ডাক্তার গ্রামে যেতে চায় না। কথাটা খানিকটা সত্যি। কিন্তু কেন?
প্রশ্নটা উল্টোদিক থেকে শুরু করুন। কেন যেতে চাইবে?
চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রম এমন দাঁড়িয়েছে, যা এক্কেবারে আন্তর্জাতিক। গ্লোবালাইজড। আর গ্লোবালাইজেশনের বাকি সব দিকের মতো এক্ষেত্রেও গ্লোবালাইজেশন মানে – এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত জীবনদর্শন, যার সঙ্গে অনিবার্যভাবে মিশে যায় ঘরের জিনিসটির চাইতে বিলেত-আমেরিকার সঙ্গে অধিক পরিচিতি।
বিদেশে ভারতীয় চিকিৎসকের খুব কদর, একথা হামেশাই শুনি। মানিও। কিন্তু কেন? কদর এজন্যই, কেননা এ দেশ থেকে পাশ করা চিকিৎসকরা বিদেশের অসুখ-বিসুখ সামলাতে যথেষ্ট দক্ষ এবং উন্নত স্বাস্থ্যপরিকাঠামোয় কাজ করার পক্ষে খুবই উপযুক্ত। দেশেরও মধ্যবিত্ত উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির অসুখ-বিসুখ বিষয়েও তাঁরা দিব্যি অবহিত – উন্নত পরিকাঠামোর পাঁচতারা কর্পোরেট হাসপাতালেও তাঁরা দিব্যি মানানসই। কিন্তু গ্রামেগঞ্জের গরীবগুর্বোদের রোগবালাই সামলাতে তাঁরা সমস্যায় পড়েন, কেননা টেক্সটবই-ই বলুন বা কারিকুলাম, কোথাওই তৃতীয় বিশ্বের আমজনতার স্বাস্থ্যসমস্যার কথা গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় না।
ক্লিনিকাল ট্রেনিং-এর কথা যদি বলেন, পাস করার পরে ইন্টার্নশিপ বা হাউসস্টাফশিপ, সে সময় মন দিয়ে কাজ করা প্রায় সময়ের অপচয়ের সামিল। সংখ্যায় কম কিছু বাচ্চা ডাক্তারবাবু ওই বছরগুলো খেটেখুটে কাজ শেখেন, কিন্তু আখেরে তাঁরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়েই পড়েন। কেননা, পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ছাড়া জগৎ মিথ্যা। সাধারণ বাঙালি চিরকালই চিকিৎসা ব্যাপারটা বাকিদের চাইতে ভালো বোঝেন – গত বিশ বছরে সেই পাণ্ডিত্যের বহর এমবিবিএস কারিকুলামের জ্ঞান অতিক্রম করে গিয়েছে – আস্তে আস্তে তা এমডি লেভেলের নলেজ পার হতে চলেছে – তিনদিন কোষ্ঠ সাফ না হলে গ্যাস্ট্রো-র ডাক্তার খোঁজেন, সেও আবার নামকরা হতে হবে। এমতাবস্থায় এমবিবিএস-এর পরে দুতিনটে অক্ষর না জোড়া গেলে আগে ‘পাতি’ শব্দটি জুড়ে যাবে – যাবে-ই।
এমবিবিএস পড়ার সময় সাধারণ অসুখবিসুখের কথা যদি বা অল্পবিস্তর জেনেও থাকেন, এমডি-তে ঢোকার আগে সেসব না ভুললেই নয় – কেননা সেই কম্পিটিটিভ পরীক্ষা, ঘোষিত ভাবেই, টেস্ট অফ এলিমিনেশন। সবচেয়ে আনকমন অসুখের সবচেয়ে আনকমন উপসর্গ, নতুনতম ওষুধের বিরলতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অতি জটিল অসুখের ক্ষেত্রে জিনের অদলবদল – পরীক্ষায় প্রশ্ন বলতে এরকমই। প্রস্তুতিও তদনুসারী।
পাশাপাশি সর্দিজ্বরের ক্ষেত্রেও বিরলতম সম্ভাবনা মাথায় রেখে পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে এক্কেবারে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া – এসব শুধু টেক্সটবইয়েই নয়, নিত্যনতুন গাইডলাইনেও চলে এসেছে। সে অবশ্য আশ্চর্য কিছু নয়, কেননা বই ও গাইডলাইন সবই প্রথম বিশ্বের বাস্তবতা অনুসারী। পরীক্ষানিরীক্ষা না করালে, দশ হাজারে একজনেরও যদি জটিল অসুখটি অধরা থাকে, মামলা-মোকদ্দমার সম্ভাবনা প্রবল – গ্রামেগঞ্জে অবশ্য মামলাটামলার ব্যাপার কম, তাড়াতাড়ি হাতে হাতে ফয়সালা – হাত থাকতে মুখের কথা সময়ের অপচয় মাত্র। মামলা-মোকদ্দমা হলে, মহামান্য আদালতের ততোধিক মহামান্য বিচারক প্রশ্ন করবেন, অমুক পরীক্ষা হয়নি কেন, তমুক সুপার-স্পেশালিস্টের মতামত ছাড়াই চিকিৎসা হল কেন – যদিও জজসাহেবের পদের জন্যে এলএলবি-র বেশি কোনও ডিগ্রি জরুরি নয়।
অতএব, যথেষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষার পরিকাঠামো ছাড়া সাধারণ অসুখবিসুখের চিকিৎসা করার দুঃসাহস এ যুগের ডাক্তারবাবুরা দেখাবেন না। তাঁদের পাঠ্যক্রমে সাধারণ মানুষের সাধারণ অসুখবিসুখের চিকিৎসা করার উপযুক্ত প্রশিক্ষণও গুরুত্বের সাথে দেওয়া হয় না। উপসর্গ দেখে ক্লিনিকাল ডায়াগনসিস-এর উপরে জোর দেওয়াও অতীত – ইন ফ্যাক্ট, তেমন ভাবনা এই বাজারে বিপজ্জনক। প্লাস, পড়তে পড়তেই একজন মেডিকেল ছাত্রের মনে স্বাস্থ্য-চিকিৎসার যে ইমেজ তৈরি হয়, তা অনিবার্যভাবে প্রথম বিশ্বের ছবি – সে ছবির সাথে দেশের কর্পোরেট স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর তেমন সঙ্ঘাত নেই। এসবের মাঝে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গল্প আসছে কোত্থেকে!!!
তবুও কিছু কিছু ডাক্তার পাস করে সরকারি চাকরিতে আসতে চান। অন্তত অনেকেই চাইতেন। মূলত চাকরির নিরাপত্তার কারণে, অনেকে হয়ত আমজনতার প্রতি দায়িত্ববোধের কারণেও। কিন্তু পোস্টগ্র্যাজুয়েশনই মোক্ষ হয়ে যাওয়ার কারণে, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের মতোই, এমবিবিএস-ও একটি ইন্টেরিম স্টেট – গন্তব্য বা প্রান্তিক স্টেশন নয়, যাত্রাপথের মাঝের অনামা কোনও স্টেশন মাত্র। সেই স্টেশনের প্রতি যেটুকু ভালো লাগা থাকা সম্ভব, পরিকাঠামোহীন হেলথ সেন্টারে কর্মরত অধিকাংশ চিকিৎসকের ব্যাপারটা তেমনই দাঁড়ায়। ট্রেন বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে আপনি হয়ত নেমে স্টেশনে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন, এককাপ চা খান – তার বেশি নয় – কিন্তু অন্ধকার যে স্টেশন, একটিও চায়ের দোকান নেই, তার নামটুকুও মনে রাখেন কি?
তিনজন ডাক্তার থাকার কথা, আছেন একজন। সপ্তাহে প্রতিদিনই অন-ডিউটি। থাকার আস্তানা প্রায় ভেঙে পড়ার সামিল। জল অনিয়মিত। বর্ষার দিনে শুতে যাওয়ার আগে বিছানার তলায় টর্চ জ্বেলে দেখে নিতে হয় – সাপ ঢুকে নেই তো!!! আর মনের মধ্যে নিত্য যাওয়া-আসা – সহপাঠী যে বন্ধুটি পাস করেই কর্পোরেট হাসপাতালে চাকরি নিল, তার বাকি জীবন বা কাজের পরিবেশের কথা ছেড়েই দিন, মাইনের ফারাকটা…
এসবের মাঝে মাঝেই আছে স্থানীয় নেতার ধমক-চমক, কপাল খারাপ হলে চড়চাপড়ও – কলেজজীবনের দাপুটে হুল্লোড়বাজ ছেলেটিও আস্তে আস্তে মিইয়ে যায়… ছেলেটিই বলছি, কেননা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেয়েদের উপস্থিতি অনেকটাই বিরল…
এ তো গেল এমবিবিএস ডাক্তারের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কথা। পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করার পরে কম্পালসারি তিন বছরের বন্ড পোস্টিং-এ মফস্বলের হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রোমাঞ্চকর। অঙ্কোলজিতে এমডি করার পর নতুন ডাক্তারবাবুকে সামলাতে হয় প্রসবের ভার, সাইকিয়াট্রির ডাক্তারবাবুকে সামলাতে হয় জেনারেল ইমার্জেন্সি – তিন বছরের পড়াশোনায় যেটুকু শেখা, পরবর্তী তিন বছরের বন্ডে প্রাণপণ সেই শিক্ষা ভুলে যাওয়ার সাধনা…
অতএব, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি বিতৃষ্ণা নিয়েই শুরু হয় বড় অংশের নতুন ডাক্তারের ডাক্তারিজীবন। চাকরিজীবনের শুরু থেকেই, প্রায় বাধ্যতাবশত, শুরু করেন হাজারো আপোস – আর সেই আপোসের চোটে বদলে যেতে থাকেন ডাক্তার হিসেবে, মানুষ হিসেবে। পরিকাঠামোহীন একক চিকিৎসকের স্বাস্থ্যকেন্দ্র যে ঠিক কীভাবে চলতে থাকে, সে এক পরাবাস্তব কাহিনী। স্বাস্থ্য-প্রশাসনের মাথায় বসে থাকা মানুষজনের আশ্চর্য সিদ্ধান্ত, ধরা-করার মতো যোগাযোগ না থাকলে হয়রানি, ঘুঘুর বাসার সাথে মানিয়ে না চলতে পারলে দশচক্রে… নাঃ থাক, অত গল্পে আর যেতে চাইছি না।
আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই, এর পরেও অনেক অনেএক ডাক্তার সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাথে যুক্ত হতে চান। সরকারবাহাদুর অবশ্য গত এক বছরে কোনও নতুন ডাক্তার নিয়োগ করার চেষ্টাও করেননি, শুধু জানিয়েছেন ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন পাস করা ডেন্টিস্টরা একের পর এক দরখাস্ত করেছেন, সরকার উত্তর দেননি। কাজেই, খুবই স্পষ্ট, ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না।
এসবের কোনোটিই দুদিনের গল্প নয়। বছরের পর বছর, এমনকি দশকের পর দশক এরকমই চলেছে। কেউই নড়েচড়ে বসেননি। চিকিৎসার দর্শন, চিকিৎসার লক্ষ্য, সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদ্দেশ্য, মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষা চাহিদা – সবই বদলেছে একটু একটু করে।
একটু একটু করে পরিবর্তন, তাই ঝটকা লাগেনি – কাজেই, নজরে পড়েনি। এখনও নজরে পড়ছে না।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাতুড়ে দিয়ে গরীবের চিকিৎসা… আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠক্রমের টেনিং-এ আয়ুশ বিভাগে কিছুদিনের ট্রেনিং… সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার আলো ম্রিয়মাণ হতে হতে টিমটিমে বাতিতে পর্যবসিত হওয়া… উল্টোদিকে পাঁচতারা হাসপাতালের ফুলেফেঁপে ওঠা, স্বাস্থ্যবিমার বাতাস দিয়ে সেই বৃদ্ধিতে সহায়তা জোগানো…
সবই ঘটেছে ঘটছে একটু একটু করে…
নড়েচড়ে বসার প্রয়োজন কেউই বোধ করেননি, এখনও বোধ করছেন না…
শুধু মাঝেমধ্যে নিজে অনিবার্যতার শিকার হলে মনে পড়ে, বড্ডো একা হয়ে গেছি… প্রতিবাদটা আর একটু আগে শুরু হতে পারত…
প্রতিবাদ হবে কি করে? যাঁরা প্রতিবাদ করতে পারতেন তারা নিজেরা বিভ্রান্ত। কারণ তারা যে মডেলের উপর বিশ্বাস রেখে ছিলেন, সেটাই প্রশ্নের মুখে। যতদিন না সেই মডেলের একটা পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞাসম্মতভাবে পুনর্মূল্যায়ন হবে এবং সেই দর্শনের সামগ্রিকতা সঙ্গে আমাদের দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা পার্টিকুলারিটির দ্বন্দ্বের সমাধান হবে ততদিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি চলতেই থাকবে।
ভালো লেখা।