১
দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে। সবে অপারেশন শেষ হল। এখন আর লাঞ্চ করতে ভালো লাগছে না। সমরজিৎ এক কাপ চা নিয়ে প্রথম পেশেন্টকে ডাকতে বলল। এখন ষোলো জন পেশেন্টকে দেখে ইভনিং রাউন্ড দিয়ে তবে ছুটি। ক’টা বাজবে কে জানে!
দরজাটা আস্তে করে খুলে গেল। পেশেন্ট নয়, মার্কেটিং-এর সুদীপ। মিচকে বদমাইশ।
– ‘দীপিকা ম্যাডাম একজন ভি আই পি পেশেন্ট পাঠিয়েছেন। একটু দেখে দিতে হবে।’
– ‘পাঠাও। কিন্তু ভিআইপি টা কে?’
-‘আনমিতা মিত্র। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। বিখ্যাত গায়িকা।’
ভেতরে এলেন বিখ্যাত গায়িকা আনমিতা। সুন্দর পারফিউমের গন্ধে ভরে গেল ঘর। হাসপাতালে এলেও এদের এত পারফিউম লাগাতে হয়!
-‘বলুন, কি সমস্যা?’
-‘সমস্যা তো আপনাকে তৈরী করতে হবে ডক্টর সেন। আমার আপাততঃ একটা সার্টিফিকেট দরকার। আনফিট সার্টিফিকেট।’
-‘বুঝলাম না।’
-‘আর বলবেন না, ফেঁসে গেছি। সেই ফেব্রুয়ারিতে কন্ট্র্যাক্ট সাইন করেছিলাম- আমস্টারডাম ফেস্টিভ্যালে গাইব।’
– ‘যান, ঘুরে আসুন। আমস্টারডাম তো খুব সুন্দর জায়গা।’
-‘গেলে তো ভালোই হত। কিন্তু ওই সময় ভাই-এর বিয়ে পড়েছে। যেতে পারব না।’
-‘ও।’
-‘এখন আপনারা ভরসা।’
-‘ঠিক বুঝলাম না।’
-‘আপনি একটা আনফিট ফর ট্রাভেল সার্টিফিকেট না দিলে আমাকে কন্ট্র্যাক্ট ক্যানসেল করার জন্য কু-ড়ি হাজার ইউরো কম্পেনশেসন দিতে হবে। একটু করে দিন না, প্লিজ।’ ন্যাকামির সুরে বললেন আনমিতা মিত্র।
-‘কিন্তু আমি কি করে আনফিট সার্টিফিকেট দেবো? আপনার তো কোনো মেজর সমস্যা নেই বলছেন।’
-‘যা হোক একটা লিখে দিন না! অকারণে কুড়ি হাজার ইউরো এখন আমি দিতে পারব না, ডক্টর সেন।’
একটা গানের সিডি ব্যাগ থেকে টেবিলের উপরে রাখলেন মিস মিত্র।
-‘দেখুন ম্যাডাম, আপনি আমার পেশেন্ট নন। তাছাড়া আমি কাউকেই ফলস্ মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিই না।’
-‘কিন্তু দীপিকা বলল যে, আপনি….’
-‘না ম্যাডাম। আমি নিয়মের বাইরে যেতে পারব না।’
-‘ওঃ! ঠিক আছে। চলি। গানগুলো শুনবেন।’
খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে পরের পেশেন্টদের দেখে হাসপাতাল ছেড়ে বেরোলো সমরজিৎ। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। দীপিকা মুখার্জীর ক্যাচ্। এর এফেক্ট খুব খারাপ হবে।
পরদিন হাসপাতালে যেতেই সুদীপা রিসেপশন থেকে বলল,- ‘আপনার রুমটা চারতলায় করে দেওয়া হয়েছে স্যার।’
-‘সে কি! চারতলায় অর্থোপেডিক পেশেন্ট কি করে উঠবে?’
-‘তা জানি না স্যার। সুপারের অর্ডার।’
-‘ও কে।’
এর তিনমাস বাদে বাইপাসের ধারের ওই হাসপাতাল ছেড়ে দেয় সমরজিৎ।
২
বাইপাসের ধারের এক বড় হাসপাতাল। সৌমেন, মানে ডাঃ সৌমেন পালের চেম্বার নতুন বিল্ডিং-এর দোতলায়। কাঁচের বড় জানলা দিয়ে নীচেটা দেখা যায়। উল্টো দিকের চেয়ারে বসে আছে যে ভদ্রলোক তিনি স্কুলটীচার। জন্মগতভাবে পঙ্গু ছেলের অপারেশন হয়েছে চারদিন আগে। ডাঃ সৌমেন পাল করেছেন। সাত বছরের ছেলেটা ভালোই আছে। এত বছর বাদে এবার দাঁড়াতে পারবে সে!
ভদ্রলোক এক তাড়া কাগজ এগিয়ে দিলেন ডাঃ পালের দিকে।
-‘ডাক্তারবাবু কিছু একটা করুন। কি করে এই বিল মেটাবো আমি?’
দ্রুত কাগজগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিলেন ডাঃ পাল।
-‘এত কি করে হল? দাঁড়ান দেখছি।’
– ‘আপনি তো বলেছিলেন দু-আড়াই লাখ টাকার আসেপাশে খরচ হবে। সেখান তিন লাখ কুড়ি হাজার!’
– ‘কিন্তু অপারেশন তো ভালো হয়েছে। ছেলে তো আপনার ভালোই আছে! তাছাড়া আমার চার্জ তো যা বলেছিলাম, তাই-ই এসেছে- পনের হাজার।’
– ‘ আপনার চার্জ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই স্যার। আপনি আমার ভগবান। কলকাতায় আপনি ছাড়া আর কেউ এই অপারেশন করতে রাজীই হয়নি। আপনার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগই নেই।’
দুহাত জোড়া করে প্রণামের ভঙ্গী করলেন ভদ্রলোক।
ইন্টারকম ডায়াল করে হাসপাতালের সুপারকে কি সব বললেন ডাঃ পাল।
-‘ঠিক আছে যান। আড়াই লাখ টাকায় হয়ে যাবে।’
-‘আবার বলছি, আপনি নেক্সট টু গড। ভগবান আপনার ভাল করুন।’
প্রনাম ঠুকে বিদায় নিলেন ভদ্রলোক।
সেই থেকে পরের আটমাস ডাঃ পালের মাইনে থেকে প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা করে কেটে নেয় হাসপাতাল। জটিল অপারেশন করতে গিয়ে হিরো সাজার গেরো।
৩
দীপান্বিতা-র ছেলে প্রদীপ্ত-র আজ ছুটি হবে। দীপান্বিতা মুকুন্দপুরের এই হাসপাতালেই চোখের ডাক্তার। প্রদীপ্ত ডেঙ্গু হয়ে গত দশদিন প্রমিত-দার আন্ডারে ভর্তি।
ইনসিওরেন্স থেকে ক্লিয়ারেন্স এখনো এল না! অথচ গতকাল সন্ধ্যায় ডিসচার্জ লিখে গেছে আর এম ও। ছেলেটা বাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। আর পারছে না! বার বার ওয়ার্ড থেকে ফোন করছে।
দীপান্বিতার পেশেন্ট দেখাও এখনো হল না। হঠাৎ দরজা ঠেলে তনিমা ঘরে ঢুকল। তনিমা ওর অপটোমেট্রিস্ট।
-‘বিলিং সেকশন থেকে ফোন করেছিল, ম্যাডাম। ইনসিওরেন্স ক্লিয়ার করেছে। তবে….’
-‘তবে কি?’
-‘আঠাশ হাজার টাকা পে করতে হবে। ওটা ইনসিওরেন্স দেয় নি।’
-‘ঠিক আছে। কার্ডে করে দেব।’
পেশেন্ট শেষ করে বিলিং এর সন্দীপকে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের কার্ডটা দেয় দীপান্বিতা।
– ‘কার্ডটা কাজ করছে না, ম্যাডাম।’
তারপর ষ্টেট ব্যাঙ্কের কার্ডটাও কাজ করল না। কি যে হয়েছে আজ, কে জানে? সঙ্গে অত ক্যাশ কোথায়!
এমার্জেন্সির জন্য দশ হাজার নিয়ে এসেছিল সে। আঠেরো হাজার টাকা আনতে আবার গাড়ি চালিয়ে বালিগঞ্জের বাড়িতে যায় দীপান্বিতা। টাকা না পেলে হাসপাতাল প্রদীপ্তকে ছাড়বে না যে!
আমরা যারা NGO workers, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজের কাজের সাথে যুক্ত, বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন সমস্যা শুনে তার সমাধানের উপায় খুঁজে দেবার চেষ্টা করি, রোদ, জল উপেক্ষা করে তারা মাস গেলে 6/7 হাজার হাতে পাই তাও অনেক সময় মানুষের জন্য খরচ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যেটা পাই তা হল মানষিক শান্তি, টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না। আপনারা কেবল আপনারা ই পারেন ছোটবেলায় পড়া লাইনটি সকল মানুষের মনে ফিরিয়ে আনতে। ডাক্তার হলেন সমাজ বন্ধু। ডাক্তারি কোনো লোভনীয় পেশা নয়, একটু অন্য ধরনের পেশা। চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাবসা নয়, সেবা। এটা আপনারাই পারেন ব্যাবসাদারদের বুঝিয়ে দিতে। আমরা রয়েছি আপনাদের সাথে।
সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অনেকক্ষেত্রেই প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তারবাবুদের সংখ্যা অপ্রতুল।
তাই বাণিজ্যিক বেসরকারি হাসপাতালগুলির এই জঘন্য মানসিকতার প্রতিবাদস্বরূপ বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারবাবুদের অনুরোধ জানাই সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যোগদান করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে।