোগীর নীচের যে কোন ল্যাবরেটরী পরীক্ষা: (১) রক্তরস বা শ্বেতকণিকায় ভাইরাস সনাক্তকরণ; (২) ভাইরাস বিচ্ছিন্নকরণ এবং নিউক্লিক অ্যাসিড সনাক্তকরণ; (৩) এলিজা পদ্ধতিতে এনএস-১ অ্যান্টিজেন বা আইজিএম অ্যান্টিবডি সেরোলজি। প্রথম দুটি পদ্ধতি অতি খরচসাপেক্ষ। পরের দুটি পদ্ধতি বিনামূল্যে জেলা হাসপাতালে উপলভ্য।
টুর্নিকেট টেস্ট: টুর্নিকেট টেস্ট সেইসব জায়গায় বিশেষভাবে উপযোগী যেখানে ল্যাবোরেটরি পরীক্ষা চট করে উপলভ্য নয়। এতে আছে পাঁচ মিনিট ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র-এর প্রয়োগ, এরপর যে কোন লাল ফুস্কুড়ি petechial থেকে হেমারেজের সংখ্যাগণনা।
এন এস ওয়ান পজিটিভ মানেই ডেঙ্গু কিনা এ নিয়ে সকলের মনে একটু দ্বিধা দ্বন্দ থাকে। তাই খোলসা করে বলা ভালো যে র্যাপিড পদ্ধতিতে (ছোটখাটো ল্যাব এ ক্যাসেট ব্যবহার) এন এস ওয়ান পজিটিভ মানেই ডেঙ্গু নয়। অন্য ভাইরাল জ্বর এও এন এস ওয়ান (নন স্ট্রাকচার প্রোটিন one) পজিটিভ হতে পারে। আবার র্যাপিড পদ্ধতিতে এন এস ওয়ান নেগেটিভ মানেই ডেঙ্গু হয়নি টা বলা যায় না। তাই জ্বরের এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে নিশ্চিতরূপে ডেঙ্গু ধরার জন্য এলাইজা পদ্ধতিতে (একটু ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতিযুক্ত ল্যাব লাগে) এন এস ওয়ান হল আদর্শ।
৩। ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা কি?
উঃ বেশির ভাগ রুগীই কোন স্থায়ী সমস্যা ছাড়াই ডেঙ্গু থেকে আরোগ্যলাভ করে। মৃত্যুহার চিকিৎসা ছাড়া ১-৫%, এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসায় ১%-এরও কম। ডেঙ্গু জ্বরের কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। বাড়িতে নিয়মিত দেখাশোনার সঙ্গে রোগীকে বিশ্রামে থাকতে হবে৷ প্রচুর তরল খাবার খেতে দিতে হবে যেমন
- ডাবের জল, লিকার চা, ফলের রস, ডালের জল, ঘোল
- কোল্ড ড্রিংকস জাতীয় পানীয় পরিহার করতে হবে
- দিনে এমনিতে যতটা জল পান করা হয় তার চেয়ে অন্ততঃ এক লিটার বেশি পানীয়
- ডেঙ্গু রোগীর যদি ছয় ঘণ্টার বেশি প্রস্রাব না হয়ে থাকে তাহলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে
ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিনে ভালো হয়ে যায়। ডেঙ্গুজ্বর আক্রান্ত রোগীকে মশারীর মধ্যে রাখতে হবে। “বিপদসূচক চিহ্ন”-এর উপর, বিশেষ করে যাদের স্বাস্থ্যের সমস্যা আগে থেকেই আছে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে৷
জ্বর কমানোর জন্য ঈষদুষ্ণ জলে গা মোছানো, মাথা ধুয়ে দেয়া ইত্যাদির সাথে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য জ্বর কমানোর ওষুধ বা বেদনানাশক ওষুধ ব্যবহার করা চলবে না।
৪। ডেঙ্গু রুগীকে কখন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে?
উঃ (ক) ক্লিনিক্যালি এইসব লক্ষণ দেখতে পেলে –
- একনাগাড়ে বেশি জ্বর (৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি)
- বিপদ সংকেতগুলির মধ্যে যেকোনো একটি যার মধ্যে রয়েছে শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে যাওয়া;
- খুব দুর্বল, বসতে বা দাঁড়াতে পারছে না;
- রোগীর শরীরে জল শূন্যতার লক্ষণ, মুখ দিয়ে জল পান বা তরল পান করার অক্ষমতা,
- বারবার বমি, পেটে খুব ব্যথা;
- প্রস্রাব বন্ধ বা খুব অল্প এবং গাঢ় রঙের
- মাথা ঘোরা, বেহুঁশ ভাব, দাঁড়িয়ে উঠলে রক্তচাপ কমে যাওয়া;
- জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পরে প্রচুর ঘাম, মূর্ছা যাওয়া;
- হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা, শ্বাস কষ্ট শুরু হওয়া;
- প্লেটলেট বা অনুচক্রিকার সংখ্যা যাই থাকুক না কেন, স্বতস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ শুরু হওয়া;
- লিভার বা যকৃৎ এর আকার বৃদ্ধি, ও বেদনা, বুকে ব্যাথা, হাতে পায়ের আঙ্গুল নীল হয়ে যাওয়া;
(খ) বুক বা পেটের ছবি বা রক্ত পরীক্ষায় এইসব দেখতে পেলে
- হিমাটোক্রিট বেড়ে গেলে বা রক্তের ঘনত্ব বেড়ে গেলে
- বুকে বা পেটে জল জমলে;
- পিত্ত থলি মোটা হয়ে গেলে
(গ) ডেঙ্গুর সাথে এইসব শারীরিক অবস্থা থাকলে:
- শিশু বা বৃদ্ধ
- স্থূলতা
- গর্ভবতী
- অন্যান্য অসুখ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, পেপটিক আলসার, হিমলাইটিক এনিমিয়া
(ঘ) আর্থ সামাজিক অবস্থান এমনটা হলে:
- একা থাকেন, বাড়িতে সেইভাবে দেখাশোনা করার কেউ নেই
- হাসপাতাল থেকে অনেক দূরে বাড়ি;
- অসময়ে দরকার হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মত নির্ভরযোগ্য পরিবহন ব্যবস্থা নেই
৫। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রুগীর কোন পরীক্ষাগুলো নিয়মিত করা প্রয়োজন?
উঃ এইগুলি নিয়মিত চারবেলা করা প্রয়োজন
- নাড়ির গতি
- রক্তচাপ
- জ্বরের মাত্রা
- শ্বাস প্রশ্বাসের হার
- প্রস্রাবের পরিমাণ
এছাড়াও দিনে দুবার প্লেট লেট ও প্যকড সেল ভলিউম পরীক্ষা করতে পারলে খুব ভালো হয়।
৬। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রুগীকে কখন ছুটি দেওয়া যেতে পারে?
উঃ এসব শর্ত গুলি পূরণ হলে:
- রোগীর মধ্যে চোখে পড়ার মতো উন্নতি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যেমন খিদে ফিরে আসা, পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রস্রাব;
- গত ৪৮ ঘণ্টায় জ্বর কমানোর ওষুধ ছাড়াই জ্বর নেই;
- রক্তচাপ স্বাভাবিক;
- কোনো শ্বাস কষ্ট নেই;
- প্লেট লেট বা অনুচক্রিকার সংখ্যা একনাগাড়ে পঞ্চাশ হাজারের বেশি
৭। প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা দেওয়া কতটা জরুরি?
উঃ ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৯৯% ক্ষেত্রে প্লেটলেট কম হওয়ার জন্য বা রক্তক্ষরণ থেকে হয় না, DSS বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম থেকে হয়। এতে ব্লিডিং হয় না। রক্তধমনীর দেওয়াল থেকে জল বেরিয়ে যাওয়া মৃত্যুর মুখ্য কারণ। অর্থাৎ লাখে একজনের রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়। প্লেটলেট এর সংখ্যা হ্রাসই ডেঙ্গুতে রক্ত ক্ষরণ এর একমাত্র কারণ নয়। প্লেটলেট দিয়ে যে রক্তক্ষরণ আটকানো যায় না। প্লেটলেট ২০,০০০ এর নিচে নেমে গেলে ও রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখা অথবা রক্তক্ষরণের লক্ষণ ছাড়াই দশ হাজারের নিচে নেমে গেলে প্লেটলেট দেওয়া হয়। পেঁপের রস ইত্যাদি খেলে প্লেটলেট বেড়ে যায় একরম কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই এখনো।