নেশা আর হতাশা কাটিয়ে ফের কনট ল্যাবে হাজির বান্টিঙ। বান্টিঙ আর বেস্ট চান, নিজেদের মতো করে ফের ইনসুলিন পরিশোধন করতে। সেই মতো ফের শুরু করলেন পরীক্ষা নিরীক্ষা। আগের বারের থেকে অনেক ভালো ভাবেই ইনসুলিন পরিশোধন করতে সক্ষমও হলেন তাঁরা। কিন্তু সমস্যা তো সেই একই তিমিরে। কার উপর প্রয়োগ করবেন এই ইঞ্জেকশন? হাসপাতালে গিয়ে তো আর রোগীর উপর ইঞ্জেকশন দিতে পারবেন না তাঁরা। সেখানে তো ম্যাক্লাউডের নেতৃত্বে ‘কলিপ সেরাম’ প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাহলে কাকে ইঞ্জেকশন দেবেন তিনি? বান্টিঙের সাফল্যের বড় অন্তরায় হয়ে উঠল রোগীর অভাব। বান্টিঙ যেহেতু হাসপাতালের সাথে যুক্ত নন তাই রোগীর সংকটটা সব সময়েই ভুগিয়ে গেছে তাঁকে। তবে এবার কিন্তু সহজে হাল ছাড়লেন না বান্টিঙ। এবার তিনি বেশ মরিয়া। মরিয়া হয়েই স্থির করলেন আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করবেন তিনি। তবে এবার আর শল্যবিদ হিসেবে প্র্যাকটিস করবেন না তিনি। এবার প্র্যাকটিস করবেন ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞ হিসেবে। আর সেই সুযোগে রোগীর উপর ইনসুলিন ব্যবহার করতে চান তিনি। যদিও ডায়াবিটিসের চিকিৎসা করার মতো প্রয়োজনীয় ডিগ্রী ছিল না বান্টিঙের, তবুও নাছোড় বান্টিঙ ঠিক করলেন ‘ডায়াবিটিস ক্লিনিক’ই খুলবেন তিনি, আর তা খুলবেন এই টরন্টো শহরেই। ইওরোপ, আমেরিকার বড় বড় শহরে ডায়াবিটিস ক্লিনিকের রমরমা তখন। কি চিকিৎসা হয় সেখানে? খাওয়া দাওয়ায় কিছু বিধি নিষেধ আর ব্যায়াম বা হাঁটাচলার পরামর্শ। তাতে কমবে ব্লাড সুগারের মাত্রা? আছে তাঁদের হাতে ইনসুলিনের মতো অব্যর্থ দাওয়াই? না, আর কোনো দ্বিধা নেই বান্টিঙের মনে। ‘ডায়াবিটিস ক্লিনিক’ খুলতে মনস্থির করে ফেললেন তিনি।
এপ্রিল ১৯২২, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই, ১৬০ ব্লোর স্ট্রীট ওয়েস্টে নিজের চেম্বার খুললেন বান্টিঙ। ‘চেম্বার’ না বলে ‘ডায়াবিটিস ক্লিনিক’ বলাই শ্রেয়। ডায়াবিটিস খুবই সাধারণ রোগ। প্রায় প্রতি ঘরেই ডায়াবিটিস রোগী বিদ্যমান। তাই লন্ডন শহরের মতো এবার আর রোগীর জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হলো না বান্টিঙেকে। ক্রমেই তাঁর চেম্বারে শুরু হলো ডায়াবিটিস রোগীর আনাগোনা। বান্টিঙ শুরু করলেন ডায়াবিটিসের চিকিৎসা। প্রথম দিকে রোগীর ‘ডিটেল কেস স্টাডি’ লিখে রাখতেন বান্টিঙ। সেই অনুযায়ী রোগীর চিকিৎসা করতেন তিনি। রোগীর অবস্থা বুঝে, দু’এক জন রোগীকে দিলেন তাঁর তৈরি ‘আইলেটিন’ ইঞ্জেকশন [ইনসুলিন নামটা তখনও না-পস্ন্দ বান্টিঙের]। ফলাফল মন্দ হলো না। রোগীর ব্লাড সুগারের মাত্রা কিছুটা হলেও কমেছে। আশায় বুক বাঁধলেন বান্টিঙ। আরও আইলেটিন তৈরি করতে হবে তাঁকে। দিতে হবে আরও ইঞ্জেকশন।
নিজের ‘ডায়াবিটিস ক্লিনিক’এর অভিজ্ঞতা ও রোগীর ‘কেস স্টাডি’গুলো নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করলেন বান্টিঙ। প্রবন্ধ লেখায় এখন যথেষ্টই দক্ষ হয়ে উঠেছেন তিনি। বান্টিঙের লেখা এই প্রবন্ধগুলো নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকল ‘জার্নাল অব মেটাবলিক রিসার্চ’ নামের এক পত্রিকায়। ইউএসএ ও কানাডার বড় বড় কিছু শহরে, ম্যাক্লাউডের সহযোগী হিসেবে বান্টিঙের একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছিল আগেই। ইতিমধ্যেই বান্টিঙ-বেস্টের লেখা প্রবন্ধগুলোও নজরে পড়েছে অনেকের। এখন, বান্টিঙের লেখা এই ‘কেস স্টাডি’গুলো একটা বাড়তি আগ্রহ সৃষ্টি করল অভিজ্ঞ মহলে। তাছাড়াও, খবরের কাগজে মাঝে মাঝেই তখন ইনসুলিন সংক্রান্ত নানান রিপোর্ট প্রকাশ হয়ে চলেছে। প্রাসঙ্গিক ভাবে সেই সব রিপোর্টে বান্টিঙের নামও উল্লেখ করা থাকত। এই সমস্ত রিপোর্টের জেরে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল বান্টিঙের পরিচিতি। বলা যেতে পারে, ‘ডায়াবিটিস ক্লিনিক’ খোলার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, ঘুরতে শুরু করে বান্টিঙের ভাগ্যের চাকা। ডায়াবিটিসের ডাক্তার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এখন আর ম্যাক্লাউডের সহযোগী হিসেবে চেনেন না কেউ তাঁকে, এখন সবাই তাঁকে চেনেন ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞ ডা. এফ.জি. বান্টিঙ হিসেবেই।
বান্টিঙের ডায়াবিটিস ক্লিনিকের সাফল্য দেখে, টরন্টো শহরের ‘ক্রিস্টি স্ট্রিট মিলিটারি হসপিটাল’[৩৪]। ডায়াবিটিস ক্লিনিক চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানেন, বিদেশের বিভিন্ন শহরে ডায়াবিটিস ক্লিনিক থাকলেও, টরন্টোর কোনো হাসপাতালেই ডায়াবিটিস ক্লিনিক চালু হয় নি এখনও পর্যন্ত। ডায়াবিটিস ক্লিনিক বিষয়টায় নতুনত্ব আছে। প্রয়োজনও আছে। আর আছেন ডা. বান্টিঙ। ডা. বান্টিঙের হাতেই এই নতুন ক্লিনিকের যাবতীয় দায় দায়িত্ব তুলে দিতে চান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ৮ই এপ্রিল ১৯২২, ক্রিস্টি স্ট্রিট মিলিটারি হাসপাতালে চালু হল ডায়াবিটিস ক্লিনিক, পুরোভাগে ডা. বান্টিঙ। সহযোগী হিসেবে পাশে আছেন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু ডা. গিলখ্রিস্ট।
শুধুমাত্র টরন্টো শহরেই নয়, বান্টিঙ এবং তাঁর ক্লিনিকের সাফল্য তখন সমগ্র কানাডার আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডায়াবিটিস রোগীরা এসে ভিড় জমাচ্ছেন বান্টিঙের চেম্বারে সামনে। বান্টিঙের সাফল্যের খবর ছড়িয়ে পড়েছে ইউএসএতেও। ইউএসএর নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নিকটবর্তী ‘ইউনিভার্সিটি অব বাফেলো’ থেকে পেলেন অধ্যাপনার ডাক। ইউএসএর ‘ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার’ তখন সদ্য খুলেছে তাঁদের মেডিক্যাল শাখা। রচেস্টারেও অধ্যাপনার ডাক পেলেন বান্টিঙ। বলা বাহুল্য, দুটো প্রস্তাবেই সম্মত হলেন তিনি। ইউএসএর নামজাদা ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞরাও এখন নজর রাখছেন বান্টিঙের চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে। অনেক চিকিৎসকই চিঠি লিখে বান্টিঙের মতামত জানতে চাইছেন। বান্টিঙের পরামর্শ এখন এতটাই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে যে, ডা. যসলিন, ডা. অ্যালেনের মতো খ্যাতনামা ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞরা একে একে হাজির হলেন টরন্টোয়, বান্টিঙের চেম্বারে। ডায়াবিটিসের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বান্টিঙের সাথে আলোচনা করলেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, তাঁদের রোগীদের উপর প্রয়োগ করবেন বলে, কয়েক শিশি ইঞ্জেকশন পর্যন্ত নিয়ে গেলেন তাঁর। এই ইঞ্জেকশন যেন নিয়মিত সরবরাহ করা হয়, তার অনুরোধও করলেন তাঁরা বান্টিঙকে।
এ প্রসঙ্গে একটা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করতেই হচ্ছে। ডা. অ্যালেন ছিলেন তৎকালীন ইউএসএসের নামজাদা ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞ। তাঁর প্রজ্ঞা ও খ্যাতির কারণে, ইনসুলিনের ঠিক পূর্ববর্তী সময়কালকে অনেকেই ‘অ্যালেন যুগ’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন। সেই সময়ে ডা. অ্যালেনের চিকিৎসাধীন ছিলেন চার্লস ইভান্স হিউজেসের [৩৫] ১৫ বছরের কন্যা এলিজাবেথ ইউজেস গসেট [৩৬]। এলিজাবেথ তখন ডায়াবিটিস আক্রান্ত। এলিজাবেথের চিকিৎসার জন্য, ডা. অ্যালেন স্বয়ং, বান্টিঙের কাছে রেফার করেন এলিজাবেথকে। এই ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ঠিক সেই সময়ে বহু নামজাদা ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও বান্টিঙই ছিলেন ডায়াবিটিসের একমাত্র ত্রাতা।
মায়ের সাথে এলিজাবেথ ইউজেস, ১৯১৮ সালে। |
টরন্টো জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের উপর ইনসুলিনের সফল প্রয়োগের পর এবং বান্টিঙের ডায়াবিটিস ক্লিনিকের সাফল্য দেখে ম্যাক্লাউড বুঝলেন, সময় এসেছে সারা বিশ্বের কাছে সুখবরটা পৌঁছে দেওয়ার। ইতিমধ্যে, ইনসুলিন পরিশোধনের কাজে অনেকটাই সফল হয়েছেন মলোনিও। টরন্টো টিমের সদস্যদের ডেকে ম্যাক্লাউড জানালেন, আগামী ৩রা মে ১৯২২, ইউএসএর রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বসতে চলেছে ‘এ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান ফিজিশিয়নস’এর বার্ষিক সভা। সেই সভায় ইনসুলিনের সাম্প্রতিক গবেষণার একটা রিপোর্ট পেশ করতে চান তিনি। ঘোষণা করতে চান ইনসুলিনের চূড়ান্ত সাফল্যের কথা। ম্যাক্লাউডের কথায় সম্মত হলেন টিমের সকলেই। সেই সভায় পাঠ করার জন্য তৈরি হলো একটা রিপোর্ট। ‘দ্য এফেক্ট প্রোডিউস অন ডায়াবিটিস বাই এক্সট্রাক্ট অব প্যানক্রিয়াস’ শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক হিসেবে টরন্টো টিমের সাত জনের নাম উল্লেখ করলেন ম্যাক্লাউড। বান্টিঙ, বেস্ট, কলিপ, ম্যাক্লাউড ছাড়াও সহলেখক হিসেবে ক্যাম্বল, ফ্লেচার ও নোবেলের নামও উল্লেখ করলেন তিনি। স্থির হলো, ওই সভায় ম্যাক্লাউডই পাঠ করবেন নিবন্ধটা।
৩রা মে’র সেই সভায় অবশ্য যোগ দেন নি বান্টিঙ বা বেস্ট। মনে করা হয়, ম্যাক্লাউডের সাথে মানসিক দূরত্বের কারণেই ওয়াশিংটনের সেই সভায় যেতে চান নি বান্টিঙ বা বেস্ট। তাছাড়া, ম্যাক্লাউডের সাহায্য ছাড়াই তো এখন দিব্যি চলছে তাঁদের ক্লিনিক। তাতে অবশ্য মোটেও বিচলিত হন নি ম্যাক্লাউড। চিরাচরিত সাবলীল ভঙ্গিতেই সেই সভায় সেই প্রবন্ধ পাঠ করলেন তিনি। এই প্রবন্ধেই প্রথমবার ‘ইনসুলিন’ শব্দটা সর্বসম্মতিক্রমে ব্যবহার করলেন টরন্টো টিমের সদস্যরা। সভায় ম্যাক্লাউড ঘোষণা করেন, ইনসুলিন এখন আমাদের করায়ত্তে। ইনসুলিন প্রস্তুতি, পরিশোধন ও প্রয়োগে সফল আমরা। ইনসুলিনের সাফল্যের এই খবর শুনে, আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, করতালি দিয়ে, আবিষ্কার ও আবিষ্কর্তাদের স্বাগত জানান অভ্যাগতরা। এ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় এভাবে ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’, এক বিরল ঘটনা বলেই মনে করেন অভ্যাগতরা।
ওয়াশিংটনের এই সভার পর সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে যায় নবজাতক ইনসুলিনের মাহাত্ম্যের কথা। তাকে করতালি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছেন সবাই। এখন সেই নবজাতকের স্পর্শ পেতে আগ্রহী প্রত্যেকেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের চিকিৎসকরা ইনসুলিন পাঠানোর আর্জি জানাতে থাকেন। ফলে হুহু করে বাড়তে থাকে ইনসুলিনের চাহিদা। টরন্টো টিমের সদস্যরা মনে করেন এই সমস্ত চিকিৎসকদের চাহিদা মতো ইনসুলিনের নমুনা পাঠানো বিশেষ জরুরি। এতে ইনসুলিনের কার্যকারিতাটাও যেমন যাচাই হবে তেমনই রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন রোগীরাও। সেই মতো বিশিষ্ট ডায়াবিটিস চিকিৎসকদের কাছে ইনসুলিনের নমুনা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করলো কনট ল্যাব। কিন্তু এই দু’একটা স্যাম্পল দিয়ে কি আর চিকিৎসা চালু রাখা সম্ভব? ম্যাক্লাউড বুঝলেন চাহিদা যে পরিমাণে বেড়ে চলেছে, সীমিত পরিকাঠামোর ল্যাবে তাকে সামাল দেওয়া মুশকিল। এবার বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদনের কথা না ভাবলেই নয়। যদিও মলোনি ইদানীং বৃহৎ পরিসরে ইনসুলিন উৎপাদনে অনেকটাই সফল হয়েছেন, তবে সারা বিশ্বকে ইনসুলিন সরবরাহ করা কনট ল্যাবের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়।
গত ৩০শে ডিসেম্বরের ইউএসএর ন্যু হাভেনের সভায় ম্যাক্লাউডের যখন ইনসুলিন নিয়ে গবেষণার কথা প্রথম বারের মতো ঘোষণা করেছিলেন তখন থেকেই বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা, বাণিজ্যিক ভাবে ইনসুলিন প্রস্তুতির জন্য আগ্রহ দেখাতে শুরু করে ছিলেন। দু’তিনটে সংস্থা তো টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগও করেছেন ইতিমধ্যে। ম্যাক্লাউড, বান্টিঙের সাথে ব্যক্তিগত স্তরেও যোগাযোগ রেখে চলেছেন কেউ কেউ। ১০ লাখ কানাডিয়ন ডলার ও বার্ষিক ৫% রয়েলটির প্রস্তাব নিয়ে বান্টিঙের কাছে হাজির হয়েছিল এক ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা। বান্টিঙ এবং ম্যাক্লাউড, উভয়েই সবিনয়ে খারিজ করে দিয়েছিলেন সেই সব প্রস্তাব।
৩রা মে ১৯২২, ওয়াশিংটনের সভায় পঠিত প্রবন্ধের প্রথম পাতার অংশ। |
কিন্তু ৩রা মে’র এই সভার পর, পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। ইনসুলিনের চাহিদা যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোকে এখন আর না বলা যাচ্ছে না। তাহলে এখন কি করা উচিৎ? কাকে দেওয়া যেতে পারে ইনসুলিন প্রস্তুতির ভার? আলোচনায় বসলেন টরন্টো টিম। আমরা জেনেছি, জানুয়ারি মাসেই বান্টিঙ, বেস্ট ও কলিপের নামে ইনসুলিনের পেটেন্ট করানো হয়েছিল। তাই আজ যা বলার বা যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই তিনজনকেই নিতে হবে। বান্টিঙ, বেস্ট ও কলিপ সহমত হয়ে জানান, কোনো লভ্যাংশ চান না তাঁরা, তাঁরা চান রোগীরা যেন স্বল্পমূল্যে ইনসুলিন কিনতে পারেন। আর সেই শর্ত মাথায় রেখেই ওষুধ কোম্পানিগুলোকে আহ্বান করা হোক। তবে কোন ওষুধ কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিক টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ই। প্রয়োজনে, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁদের স্বত্ব বিক্রি করতেও রাজি আছেন তাঁরা। মে ১৯২২, বান্টিঙ, বেস্ট ও কলিপ, প্রত্যেকে ১ কানাডিয়ন ডলারের [মোট ৩ কানাডিয়ন ডলার] বিনিময়ে ইনসুলিনের সমস্ত স্বত্ব হস্তান্তর করেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়কে। তাঁদের বক্তব্য, এবার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক করুন, কাকে দিয়ে বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদন করানোটা শ্রেয় হবে। (চলবে)
[৩৪] ১৯১৯ সালে নির্মিত হয় ‘ক্রিস্টি স্ট্রিট মিলিটারি হসপিটাল’। ১৯৩৬ সালে হাসপাতালটার নাম পরিবর্তন করে ‘ক্রিস্টি স্ট্রিট ভেটারান হসপিটাল’ রাখা হয়। ১৯৪৮ সালে এই হাসপাতালটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার বদলে টরন্টোর উত্তর দিকে ‘সানিব্রুক হেলথ সায়েন্স সেন্টার’ চালু করা হয়।
[৩৫] ন্যু ইয়র্ক শহরের প্রাক্তন গভর্নর [মেয়র] (১৯০৭-১৯১০) চার্লস ইভান্স হিউজেস (১৮৬২-১৯৪৮) ১৯১৬ সালে ইউএস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। তাঁকে পরাজিত করে সেই বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন উডরো উইলসন। ১৯২১ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত ইউএসএর স্বরাষ্ট্র সচিব পদে আসীন ছিলেন হিউজেস। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ইউএসএর প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন তিনি।
[৩৬] ১৭ই অগস্ট ১৯২২ সালে এলিজাবেথকে (১৯০৭-১৯৮১) প্রথম ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেন বান্টিঙ। নিয়মিত ইনসুলিন নিয়ে আরও ৫৮ বছর বেঁচে ছিলেন এলিজাবেথ। এই ৫৮ বছরে ৪২,০০০ এরও বেশি বার ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিয়ে ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৩ বছর বয়সে যখন মারা যান এলিজাবেথ, ৭ নাতিপুতি সহ ভরা সংসারের অধিকারিণী ছিলেন তিনি তখন। ‘গ্লোরি এনাফ ফর অল’ ফিল্মে বান্টিঙের সমান্তরাল ভাবে উপস্থিত আছেন এলিজাবেথ ইউজেস।