প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালিরই একটা ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি থাকে। পুজো বললেই কারো চোখে ভেসে ওঠে নতুন জামাকাপড় তো কারো কানে বেজে ওঠে মহালয়ার স্তোত্রপাঠ। বাবা-মার সঙ্গে বেড়াতে যাবার স্মৃতি নয়তো নতুন পূজাবার্ষিকীর গন্ধ। শেষ কৈশোরে প্রথম ধূমপান বা অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি দেবার সময় ভালোলাগা ষোড়শীর হাতে-হাত ঠেকে যাওয়া। বাঙালির পুজো অঘটন ঘটন পটীয়সী। বাঙালির পুজো মানেই জিয়া নস্টাল।
ছোটবেলা কিছুটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে যায় পেশায় ঢুকলে। কিছু কিছু পেশা সেইদিক থেকে দেখতে গেলে বড়ো নিষ্ঠুর। বিশেষ করে যেসব পেশার সঙ্গে জরুরি পরিষেবা যুক্ত। পুলিশ, ডাক্তার, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী অফিসের লোক, সাংবাদিক সবার জন্য সেই বিখ্যাত ট্যাগ লাইন – “তোমার ছুটি, আমার নয়”। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে আবার পুজো মাটি হওয়ার ব্যাপারটা কলেজে ঢোকার সাথেসাথেই ঘটে। একে তো বিশ্রীরকম পড়ার চাপ তার ওপর এমবিবিএস পরীক্ষাগুলোর অদ্ভুত নিয়ম আছে। পরীক্ষাগুলো সাধারণত পুজোর ঠিক পরে হয়। থিওরি আর ওরাল-প্র্যাকটিক্যালে আলাদাভাবে পঞ্চাশ শতাংশের ওপর পেলে তবে পাস। প্র্যাকটিক্যালে পাস করাটা আবার কিছুটা এগজামিনারের ওপর নির্ভর করে বলে রটনা আছে। ভদ্রলোকের যদি পুজোটা ভালো না কেটে থাকে তো সাড়ে-সর্বনাশ। পুরো ব্যাচ তখন ধ্বংসস্তূপ। দু’একটা কোনোমতে বেঁচে যাওয়া আহত সৈনিক পরের ক্লাসে যাবে। ডাক্তারিতে ফেলের হার ভীষণ বেশি।
আমাদের সময়ে সেকেন্ড এমবিবিএস পরীক্ষার থিওরি আর প্র্যাকটিক্যালের মাঝে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে দুর্গাপূজা পড়েছিল। সেবারের মতো ভয়ানক পুজো আর জীবনে কাটাইনি। দিনে আঠারো ঘন্টা উল্টানো ঘটির মতো বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে হতো। কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমীর ঢোকা বারণ। প্রতিটি কলেজেই ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার রাজুর মতো দু’একজন অতি আস্তিক ছাত্র থাকে। নবমীর রাত্রে এরকম এক ছাত্রের মনে হলো যে দুর্গা ঠাকুরের সঙ্গে দেখা না করলে তিনি রাগ করে ফেল করিয়ে দিতে পারেন! সুতরাং একবার ঠাকুর দেখতে যাওয়া উচিত। আমি চিরকালের ভাঙা কুলো। আমাকে তার সাথে যেতে হলো। প্রায় দৌড়ে বাগবাজার। মাথায় তখনও প্যাথো, ফার্মা, পিএসএম, এফএসএম ঘুরছে। বন্ধু কানের কাছে মুখ এনে বললো “মা দুর্গা যদি বর্শা দিয়ে না খুঁচিয়ে অসুরকে গুলি করে মারতেন তাহলে উন্ড অব এন্ট্রিটা কেমন হতো বলতো?”
বলা বাহুল্য, বন্ধুটি সেবার ফেল করেছিল।
ডাক্তারি পাস করার পর ইন্টার্নশিপে পুজোয় একটা এমারজেন্সি নাইট ডিউটি ছিল। তখন অপরিসীম উৎসাহ। আমাদের দুজন ইন্টার্নের সঙ্গে একজন মেডিক্যাল অফিসার। “স্যার, আপনি পাশের ঘরে শুয়ে থাকুন। প্রয়োজন হলে ডাকবো।” মেডিক্যাল অফিসারের অলিখিত ছুটি। স্যার পাশের ঘরে চলে যাবার পর আমাদের রাজত্ব। মাঝখানে মেডিসিনের হাউসস্টাফ দাদা চোখ পাকিয়ে বলে গেল যে একদম যেন মোদোমাতাল জঞ্জালগুলোকে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি না করি। তখন কি জানতাম যে উৎসবের রাতগুলোতে জঞ্জালদের উৎপাতই বেশি। কিছুক্ষণ পরেই এমারজেন্সি একেবারে শুঁড়িখানার অ্যান্টিচেম্বারে পরিণত হলো। নারীপুরুষ নির্বিশেষে ‘দুনিয়ার মাতাল এক হও’ কর্মসূচি নিয়েছে। তাদের শাসানি-দাপানিতে আমরা দুই বীরপুঙ্গব কোনঠাসা। দুই সদ্যডাক্তারের মেডিক্যাল বোর্ড বসে গেল। আমার মতে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে সবাইকে ঠান্ডা করে দিই। বন্ধুর মত ল্যাসিক্স ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ‘ছোট বাইরে’ করিয়ে অ্যালকোহল শরীর থেকে বার করে দেওয়া। শেষ পর্যন্ত দুটো ইঞ্জেকশনই দেওয়া ঠিক হলো। সে এক ভয়ানক কেলেংকারী। হিসুর উপদ্রবে ঘুমের দফারফা। যাদের ক্ষেত্রে ঘুম জয়ী হচ্ছিল তাদের অবস্থা আর কহতব্য নয়। পরদিন সকালবেলার এমারজেন্সি ওয়ার্ড যেন বহুকাল সুইপার না আসা পাবলিক টয়লেট।
যাঁরা সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালের ঘেরাটোপে বাকি জীবন কাটান তাঁদের ক্ষেত্রে পুজোর ডিউটি রোস্টারের মিটিং বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। হাতাহাতি পর্যন্ত হতে শুনেছি। যাঁরা শান্তিপ্রিয় অথচ সাহসী ডাক্তার তাঁরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা বেছে নেন। অনেকেই নিজের মতো করে পুজোর ছুটি কাটাতে পারেন। পুজোর চারদিন চেম্বারে তালা, কর্মচারীদের ছুটি। তবে বউ-বাচ্চা নিয়ে প্যান্ডেল হপিং খুব একটা হয় না। একজন ডাক্তার গত পুজোয় হওয়া একটা করুণ অভিজ্ঞতার কথা শোনালো। করোনা নিয়ে তখনও মানুষ এখনকার মতো বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি। একটু ভয়ভক্তি ছিলই। যথারীতি ক্যাপ মাস্কে সুসজ্জিত হয়ে ডাক্তারবাবু প্যান্ডেলে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘাড়ের কাছে মুখ এনে একজন বললো “ডাক্তারবাবু, আপনার ওষুধে কিন্তু এখনো কমলো না।” ডাক্তারবাবু বুঝতে পারছে না বুঝতে পেরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাস্কটা নামিয়ে আরও কাছে মুখ এনে বলে “আমি আপনার জ্বরের পেশেন্ট।” ঠাকুর দেখা মাথায়। ডাক্তারবাবু বাড়ি ফিরে প্রায় স্যানিটাইজার দিয়ে স্নান করেছিল।
তবে সংখ্যাগুরু ডাক্তারদের মতামত পুজো যদি উপভোগ করতে চাও তো বাক্সপেঁটরা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ো। হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। তাও কপালে না থাকলে আটকে যায় বৈকি। শহরের এক নামকরা গায়নাকোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে এক রোগী ছিল। স্বামী-স্ত্রী দুজনই সাহিত্যের শিক্ষক। কিছুতেই তাদের সন্তান আসছিল না। আধুনিক কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান এলেও একদম শেষ মুহূর্তে এসে প্রসবের আগে সেটি মারা যায়। তারপর থেকে সেই চেনা গায়নাকোলজিস্টের চিকিৎসাধীন সে। আবারও সন্তান এলো। ডাক্তারি হিসাব অনুযায়ী পুজোর কিছুদিন পরে সন্তান হবে তার। ডাক্তারবাবুর সপরিবারে বাইরে যাওয়া ঠিকঠাক। সপ্তমীর ভোরের ফ্লাইটে গমন আর দশমীর রাতের ফ্লাইটে আগমন। এই চারদিনে কোনোভাবেই কিছু হবার কথা নয়। আর শহরের অন্য এক গায়নাকোলজিস্টকে ছেড়ে যাওয়া কেসগুলো সম্পর্কে ব্রিফিং করা আছে। রোগীরা বিপদে পড়লে তিনি দেখে দেবেন। কিন্তু বিধি বাম। ষষ্ঠীর দিন সেই ভদ্রমহিলার কিছু জটিলতা দেখা দিল। নিজের নার্সিংহোমে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করলেন গায়নাকোলজিস্ট। যে ডাক্তারবাবুর কাছে তিনি পেশেন্ট রেখে যাচ্ছিলেন তাঁকেও ডাকা হলো। রোগী রাতের দিকে আরও খারাপ হলো। ডাক্তারবাবুর হাত ধরে রোগী অনুরোধ করে তাকে ছেড়ে বাইরে না যাওয়ার। এ ঠিক যেন আগেরবারের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
ডাক্তারবাবুদেরও স্ত্রী পুত্র কন্যা থাকে। তাদেরও একটা প্রত্যাশা থাকে নিজের মানুষটার কাছ থেকে। ব্যস্ত মানুষটার কাছ থেকে কতটুকু বা সময় পায় তারা? তবু সেই ডাক্তারের স্ত্রী এই না-পাওয়া টুকু মেনে নিলেন।
আলট্রাসাউন্ড, ব্লাড রিপোর্ট, ইকোকার্ডিওগ্রামের বাঁধ লাগিয়ে সপ্তমীর সন্ধ্যায় সিজার হলো মায়ের।
ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান হলো তার। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ডাক্তারবাবু মেয়ের বাবার কাছে এসে বললেন “মেয়ের নাম বোধন দাও। তোমার জন্য বোধন আর আমার জন্য বাঁধন।”
“না, ওর নাম রাখবো ঐন্দ্রী। দেবী দুর্গার একটা নাম।” ঝলমল করে ওঠে নতুন বাবার মুখ।