স্মৃতি কি সততই সুখের? না মনে হয়। এমন কিছু স্মৃতি থাকে যেগুলো পারলে সব ডাক্তারবাবুই নিজের স্মৃতির পাতা থেকে ডিলিট করে দিতে চাইবেন।
আমার শহরের এক শ্রদ্ধেয় গায়নাকোলজিস্ট তাঁর ভাইঝির ডেলিভারি করাতে গিয়েছিলেন নিজের হাতে। মেয়েটির অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড এম্বোলিজম হয়েছিল। মাতৃগর্ভে শিশুকে ঘিরে এই রস থাকে। ডেলিভারির সময় মায়ের রক্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এই রস। প্রায় একলাখ ডেলিভারি পিছু একটা ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ঘটে। কিছু করার ছিল না ডাক্তারবাবুর। ভাইঝি মারা গিয়েছিল। কিন্তু পরিবারের বাকি সবাই আজও ভাবে সেই গায়নাকোলজিস্ট ইচ্ছে করে মেয়েটিকে মেরে ফেলেছেন। আজও প্রতিদিন তাঁর হাত দিয়ে নতুন শিশু জন্মানোর মাঝে স্মৃতি একটু করে মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়ে যায় তাঁকে। উনি বলেছিলেন যে এর থেকে আদালত যদি কাঁটাছেড়া করে জানিয়ে দিতো নিয়তির কাছে ডাক্তারও অসহায় তাহলে হয়তো তাঁকে আত্মীয়পরিজনদের চোখে এইরকম দোষী হয়ে বাঁচতে হতো না। তিনি ডাক্তারদের দোষত্রুটির বিচার বা কনজিউমার প্রটেকশন অ্যাক্টের পক্ষে।
অবশ্য অধিকাংশ ডাক্তারদের সাথে বসলে কনজিউমার প্রটেকশন অ্যাক্টের বিপক্ষে বলার মতো অনেক তথ্য উঠে আসবে। আবার ট্রেনে বাসে চড়লে এবং সেখানকার চলন্ত আলোচনায় অংশ নিলে মনে হয় ডাক্তারগুলো একেকটা কসাই। সব ব্যাটাকে শূলে চড়ানো উচিত। কিছু কিছু গল্প এমন শিহরণ জাগানো যে মনে হয় রজনীকান্তকে নায়ক করে সাউথের কোনো সিনেমা। তবু গল্পগুলো চলে। যেমন কিডনি বিক্রির গল্প।
অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের নাম করে কিডনিটাই কেটে নিয়েছে। বহরমপুরের এক রোগী এসেছিল হাসপাতালে। সঙ্গে আমার এক চেনা উকিল সাহেব। ওখানকার এক নার্সিংহোমে রোগী বছর কয়েক আগে অপারেশন করায়। আবার পেটে ব্যথা হওয়ায় আলট্রাসোনোগ্রাফি করে জানা যায় তার ডানদিকের কিডনি নেই। কেলেঙ্কারির একশেষ। উকিল সাহেব বৃষ্টিধারার মতো অনেকগুলো ধারা ঝরঝর করে আমার সামনে ঢেলে দেন। তাকে অনেক কষ্টে বোঝাতে পারি যে রোগীর জন্ম থেকেই একটা কিডনি নেই আর সেই ডাক্তার মোটেই অ্যাপেন্ডিক্সের ওই ছোট কাটা দিয়ে কিডনি চুরি করার মতো পরিশ্রমের কাজ করবেন না। “আপনি কি আমার পাশের বাড়ির কোনো জিনিস চুরি করতে গিয়ে আমার বাড়ির সিঁধ কাটবেন?” তুলনাটা মনঃপূত হওয়ায় বেচারা ডাক্তার বেঁচে গিয়েছিল। তবে কিডনি চুরির জাল যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে- সেই বক্তব্যের প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি। উকিলদের সাথে কে কবে তর্কে পেরে উঠেছে? আমি মিনমিন করে যোগ করেছিলাম “হার্ট, লিভার, স্প্লিন, ব্রেন সবই চুরি যায়। তবে হার্ট বা হৃদয় চুরি যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার সাক্ষী আছি আমি।” রবি ঠাকুরও তো ইঙ্গিতে বলে গেছেন -“প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,/কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে।” হৃদয় চুরি খুব উচ্চমানের চুরি, রসিক মানুষেরা বলে। ফলে, কিডনি চুরিও বাদ যায় কেন?
আর মাঝেমধ্যেই যে ডাক্তারদের নিয়ে গল্পের গরুটা গাছের মগডালে উঠে লেজ নাড়ায় তার প্রমাণ তো আমরা নোটবন্দীর সময় পেয়ে গেছি। এক সিনিয়র গায়নাকোলজিস্টের হার্ট-অ্যাটাক হলো, একজন সার্জেনের বাড়ির দেওয়াল খুঁড়ে বিজয় মাল্যকে টেক্কা দেওয়ার মতো সম্পত্তি পাওয়া গেলো, শহরের বেশ কয়েকজন নামকরা ডাক্তারকে কোমরে দড়ি বেঁধে ইনকাম ট্যাক্স অফিসাররা ধরে নিয়ে গেলো। “আমার বন্ধুর বন্ধু নিজের চোখে দেখেছে” বলার মতো উইটনেসও প্রচুর মিললো। একদিন এক বৃদ্ধা বেশ আন্তরিকতার সাথে আমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল “জেলে বেশি মারধোর করেনি তো?” তার সহানুভূতিতে আমি ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের মতো কঠিন বাংলা শব্দের উৎপত্তি এভাবেই হয়েছিল বোধহয়।
এখন যেমন প্রায়শই ফোনে লোকে জিজ্ঞাসা করে আমার করোনা হয়েছে কিনা। “না” বললে অনেকেই বিশ্বাস করে উঠতে চায়না। আমার থেকে অনেক বিশ্বাসযোগ্য কারো মুখ থেকে তিনি আমার করোনার খবর জেনেছেন। ইদানিং কাউকে হতাশ না করে জবাব দিই – “এখন ভালো আছি।”
ডাক্তারদের নিয়ে আইন আদালত বিষয়ক আলোচনা বড্ড একপেশে হয়ে যাবে। সেটা কিছুটা অন্যায়ও বটে। আমি একজন চিকিৎসক, সেহেতু ডাক্তারদের দোষত্রুটির সাফাই দেওয়ার অনেক অস্ত্র আমার হাতে আছে। হয়তো চিকিৎসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটার যন্ত্রণা সেইভাবে বলতে পারবোনা। সন্তানহারা মা, সঙ্গী হারানো জীবন , মাথায় ছাতা ধরে রাখা গুরুজন হারানো মানুষের দিকগুলো না-বলা থেকে যাবে। তাঁরা তো আদালতের দ্বারস্থ হবেনই। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই সেটা হোক।
আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ডাক্তার নিগ্রহ বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জিনিসপত্র ভাঙচুর করা মোটেই কাজের কথা নয়। এইসব বন্ধ করার জন্য কড়া কিছু আইন আছে। অবশ্য আইন না মানাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন। আমাদের দেশটা তো “শিব ঠাকুরের আপন দেশ” – আইনকানুন সর্বনেশে হবেই।
একজন সিনিয়র ডাক্তার বলছিলেন যে সমস্ত ভালো ডাক্তারের বিরুদ্ধেই কিছুনা কিছু “কেস” চলছে। যে যতো বড়ো ডাক্তার, তার কেসের সংখ্যা ততো বেশি। কেসের চমকও থার্ডপেজে দেওয়ার মতো মুচমুচে। কয়েকমাস আগে এক প্রণম্য এবং বয়োজ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল। তাঁর ছাত্রছাত্রী এবং সহকর্মীরা জানেন কতটা অবাস্তব সেই অভিযোগ। তবু তাঁকে জেল খাটতে হয়েছিল।
একটা গলব্লাডার অপারেশনের সময় লক্ষ্য করি ফান্ডাস অর্থাৎ মাথার দিকটা বেশ শক্ত। সন্দেহ হয় ক্যান্সার হতে পারে। গলব্লাডারের সাথে লিভারের কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে পরীক্ষা করতে পাঠাই। রিপোর্ট আসে ক্যান্সার। আমি মুম্বাইয়ের ক্যান্সারের হাসপাতালে রোগীকে রেফার করি। তারা স্লাইড আবার দেখে মতামত দেয় ক্যান্সার নয়। কোনো কারণে তারা আবার পেট খুলে লিভার থেকে টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করে। সেটাতেও ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ নেই। খুব ভালো কথা। রোগীর বাড়ির লোক প্যাথলজিস্টের বিরুদ্ধে কেস করে এবং আমাকেও পার্টি করে।
একদিন গভীর রাতে অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন আসে। যে প্যাথলজিস্ট বায়োপসি করেছিলেন, তাঁর ফোন। পরিচয় দিতে বুঝতে পারলাম যে তিনি একজন সিনিয়র প্যাথলজিস্ট। তিনি সেই গভীররাতে মাইক্রোস্কোপের তলায় সেই স্লাইডটা আবারও দেখছেন। “খুব আর্লি স্টেজে ক্যান্সারটা রয়েছে। আমাকে যদি একবার মুম্বাইয়ের ওই প্যাথলজিস্টের সাথে বসানো যায়…” তাঁর গলায় আকুতি ঝরে পড়ে। বৃদ্ধকে বোঝাতে পারলাম না যে বিচারকদের মধ্যে কোনো চিকিৎসক থাকেনা। কোনো চিকিৎসক-বিচারক ছাড়া তাঁর আর্তিতে কেউ কান দেবেনা।
“তুমি বোধহয় লিভারের কিছুটা অংশ বাদ দিয়েছিলে, তাই সে আজ বেঁচে থেকে আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারছে। তোমার উচিত ছিল একটু বায়োপসি নিয়ে ছেড়ে দেওয়া।”
তাই তো করা উচিত। বইয়েতেও তো তাই লেখা আছে। অপারেশন চলাকালীন যদি মনে হয় খারাপ কিছু, তাহলে একটু টিস্যু নিয়ে আর না এগোনো। বা ডাক্তারি ভাষায় ক্যালোট’স ট্রায়াঙ্গেল খারাপ থাকলে পার্শিয়াল কোলেসিস্টেকটমি করা। কিন্তু সেক্ষেত্রে মূল্যবান সময়গুলো হারিয়ে যায়।
ঠেকে শেখা – সে ভুল হোক আর ঠিক হোক। আর বোধহয় কোনোদিন ভুল করে ঠিক কাজ করতে মন চাইবে না।
খুব ভালো লেখা৷ আমাদের কত অসচেতনতা আছে, সেটা বুঝি এই লেখা থেকে৷ ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা ড.অনির্বাণ জানাকে৷
আপনার লেখনী আমাকে অনেক নতুন শিক্ষা দেয় । আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ Sir? ??
খুব ভালো লেখা । আমরা সত্যি ঘটনা না জেনে অনেক সময় ডাক্তার বাবু দের ভূল বুঝি কিন্তু এটাও ঠিক যে সব ডাক্তার বাবু রা কিন্তু আপনার মতো নয়, আপনার মতো মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ খুব কমই হয় ।
কোনো ডাক্তার কি চায় যে তার রোগীর ক্ষতি হোক।
আর এই করোনা র বাজারে সব কিছুর দাম তিনগুণ বাড়লেও প্রায় কোনও প্রাইভেট ডাক্তারের ফি বাড়েনি
মন ছুঁয়ে গেল লেখাটা। কিছু নার্সিং হোম এর জন্য আজ অনেক ডাক্তারের সম্মান হানি হয়।
কিন্তু সব মানুষ সমান নয়। আজও ডাক্তারদের next to God ভাবে বহু লোক।
ভালো থাকিস।