ঘটনা ১
১৯৯৯ সাল। আমি উত্তরবঙ্গের একটি গ্রামীণ হাসপাতালে কর্মরত।
এক সকালে ইমার্জেন্সিতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একটি মৃতপ্রায় মাস ছয়েকের শিশুকে নিয়ে তার পরিবারের লোকজন আছড়ে পড়লেন। হাতুড়ে, তাবিজ-কবচ ও আরো বিবিধ অপচিকিৎসা পেরিয়ে মডার্ন মেডিসিনের যাবতীয় উপলব্ধ ওষুধপত্র, অক্সিজেন, ইনজেকশন, কার্ডিয়াক ম্যাসাজ ইত্যাদি হার মেনেছিল সেইদিন। হাসপাতালে আনার কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায় শিশুটি। পরের দু’তিনঘন্টা আমার ইমার্জেন্সি লাগোয়া কোয়ার্টারের উপর ইঁট, পাথর, ছেঁড়া জুতো নিয়ে বর্বর তাণ্ডব চলেছিল সমবেত জনতার। ভিতরে বসে আমি তখন ঠকঠক করে কাঁপছি।
অবশেষে স্থানীয় থানার পুলিশ এসে আমায় উদ্ধার করেন। পুলিশের পরামর্শ অনুযায়ী শিশুর পরিজনেরা দেহের পোস্টমর্টেম করতে গররাজি হওয়ায় কোনো কেস হয়নি।
ঘটনা ২
২০১৬। আমি কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্কের চিকিৎসক। প্রখর গ্রীষ্মে অপ্রতুল রক্তদান শিবিরের কারণে প্রতিদিন রোগীর বাড়ির লোককে স্বেচ্ছা রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে ক্লান্ত এবং তিতিবিরক্ত। ফলে অনুরোধ উপরোধের পরিবর্তে বকাবকি, ধমক, তিরস্কার পর্যন্ত করে ফেলছি মুমূর্ষু বাবার জন্য রক্তদানে বিমুখ সন্তানকে অথবা রক্তাল্প প্রসূতি স্ত্রীর জন্য রক্তদানে অনিচ্ছুক স্বামীকে। এরই মধ্যে এক বয়স্ক ভদ্রলোক তাঁর পুত্রের জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে ব্লাডব্যাঙ্কে এসে আমাকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন — “আপনার মতো খারাপ ব্যবহার করতে আমি কোনো ডাক্তারকে কখনো দেখিনি।”
পরবর্তী ঘটনা সংক্ষিপ্ত।
বয়স পঁয়ষট্টি অতিক্রান্ত হওয়ায় রক্তদান করায় তাঁর অপারগতা জানালাম ভদ্রলোককে।
ইমার্জেন্সি স্টক থেকে আপাতত রক্ত দিয়ে দিচ্ছি বলে আশ্বস্ত করতে গিয়ে দেখি, তিনি হুঁশ হারিয়ে পড়ে যাচ্ছেন মেঝেতে। আরেকজন রোগীর পরিজনের সাহায্যে তাঁকে ধরে ফেলে, যথাবিহিত পরিচর্যা করেছিলাম খোলা বারান্দাতেই, কারণ ব্লাডব্যাঙ্কে রোগীদের জন্য বেড থাকে না। মাথা ধুইয়ে, ওআরএস আর বিস্কুট খাওয়াবার সময় নিজের বাবার কথাই মনে পড়েছিল আমার।
খানিক সামলে উঠে সংগৃহীত রক্ত নিয়ে ভদ্রলোককে রওনা করিয়ে দেবার পরে কাজে ফিরছি, হঠাৎ পায়ের উপর হাতের স্পর্শ পেলাম। চমকে উঠে দেখি সেই অন্য রোগীটির পরিজন, যাঁর সাহায্যে অসুস্থ ভদ্রলোকের শুশ্রূষা করেছিলাম। অত্যন্ত বিব্রত হয়ে, ঝুঁকে পড়ে সেই ছেলেটির হাত ধরে তুলতে তুলতে শুনলাম —
‘বিশ্বাস করুন দিদিমণি, সব ডাক্তার যদি আপনার মতো মন নিয়ে চিকিচ্ছা করতেন, রোগীর আদ্দেক রোগ ওষুধ ছাড়াই ভাল হয়ে যেত।’
প্রতিটি রোগীর চিকিৎসার প্রেক্ষিত ও পরিবেশ স্বতন্ত্র।রোগের প্রকৃতি এবং গুরুত্বের নিরিখে রোগীর সেরে ওঠা বা না ওঠার সম্ভাবনাও ভিন্ন। এ’কথা চিকিৎসকদের মতো রোগীর আত্মজনদেরও বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসক ঈশ্বর নন, সকল সমস্যার মুশকিল আসানের চাবিকাঠি তাঁর হাতে নেই। আবার তিনি শয়তানও নন, ইচ্ছাকৃত গাফিলতিতে কারোর প্রাণ কেড়ে তাঁর নিজের সুনাম গগনচুম্বী হবে না, এ কথা তাঁর নিজের চেয়ে ভাল আর কেউ জানেন না। তবে যে মানুষ তাঁর অসুস্থ প্রিয়জনকে সুচিকিৎসার ভরসায় নিয়ে আসছেন, তাঁর প্রতি সংবেদই একজন প্রকৃত চিকিৎসকের ধর্ম, এটা যেন আমরা, ডাক্তাররা কখনো বিস্মৃত না হই।