ফিল্ড সার্ভিস
—————
প্রশিক্ষণ শেষের ছুটি শেষ হতে চলল। রেলের পাশ (Warrant) নিয়ে ছুটলাম হাওড়া ষ্টেশন এ MCO (Movement Control Organisation)-এর দপ্তরে। মিলিটারী কোটা থেকে ফার্স্ট ক্লাস রিজারভেশন নির্দিষ্ট দিনে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। তখন জম্মু পর্যন্ত্য রেল হয়নি। পাঠানকোট নেমে যেতে হত। টিকিট পেয়েও গেলাম। ছুটি শেষ হওয়ার দু’দিন আগে যাত্রা শুরু। পাঠানকোট নেমে রিপোর্ট ট্রানসিট ক্যাম্পে। সেখান থেকে অফিসার্স বাসে চেপে জম্মু যেতে হত।
ইউনিট Satwari তে রাস্তার উপরেই ছিল। ইউনিটে খবর দেওয়া ছিল। ওরা গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে গেল ওদের ‘অফিসার্স মেস’-এর গেষ্ট রুমে থাকার জন্য। কয়েক দিন পর জানতে পারলাম, অনেক দিন হল ইউনিটে কোনো ডাক্তার নেই।
ফিল্ড সার্ভিস মানে দেশের বর্ডার এরিয়ার পাশাপাশি জায়গা। যেখানে শত্রুদের অনুপ্রবেশ ও হামলা থেকে নিজেদের জায়গা রক্ষা করা যায়। জম্মুতে ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বর্ডার।
ইউনিটের একটা কোম্পানি বর্ডার এরিয়ায় ডিউটি করতে গিয়েছিল, LOC (Line of Control)-এর কাছে। এই সব জায়গায় কিছুটা No Man’s Land থাকে। সেখানটা বৃষ্টির জলে কর্দমাক্ত ছিল। একদিন রাত্রে সেখানে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল এবং তাদের হটিয়েও দেয়। কিন্তু ওখানে অনেকক্ষণ লড়াই-এ বেশ কয়েকজন জওয়ানকে স্ক্রাব টাইফাস রোগে আক্রান্ত হতে হয়। এসবই আমার যাবার আগের ঘটনা। এই দুর্ঘটনার জন্য এবং ইউনিটে অনেকদিন কোনও ডাক্তার না থাকায় ইউনিট RMO পোষ্টিং demand করে। সেই জন্য আমার এখানে পোষ্টিং হয়।
টাইফাস রোগের প্রতিরক্ষার জন্য জওয়ান দের Battle dress এ ১০১ বার DBP তেল লাগাতে হয়। বেশ কঠিন কাজ। একে বলা হত DBP drill. প্রত্যেক জওয়ানকে নিজের dress নিজেই লাগাতে হত।
আমাকেও একদিন ওই বর্ডার এরিয়ায় একদিন বর্ডার এরিয়ায় এক কোম্পানীর সঙ্গে নাইট পেট্রোল এ যেতে হয়। তবে আমাকে বর্ডার এরিয়া থেকে একটু দূরে গাড়িতে (medical van) এ থাকতে হয়েছিল।
ফিল্ড সার্ভিস মানে খাওয়া থাকা ফ্রী। বছর বছর ছুটি যাওয়ার জন্য ফ্রী রেলের পাশ। পরিস্থিতি অনুযায়ী দু-মাসের ছুটি। একসঙ্গে নাও পাওয়া যেতে পারে।
আমার দুর্ভাগ্য গ্রেনেডিয়ার্সের ফিল্ড tenure শেষ হয়ে গেছে। অল্প দিনের মধ্যে পাঞ্জাবের ফিরোজপুরে চলে গেল। আমি surplus হয়ে গেলাম। আমাকে লোকাল ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সে attached করে দিল। কারণ জানলাম ফিল্ড এরিয়াতে সাধারনতঃ তিন বছর কাজ করতে হয়। আমাকে গ্রেনেডিয়ার্সের সঙ্গে ট্রেনের কন্ডাকশন ডিউটিতেও যেতে দিল না।
জম্মু থেকে কাশ্মীর যেতে বানিহাল পাহাড়ের মধ্যে লম্বা টানেল পার হয়ে যেতে হয়। ওই টানেল এর আগে একটা ছোট মেডিক্যাল ইউনিট ছিল। নাম staging section। যাতায়াতের পথে কোনো দুর্ঘটনা বা অসুস্থতা সামাল দেওয়া ওই মেডিক্যাল ইউনিটের কাজ। সেখানে কোন মেডিক্যাল অফিসার ছিল না। শীতের সময় আমাকে সেখানে টেম্পোরারি ডিউটিতে পাঠাল।
সেখানে প্রচন্ড শীত। মাঝে মাঝে বরফ পড়ে। কাঠের বাসায় ঘর গরম করতে কেরোসিন তেলের ‘বুখারি’ জ্বলে সারা দিন ও রাত। সূর্যের দেখা প্রায়ই পাওয়া যায় না। আশেপাশে আর কোনো ইউনিট নেই। বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের একটা ছোট ইউনিট ছিল। একজন ইঞ্জিনিয়ার অফিসার ছিল। তাদের কাজ বরফ ঢাকা রাস্তা পরিস্কার করা, মিলিটারি গাড়ির কনভয়ের চলাচল নিশ্চিত করা এবং ওখানকার যাতায়াতের রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ করা।
আমার ইউনিটে প্রায় কুড়ি জন জওয়ান থাকত। রুটিন ছিল সকালে পি.টি.(রাস্তায় দলবেঁধে দৌড়োন)। বিকেলে ভলিবল খেলা। রাত্রে রেডিওর প্রোগ্রাম শোনা। মোবাইল বা টেলিভিশন ছিল না। ইউনিটে একটা টেলিফোন ছিল। কিন্তু ওখান থেকে দূরে কল প্রায়ই পাওয়া যেত না। তবে একটা আকর্ষণ ছিল। সপ্তাহের শেষে ভগবানের নামে দু’পেগ রাম ফ্রী মিলত জওয়ানদের, কিন্তু অফিসার দের নয়।
ওখানে ট্রানসিট মেস ছিল। শ্রীনগর থেকে অফিসার বাস আসত দুপুরে, আর পাঠানকোট থেকে বিকেলে। এখানে দুপুরে লাঞ্চ এবং বিকেলে চা, সঙ্গে স্ন্যাক্স খেত। আমার সারাদিনের খাবার ওই ট্রানসিট মেসে। রাত্রে ঘরে খাবার দিত আমার পাহাড়ি সিভিলিয়ান সেবাদার। সকাল-বিকেল চা ও জলখাবার ওই মেস থেকে এনে দিত সেই সেবাদার।
আমিও দুপুর ও বিকেলে transit mess এ খেতাম, অফিসারদের সঙ্গে দেখা করতে।কেউ যেত ছুটিতে বা ডিউটিতে, আবার কেউ ফিরত ছুটি থেকে বা পোষ্টিংয়ে। কখনও চেনা বা নতুন কোনো মেডিক্যাল অফিসারের দেখা পেতাম।
আমার কাজ খুবই সামান্য। সকালে ইউনিটে যাই রুগী দেখতে। মিলিটারি রুগী কমই থাকত। স্থানীয় সিভিলিয়ান রুগী আসত। তাদের দেখতাম ও ওষুধ দিতাম। নিয়ম ছিল। কিছু চিঠিপত্র এলে দেখতাম। কারও আকস্মিক ছুটির প্রয়োজন হলে দিতাম। সবচেয়ে খারাপ লাগত মাসে একবার সকল জওয়ানের venereal disease আছে কি না physically check করা।
বাকি সময় ছোটো ঘরের মধ্যে ‘শীততাপ নিয়ন্ত্রণ’ ও লেপের আরামের মধ্যে। খবরের কাগজ আসত না। বই পড়ে সময় কাটাতাম। হিসেব করে দেখলাম প্রায় ১৬ ঘন্টা ঘরবন্দী। পাহাড়ি সেবাদার চা নিয়ে এলে তার সাথে গল্প করতাম। কোথাও যাওয়ার ছিল না। বরফ পড়লে দরজা খুলে দেখতাম – কেমন পেঁজা তুলো ঝিরঝির করে পড়ছে রাস্তায়, বাসার কাঠের ছাদে। রাস্তার পাশে এক পাহাড়ি খরস্রোতা নদী বইছে। সেটা আমার ইউনিটের পাশ দিয়ে চলেছে। একদিন দেখি সাতসকালে আমার সেবাদার ঐ ঠান্ডা নদীর জলে স্নান করছে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তোমার কষ্ট হয় না?’ ও চামড়া দেখিয়ে বলেছিল, ‘এটাই আমার অভ্যাস। খুব ভালো লাগে।’
এমনি করে মাসখানেক যাওয়ার পর একঘেয়েমি লাগত। ক্লান্তি অনুভব করতাম। উধমপুরে মেডিক্যাল হেডকোয়ার্টারে সাহস করে টেলিফোন করলাম রিলিফের জন্য। কোনো কাজ হল না।
দু’মাস কেটে গেল। খবর এল আমার নতুন পোষ্টিং এসেছে। আর্টিলারি ইউনিটের ফিল্ড রেজিমেন্টে। কামান যাদের অস্ত্র। ইউনিট লোকেশন পাঠানকোটে। ফিল্ড লোকেশনের বাইরে। ভাল লাগল না।
Staging section থেকে ছাড়া পেয়ে ইউনিটে জয়েন করলাম। এসে খবর পেলাম, অল্প কিছুদিনের মধ্যে ইউনিট জম্মুতে এয়ারপোর্টের পাশে ফিল্ড এরিয়াতে চলে যাবে। মনটায় খুব খুশী হল।
ক্রমশ…