একটা বিরাট বাগান ঘেরা বাড়ি। বিরাট বাড়ি, বিরাট বাগান। ছায়াঘেরা আম, জাম, বড় বড় পাতার শাল, মাটিতে বেগুনি ফুলে কার্পেট বানিয়ে জারুল, হয়তো পারুলও আছে। কিম্বা আরও অনেক অনেক গাছ। এই জানালা দিয়ে, এটুকুই দেখা যায়। এটা একটা পাগলাগারদ-উন্মাদ, নিরাময়হীন রোগীদের এখানে রাখা হয়। বিছানার চাদর নেই। একটা চেয়ার, একটা টেবিল, কোনও সুইচ বা প্লাগ পয়েন্ট নেই, বাথরুমের দরজায় ছিটকিনি নেই। ঘরে ছড়ানো রং, তুলি।বড়ো বড়ো রং করা কাগজ। না, ভ্যান গঘ নয়, এখানে থাকে এক সাদা চুলের বৃদ্ধ। টিয়াপাখির মতো বাঁকা নাক, মুখে না কামানো দাড়ি গোঁফের জঙ্গল।
এমন সময় সদ্য কাজে যোগ দেওয়া ছোকরা মেডিক্যাল অফিসার ঘরে এসে ঢুকলো। বুড়ো তখন জানালা দিয়ে দুটো কুকুরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দরজায় শব্দ হতে ফিরে তাকালেন।মেডিক্যাল অফিসার বুড়োকে স্যালুট করে বললো “গুড আফটারনুন প্রেসিডেন্ট”
বুড়ো বিরক্ত হলেন “স্যালুট করার কি আছে? আমরা সবাই সমান। আয়াম ফার্স্ট অ্যামঙ দ্য ইক্যুয়ালস।”
মেডিক্যাল অফিসার বললো “দাড়ি কাটতে দ্যান নি ক্যানো? কি বিশ্রী দ্যাখাচ্ছে বলুন তো…..”
“কোথায় গুপ্ত শত্রু আছে, কেউ বলতে পারে? তারপর গলাটা যদি….” বুড়ো এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে “তোমরা তো আমাকে একটা শেভিং সেটও দেবে না….”
ডাক্তার হাসে “আপনাকে মারবে কেন?”
“কেন?…আমি তো প্ল্যান করেছিলাম… এরপর সব রাজনৈতিক নেতাকে ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাবো… নেহরু যেমন বলেছিলেন… কালোবাজারীদের ঝোলাবেন.. সেরকম ভাঁওতা নয়….এটায় আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলাম….তাই তো ওরা আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলো-মেরে ফেলবে বলে’…..”
মেডিক্যাল অফিসার খানিক ইতস্ততঃ করে একটা সিগারেট ধরায় “আপনি রাজনৈতিক নেতাদের মৃত্যুদন্ড কেন দিলেন?”
“না হে তুমি নিশ্চিন্তে সিগারেট ধরাও, আই ও্যোন্ট মাইন্ড।….ও হ্যাঁ… কেন মৃত্যুদন্ড দিলাম? মে আই হ্যাভ ওয়ান ফ্যাগ,প্লিজ?”
ছেলেটি একটু দ্বিধা করে’ একটা সিগারেট আর লাইটার এগিয়ে দেয়। বুড়ো একবুক ধোঁয়া টেনে বলেন “আসলে ওরা সব গণতন্ত্র নামক একটা মিথ্যে বকওয়াশ করে’ মানুষের মাথায় ঘোল ঢালছিলো।” উনি ছেলেটাকে লাইটারটা ফেরত দেন।
“গণতন্ত্র বুঝি একটা বকওয়াশ? আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না?” ছেলেটা লাইটার পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে প্রশ্ন করে।
“আচ্ছা বাপু, তোমার গণতান্ত্রিক অধিকার সম্বন্ধে তুমি কী বোঝো একটু বোঝাও তো…”
বুড়ো সিগারেট হাতে ছোকরা ডাক্তারের মুখে চেয়ে থাকেন। ছেলেটা একটু দোনোমোনো করে বলে “বাক স্বাধীনতা, কাজের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা…”
“বাক স্বাধীনতা কি জিনিস তুমি বোঝো? তোমার সেই স্বাধীনতা আছে? যে লোকটা জীবনে অ আ, ক,খ… কিচ্ছু বোঝে নি, সে তার অধিকার কি বুঝবে? টিপসই দিয়ে যারা ধার নেয়….কতো টাকা নিচ্ছে, কতো পারসেন্ট সুদে কিচ্ছু জানে না…..সির্ফ আঙুঠা দিয়ে…..তার কাছে এই সব অধিকার?বোঝে ওরা?এদের নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা? যে লোকটার কি আদর্শ, কি করতে চায়, কিচ্ছু জানে না, তাকে ভোট দিতে বাধ্য হয়।যেহেতু মোড়ল বা সর্দার বলেছে ঐ ছাপে বোতাম টিপবি….অথবা স্রেফ বিক্রি হয়ে গেছে….তাই সে… এটা গণতন্ত্র? এটাকে তুমি গণতন্ত্র বলো?”
ডাক্তার চুপ করে থাকে। অন্যমনস্ক সিগারেট পুড়ে যায়। সিগারেটের ডগায় ছাই জমে।
“তাহলে কি কম্যুনিজম দিয়ে মুক্তি আসবে?”
“ঐ লোকগুলোই তখন লাল জামা, লাল মুখোশ লাগিয়ে কম্যুনিস্ট হয়ে যাবে….” বুড়ো হা হা করে হেসে ওঠেন “যে কোনও একটা ইজম গ্রহণ বা বর্জনের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা লাগে।না হলে….” বুড়ো চুপ করে যান।
“না হলে? নাহলে কি লাগে?”
“না হলে একটা ডিক্টেটর লাগে, নির্মোহ, নিষ্ঠুর সৎ মানুষ…..যে একটা ঠিক পথ দেখাবে….না না অবতার, যুগপুরুষ নয়। একটা রাফ এ্যান্ড টাফ সৎ লোক, যে মিলিটারি শাসনে দেশ চালাবে, সবাইকার মাথার ওপরে ছাদ দেবে, পকেটে পয়সা দেবে, খেয়েও কিছু টাকা যাতে বাঁচে…..যাতে সন্তানকে পড়তে ইশকুলে পাঠানোর স্বপ্ন সে দেখতে পারে, না হলে খাবারের জন্য ঐ বাচ্চাটাও কাজে লেগে যাবে…..পেটের জন্য… বাড়ির সবাইকার যাতে মুখে অন্ন জোটে, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারে….স্বৈরতান্ত্রিক মিলিটারি রাজ…..যাতে যুদ্ধ না করে জেতা হয়ে যায়…”
“মানে, আপনি ফিদেল কাস্ত্রোর কথা বলছেন? মানে ঐ রকম?”
“আরও কঠোর, নির্মম….”
“চে গ্যেভারার মতো? বিদেশী শত্রু না মেরে নিজের দেশের মানুষকে খুন?”
“শত্রু? ধর্মভিত্তিক, দ্বিজাতিতত্ত্বে দেশ ভাগ হয়ে, একটা ধর্মই আমাদের শত্রু হয়ে গেল?”
ডাক্তার কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে যায়।
“খান আবদুল গফ্ফার খানের নাম শুনেছো? লবণ সত্যাগ্রহের সময় পাকিস্তানে দুশো জন নিরস্ত্র মুসলিম সত্যাগ্রহীকে (‘খুদা ঈ খিদমতগার’ বা ‘রেড শার্ট’কে) একটা জমায়েতে গুলি করে মারা হয়, সেটা কি জানো হে? ইংরেজ মেরেছিলো…”
“ইয়ে ঐ গফ্ফার লোকটা কে?”
“সীমান্ত গান্ধী। জানো কি ঐ পাকিস্তানী লোকটা ভারত ভাগের বিরুদ্ধে ছিলো…. ভারত রত্ন পুরষ্কার পেয়েছে? ঐ লোকটা আমাদের শত্রু? পাকিস্তানে জন্ম, পাকিস্তানেই মৃত্যু…..
জানো? রাশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ (৮.৭ ওপরে, দশের নিচে) মুসলমান। চেচনিয়া, ইঙ্গুশেথিয়ার জনসংখ্যা ধরা হয়নি। ২০১৮ সালে রাশিয়ার মোট মুসলিমদের সংখ্যা ২৫০০০০০০, তাহলে? রাশিয়া নিশ্চয়ই আমাদের শত্রু? নাকি পাকিস্তানী মুসলমানই আমাদের শত্রু?”
ছোকরা ডাক্তার এই পাগল বুড়োর সঙ্গে তর্ক না করে চুপ করে থাকে।
“শত্রু হলো তারা, যারা আমাদের দেশের ক্ষতি করে। দেশ মানে শুধু এক টুকরো মাটি নয়, সেখানকার যত জীবন্ত প্রাণ আছে, সবাই মিলেই দেশ। যে সব রাজনৈতিক নেতা, আমলা, সরকারি কর্মচারী, পেশাদার মানুষ, পুলিশ,যে মানুষের ক্ষতি করে, তারাই দেশের শত্রু।”
“বিদেশী শত্রু?”
“একবার কিউবা দখল করতে আমেরিকার সৈন্য কিউবার মাটিতে নেমেছিলো (বে অফ পিগস)। কাস্ত্রো সরাসরি আমেরিকাকে লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক নিউক্লিয়ার মিসাইল বসানোর ব্যবস্থা করলেন। দেশের আর লড়াই করার দরকার নেই, হয় শান্তি নয় অনিবার্য ধ্বংস….উভয় পক্ষের। কোনও সৈনক্ষয় নেই….অর্থনৈতিক পতন নেই…..”
“কিন্তু এটা তো অ্যাবনর্ম্যাল…আপনি এতোজন দেশের মানুষকে হত্যা করার কথা বলছেন… এটা পাগলামি…”
“সিজোফ্রেনিয়া তাই না ডাক্তার? ডিল্যুশন অভ গ্র্যান্ডিওর….অথচ কোনোটাই ঠিক ঠাক ছকে মিলছে না…অথচ একটা উকিল, পুলিশ, মন্ত্রী ঘুষ খাচ্ছে….নেতারা নীতি বলে কিছু হয়, সেটাই ভুলে গেছে…..ঘুষ না দিয়ে সরকারি কাজ হয় না…..ডাক্তার কমিশন খাচ্ছে….চাষী আত্মহত্যা করছে….উচ্চবর্ণের লোক নিম্নবর্ণের মেয়েদের ধর্ষণ করছে… ঐ দেশভাগের ফল হিসেবে আজও দুই ধর্মের মানুষ হত্যালীলায় মাতছে….এগুলো সব সয়ে গেছে…তাই এগুলো স্বাভাবিক… আমিই অ্যাবনর্ম্যাল….যদি আমাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে না দিতো…তাহলে… তাহলে আমি মানুষকে আবার স্বপ্ন দেখতে শেখাতাম….”
ডাক্তারের খাওয়ার সময় হচ্ছে।সে উঠে পড়ে।
“ডাক্তার, লাইটার তো দেবে না… যদি আগুন ধরিয়ে দিই, সেই ভয়ে… তাইনা? একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে যাবে?”
ছোকরা ডাক্তার একটা সিগারেট দিয়ে, আগুন ধরিয়ে দ্যায়।
তারপর পাগলা বুড়োকে তার স্বপ্ন সমেত একটা ঘরে তালা লাগিয়ে চলে যায়। এর রোগলক্ষণ কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। বরং সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। এর কথা বার্তায় সমস্ত ধ্যানধারণাকে দলে মোচড়ে দিয়ে গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়ে যাবে। থাকুক বুড়ো ওর দিনবদলের অদ্ভুত সব স্বপ্ন নিয়ে বন্ধ। এই কুঠুরির খবর কেউ জানবে না। স্বপ্ন ভুলিয়ে তবেই ওকে বাইরে আনা যাবে। তবু অনির্ভরযোগ্য থেকেই যাবে। সুতরাং মুক্তি হবে না।
বুড়ো তাতেই খুশি, স্বপ্ন চয়ন করে চলে, বন্ধ দুয়ারের ভেতরে বসে। হয়তো কোনদিন কেউ এই সব শুনবে……..