কিছু চরিত্র জীবনে গভীর দাগ কেটে যায়। নাটেশদা তেমনই এক চরিত্র। যারা তাকে চিনতেন না তাদের জানাই ডাঃ জে নাটেশ একজন কন্নড় অর্থোপেডিক সার্জেন। যে মহীশূর থেকে এমবিবিএস করার পরে অর্থোপেডিক্সে এমএস করতে এই সুদূর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এসেছিল সেই ১৯৯৩ সালে। তার কলকাতায় আসার কারণটা ছিল অদ্ভুত। কালিকট মেডিক্যাল কলেজ চয়েস করতে গিয়ে নাকি ভুল করে কলকাতা চয়েস করে ফেলেছিল।
আমি তখন এমবিবিএস পড়ি, চতুর্থ বর্ষ। চার বছর মেডিক্যাল কলেজে হোষ্টেলের ছারপোকা ভরা খাটে কাটিয়ে দিয়ে বেশ একটা ‘আমি কি হনু’ ভাব এসেছে। একদিন হোষ্টেলের দাদাদের আলোচনায় শুনলাম কর্ণাটক থেকে দুজন পিজিটি এসেছে, যারা কোনো হাউসষ্টাফ হোষ্টেলে জায়গা পাচ্ছে না। আমি একটু পাকামি করে বললাম, ‘এটা খুব অন্যায় হচ্ছে।’
‘কেন? আমাদের ছেলেমেয়েরাও তো অন্য রাজ্যে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে অত্যাচারিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়!’
সেই যুগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কয়েকজন নাকি মধ্যপ্রদেশের কোনো মেডিক্যাল কলেজে পোষ্ট গ্রাজুয়েটে জয়েন করেও প্রবল অত্যাচারিত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল। আমি কিন্তু এই বিষয়টা বিশদে জানতাম না।
অনেকে বলল, ‘এভাবে একজনের অপরাধের জন্য আর একজনের উপর প্রতিশোধ নেওয়া যায় না।’
শেষ পর্যন্ত সেই দুজনের জায়গা হল ইডেন রুফ হোষ্টেলে। তাদের একজনের নাম কে সতীশ। আর একজন জে নাটেশ।
এর বেশ কিছুদিন পর ফাইনাল এমবিবিএসের পড়াশোনা শুরু হল। তখন অর্থোপেডিকস-এর ক্লিনিক্যাল কেস দেখার জন্য সিনিয়রদের পরামর্শে নাটেশদার ক্লাসে যাওয়া শুরু করলাম। সেই সময় দিনের বেলা মেডিক্যাল শিক্ষকরা থিওরি বা ক্লিনিক্যাল ক্লাস নিতেন। আর সন্ধ্যাবেলা আমরা, এমবিবিএস-এর ছাত্রছাত্রীরা সিনিয়র পিজিটি (স্নাতকোত্তর)-দের কাছে ওয়ার্ডে ক্লাস করতাম। এগুলো আনঅফিসিয়াল ক্লাস। কিন্তু খুব কার্যকরী। পরবর্তী নিজেও এমএস করার সময় এমবিবিএস ছাত্রছাত্রীদের এভাবে পড়িয়েছি।
ক্রমে ক্রমে নাটেশদার ক্লাস এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে ক্লাসে জায়গা পাওয়াই মুশকিল। বস্তুতঃ অ্যানাটমির ডিসেকশন ক্লাসের পর এত ভীড় কোনো ক্লাসে বোধহয় আমি দেখিনি। কিন্তু জেনারেল সার্জারির চাকচিক্যের কাছে অর্থোপেডিক্স তখনও নিতান্তই দুয়োরানী এবং বেশী জনপ্রিয় হয়ে পড়লে ঈর্ষা এবং ক্ষমতাবানদের রাগের লক্ষ্য হওয়া অবশ্যম্ভাবী। নাটেশের ক্লাসে ভীড়ের মধ্যে ডিপার্টমেন্টের একটা টেবিলের কাঁচ ভাঙ্গল এবং তার জন্য নাটেশদার হল শো কজ এবং শাস্তি। একটু দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু দমে যায়নি সে।
নাটেশদা কোনো বিষয়েই দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না। অত্যন্ত স্মার্ট, সুপুরুষ, হাসিখুশী, সহজ অথচ আত্মবিশ্বাসী, ডাকাবুকো মানুষ ছিল সে। আমাদের পড়িয়েছিল, অনেক জুনিয়রদের হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিল। তার সময় এবং স্তরের তুলনায় তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানে অনেক এগিয়ে ছিল সে। সবার সাথেই তার অত্যন্ত ভাল ব্যবহার। গোটা কলেজের সবাই তখন তাকে এক ডাকে চেনে এবং পছন্দ করে। ততদিনে লম্বা, হ্যান্ডসাম নাটেশদা অনেকের হার্টথ্রবও হয়ে উঠেছে।
তারপর এমবিবিএস পাশ করে গেলাম এবং ইন্টার্নশিপে ইডেন রুফ হাউসষ্টাফ হোষ্টেলে থাকতে শুরু করলাম। একটা সিঙ্গল রুমে থাকত নাটেশদা। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে যেরকম হয়, হোষ্টেলে খাওয়ার অবস্থা ছিল অত্যন্ত জঘন্য। আমরা তবু কড়া ভাজা আধপচা মাছের ছোট্ট টুকরোর গন্ধে ভাতের গ্রাস গলায় চালান করে দিতাম। কিন্তু নিরামিষভোজী নাটেশদার অবস্থা ছিল শোচনীয়। একদিন দেখি ডাল আর চানাচুর দিয়ে ভাত খাচ্ছে সে। আমাকে বলল, ‘খাও।’
ইন্টার্নশিপের এক বছর একই হোষ্টেলে কাটল। নাটেশদা তখন একটা আধুনিক বিষয় নিয়ে থিসিস করছে। এমনকি নিজের গাইডের থেকেও যে বিষয়ে বিশেষ গাইডেন্স পাওয়ার আশা নেই। তবু ঠিক সময়ে শেষ করল সে থিসিস। আমি তখন পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট এন্ট্রান্সের জন্য পড়ছি। অর্থোপেডিক্সে কিছু আটকালেই আমরা নাটেশদাকে জিজ্ঞেস করতাম। আর সানন্দে পড়াতে বসে যেত সে। অন্য একটা রাজ্য থেকে এসে ভাষার দূর্লংঘ্য বেড়া টপকে সকল শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের মন জয় করে নিয়েছিল নাটেশদা।
চিকিৎসার বিদ্যায় রোগীর সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য স্থানীয় ভাষা জানাটা বাধ্যতামূলক ঠিকই। কিন্তু সেই প্রয়োজনকে ছাপিয়ে ভালোবেসে বাংলা শিখেছিল সে। একটা নিজস্ব টোনে বাংলা বলত – কোনো ইংরেজী, হিন্দি বা কন্নড় শব্দের মিশেল ছাড়াই। আঠের-উনিশ বছর বাদেও হায়দ্রাবাদে দেখা হতে পুরোদস্তুর বাংলায় কথাবার্তা হল।
ইন্টার্নশিপ শেষ হতে হাউসষ্টাফশিপ শুরু হবে। আমি ঠিক করলাম জেনারেল সার্জারি করব। নাটেশদা বলল, ‘জেনারেল সার্জারি বা অর্থোপেডিক্স এখন নিও না। এত কাজ ওই দুটো সাবজেক্টে যে এন্ট্রান্সের জন্য পড়ার সময় পাবে না।’ সুতরাং ডেন্টাল এবং ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি নিলাম। কাজে ফাঁকি না দিয়েও পড়ার জন্য অঢেল সময়। অনবদ্য ষ্ট্র্যাটেজিস্ট। ওর পরামর্শে প্রথম সুযোগেই চান্স পেয়ে গেলাম সর্বভারতীয় এন্ট্রান্সে। খুব খুশী হয়েছিল নাটেশদা। ইন্টারনেট ছিল না। খবরের কাগজের পাতায় রেজাল্ট বেরোতো তখন। কাজ শেষে ফিরছি বিকেলে। হোষ্টেলের ইংরেজী কাগজটা হাতে নিয়ে নাটেশদা চেঁচিয়ে বলল, ‘রেজাল্ট বেরিয়েছে। তুমি চান্স পেয়ে গেছ।’
অর্থোপেডিক্স নিলাম। তাও নিজের কলেজে। এর আগে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ক্যান্সার সার্জারিতে এমএস পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম মুম্বাই চলে যাব। বারণ করেছিল নাটেশদা। বলেছিল, ওটা এমসিআই অনুমোদিত নয়। সেটা ১৯৯৬। নাটেশদা এমএস পাশ করে মহীশূরে ফিরে গেল। আমাকে দিয়ে গেল উত্তরাধিকার। অনেক বই, যন্ত্রপাতি, ওর এক্সরে-র সংগ্রহ- যা অর্থোপেডিক্স পড়তে আর পড়াতে খুবই কাজে লাগত ইন্টারনেট পূর্ববর্তী যুগে। বলল, ‘প্ল্যাব দিলে আমাকে বোলো। আমি তোমার ফী দিয়ে দেব।’
আমি বললাম, ‘তুমিও দিতে চলো।’
‘দেখা যাক।’
যাই হোক। সেসব তখন আর হয় নি।
তারপর ইন্টারনেট এসেছে, ফেসবুক এসেছে, ইউ টিউব এসেছে। আমি সরকারী চাকরিতে যোগ দিলাম। মেডিক্যাল কলেজে পড়ালাম। আবার ছেড়েও দিলাম। কিন্তু জে নাটেশের মত এত প্রতিভাবান, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান, আন্তরিক, পরোপকারী অথচ সৎ ও সহজ মানুষের সংস্পর্শে এলাম না।
বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছিল নাটেশদা। তখন সবে আর জি করে জয়েন করেছি । প্রবল কাজের চাপ। যেতে পারিনি। সেবার ২০০৭ সালে অর্থোপেডিক্সের জাতীয় সন্মেলন হচ্ছে কলকাতায়। নাটেশদা এল। একটু হতাশ। যে মানুষটাকে আমরা সবাই দেখে অভস্ত্য ছিলাম, দশ বছর বাদে সে যেন তার ছায়া। সন্মেলনের আলোচনা চক্রে, বিতর্কসভায় চুপ করে বসে ছিল। বিশেষ মুখ খুলল না। বিষাদ ভরা মুখে বলল, আমি হিপোক্রিট নই। এই সব অ্যাকাডেমিক কাজ এখন আমি আর খুব একটা করার সুযোগ পাই না। নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ ভারতে বিখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জেন ও শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর এম ভি নটরাজন। সবাই নাটেশদাকে বলত ‘ভবিষ্যতের নটরাজন’। এতটাই উজ্জ্বল ছিল তার কর্মকান্ড। কিন্তু বেলারিতে একটা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ানো আর প্র্যাকটিস করা ছাড়া আর কিছুই হল না। সব কুঁড়িই তো আর ফুল হয়ে ফুটে ওঠে না।
হায়দ্রাবাদে দেখা হতেই জড়িয়ে ধরেছিল। স্ত্রী এবং সন্তানদের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। হায়দ্রাবাদ কনফারেন্সে আমার একটা গেষ্ট লেকচার ছিল। সারাক্ষণ হলে বসে ছিল নাটেশদা। ডাঃ তিলক মাল মেডিকেল কলেজে নাটেশদার সহপাঠী ছিল এমএস কোর্সে। নাটেশদা, তিলকদা আর আমি অনেক গল্প করলাম, ঘুরে বেড়ালাম হায়দ্রাবাদে। সে সবই এখন স্মৃতি।
গত রবিবার ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে ডক্টরস ডায়ালগের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান থেকে ফিরছি। গাড়ি একটা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে রাখা ফোনের দিকে তাকাতেই কিংশুকের মেসেজ টায় চোখ পড়ল। ডাঃ জে নাটেশ আর নেই। অ্যাক্সিডেন্ট। মাথাটা ঘুরে গেল।
অতিমারীর যুগে এত পরিচিত বন্ধুবান্ধবের অকাল মৃত্যু সহ্য করতে হচ্ছে! তবু এটা সহ্য হল না। মনের সহনশীলতারও তো একটা সীমা আছে! কোনোমতে খুব সাবধানে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরেই ভেঙ্গে পড়লাম। কিন্তু তখনো সংবাদটা বিশ্বাস করতে পারিনি। তাই আজ সকালে বেঙ্গালুরুর বন্ধু ডাঃ দীপক শিভান্নাকে মেল করলাম। সে বলল, খবরটা সত্যি। তবে মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কারণ যাই হোক, অকালে চলে গেল এককালের এক প্রবল সম্ভাবনা। ???