সম্প্রতি ন্যাশানাল মেডিকাল কমিশন নির্দেশ দিয়েছেন–সমস্ত রেজিস্টার্ড মেডিকাল প্র্যাকটিশনারকে জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করতে হবে, নির্দেশ উল্লঙ্ঘনকারীদের জন্য শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টা নতুন নয়।
২০০২-এ মেডিকাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া তার কোড অফ এথিক্সে নির্দেশ দেয়—‘প্রত্যেক চিকিৎসকের যথাসম্ভব জেনেরিক নামে ওষুধ লেখা উচিত, তাঁর নিশ্চিত হওয়া উচিত যাতে তাঁর প্রেসক্রিপশন ও ওষুধের ব্যবহার যুক্তিসঙ্গত হয়।‘ পশ্চিমবঙ্গ মেডিকাল কাউন্সিল তার কোড অফ এথিক্সে এই নীতিটা বাদ দিয়েছিল। ২০০৫-এ তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার নির্দেশনামা জারি করে সরকারী ডাক্তারদের জেনেরিক নামে ওষুধ লেখা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। অধিকাংশ সরকারী সরকারী ডাক্তার অবাধ্য থেকে যান।
২০১২-র ফেব্রুয়ারী মাসে আবার উদ্যোগ নেয় তৃণমূল সরকার, প্রথম পর্যায়ে মেডিকাল কলেজ, আর জি কর মেডিকাল কলেজ ও ন্যাশানাল মেডিকাল কলেজে জেনেরিক নাম ব্যবহার করার আদেশ দেওয়া হয়।
২৭শে মে, ২০১২ আমির খানের রিয়ালিটি শো ‘সত্যমেব জয়তে’-র চতুর্থ এপিসোডে দেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার স্বাস্থ্যোদ্ধারের অন্যতম উপায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জেনেরিক নামের ওষুধের ব্যবহারকে।
২০১৭-র ১৭ই এপ্রিল সুরাটের এক দাতব্য হাসপাতাল উদ্বোধন করতে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নিজের ভাষণে তিনি বলেন—ডাক্তারদের এবার থেকে ওষুধের জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করতে হবে রোগীরা যাতে দামী ব্র্যান্ড কিনতে বাধ্য না হন। প্রেসক্রিপশন লিখতে হবে ব্লক ক্যাপিটাল অক্ষরে, পড়তে যাতে অসুবিধা না হয়। ২১শে এপ্রিল মেডিকাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এম সি আই) নির্দেশ দিল—সমস্ত চিকিৎসককে ওষুধ লেখার সময় জেনেরিক নামে স্পষ্ট অক্ষরে (বড় অক্ষর অর্থাৎ capital letters-এ হলে ভাল হয়) লিখতে হবে। তাঁদের প্রেসক্রিপশন ও ওষুধের ব্যবহার যেন যুক্তিসঙ্গত হয়। রেজিস্টার্ড ডাক্তাররা এই নিয়ম না মানলে তাঁদের বিরুদ্ধে স্টেট মেডিকাল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেবে।
দেখা যাক, সাধারণ মানুষের কতোটা কাজে লাগবে ন্যাশানাল মেডিকাল কমিশনের জেনেরিক প্রেসক্রিপশনের দাওয়াই।
প্রথমেই বলে নি আমি নিরপেক্ষ নই, আমি জেনেরিক নাম ব্যবহারের পক্ষে।
ওষুধের আসলে তিনটে নাম—
- প্রথম নামটি পুরো রাসায়নিক নাম, যা কাজে লাগে রসায়নবিদদের।
- দ্বিতীয় নামটি জেনেরিক নাম, এই নাম ব্যবহার করা হয় ওষুধ-বিজ্ঞান সহ চিকিৎসাবিদ্যার অন্যান্য শাখার আলোচনায়। জেনেরিক নামের আসল অর্থ গোত্র নাম, জেনেরিক নাম বলতে ওষুধের ক্ষেত্রে কিন্তু ওষুধের একটি গোত্র বা গোষ্ঠীর (এক ধরনের কিছু ওষুধের) নাম না বুঝিয়ে একটি ওষুধের নাম বোঝানো হয়। তাই জেনেরিক নামের বদলে বলা উচিত আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম (International Nonproprietary Name) ।
- তৃতীয় নামটি হল ব্র্যান্ড নাম বা বাণিজ্যিক নাম। একটি ওষুধের বাণিজ্যিক নাম অবশ্য একটি নয়। একই ওষুধকে আলাদা আলাদা ওষুধ-কোম্পানী আলাদা আলাদা নাম দেয়।
আমরা আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম ব্যবহারের পক্ষে কেন না,
- কেবল আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নামই ওষুধবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইপত্রে, জার্নালগুলোতে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশনাগুলোতে ব্যবহৃত হয়।
- বাজারে একাধিক ওষুধের মিশ্রণে তৈরী প্রচুর ফর্মুলেশন (Fixed Dose Combinations) পাওয়া যায়, যেগুলোর অধিকাংশই অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়। আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম ব্যবহার চালু হলে ওষুধ কোম্পানীগুলো বেশী সংখ্যায় একক ওষুধের ফর্মুলেশন উৎপাদন ও বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
- ওষুধের আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম দেখে সেটা কোন ধরণের ওষুধ বোঝা সহজ হয়। একই ওষুধের নানান ব্র্যান্ড নামে মিল থাকে না, ফলে বিভ্রান্তি তৈরী হয়। এই বিভ্রান্তিও হয় না আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম ব্যবহারে।
- দেখা যায় আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নামের ওষুধগুলোর দাম সাধারণভাবে সেই ওষুধেরই ব্র্যান্ডগুলোর চেয়ে অনেকটা কমদামী।
- কেবল আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম ব্যবহার করা হলে ডাক্তারদের অল্প কিছু নাম মনে রাখলেই হয়, একগাদা ব্র্যান্ড নাম মনে রাখতে হয় না।
- আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম ব্যবহৃত হলে জাতীয় অত্যাবশ্যক ওষুধের তালিকা তৈরী করা সহজ হয়।
- আন্তর্জাতিক অব্যবসায়িক নাম চললে ব্র্যান্ডের প্রচার-প্রসার করতে হয় না, খরচ কমে, ওষুধের দামও কমে।
- ওষুধের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসাকর্মীদের ধোঁয়াশা কাটে।
আমরা ব্র্যান্ড নামের বিপক্ষে কেন না অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি বিভ্রান্তিকর। আমাদের দেশে উৎপাদিত বস্তুর পেটেন্ট স্বীকৃত নয়, উৎপাদন-পদ্ধতির পেটেন্ট স্বীকৃত। এই কারণে কোন ওষুধের কোন মালিক নেই, মালিকানা কেবল ওষুধ তৈরীর পদ্ধতির। একই ওষুধ একাধিক কোম্পানী আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে তৈরী করতে পারে। ওষুধের কোন ব্র্যান্ড নাম এক অর্থে কোন একটি কোম্পানীর সম্পত্তি। কিন্তু সেখানেও কথা আছে—বেশীর ভাগ ব্র্যান্ড নামই কিন্তু নথিভুক্ত করা নয়, কেন না আমাদের দেশে নাম নথিভুক্তিকরণের প্রক্রিয়া খুব জটিল ও তাতে দীর্ঘ সময় লাগে। যে ব্র্যান্ড নামগুলি নথিভুক্ত নয়, যে কেউই সে নাম ব্যবহার করতে পারে। নথিভুক্ত ব্র্যান্ড নামগুলিও আবার অন্য শ্রেণীর পণ্যের জন্য ব্যবহার করা যায়। এর ফলে বিভ্রান্তির শেষ নেই।
১। একই ব্যান্ড নামে পাওয়া যেতে পারে আলাদা শ্রেণীর ওষুধ
২। কিছু ব্র্যান্ড নাম আবার এতোটাই এক রকম যে গন্ডগোল হয়ে যায়।
৩। একই কোম্পানী আবার নিজেদের উৎপাদিত আলাদা ওষুধের এতোটাই একরকম নাম দেয় যে গুলিয়ে যায়।
ব্র্যান্ড নামের ওষুধের দাম সাধারণত সেই ওষুধের জেনেরিকের তুলনায় বেশি হয় কেন না, কোম্পানী নিজের ব্র্যান্ডকে পরিচিত করানোর জন্য প্রচার করে, সেই প্রচারের খরচ তোলে রোগীর পকেট কেটে ওষুধের দামে। তাই একই ওষুধ একেক কোম্পানীর ব্র্যান্ডে একেক রকম দাম। যে প্যারাসিটামলের ৫০০ মিগ্রা-র ট্যাবলেট এলবার্ট ডেভিড Parazine নামে বিক্রি করে একেকটা ১৫ পয়সা দামে, ফার্মা সিন্থ ফর্মুলেশন্স লিমিটেড Paranova নামে তা বিক্রি করে একেকটা ৫ টাকা ৯০ পয়সায়। প্রথম ব্র্যান্ডটার তুলনায় পরের ব্র্যান্ডটার দাম প্রায় ৪০ গুণ!
অনেকে মনে করেন কোম্পানী যখন ব্র্যান্ড নামকে পরিচিত করানোর জন্য এত পয়সা খরচ করেছে তখন সে ওষুধের গুণবত্তার সঙ্গে আপস করবে না। ডাক্তাররাও অনেকে এমনটা বিশ্বাস করেন, তাই দেখি জেনেরিক নামের বিরুদ্ধে ও ব্র্যান্ড নামের সপক্ষে জনমত তৈরী করতে তাঁরা নেমে পড়েন। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায় বহুল পরিচিত অনেক ওষুধ কোম্পানী ও ওষুধের ব্র্যান্ড মুনাফার লক্ষ্যে গুণবত্তায় আপস করে। গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা যে সব ক্লিনিক বা হাসপাতাল চালান সেগুলির এবং সরকারী ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলির অভিজ্ঞতা থেকে জোরের সঙ্গেই বলা যায় জেনেরিক নামের ওষুধ ও তার নানান ব্র্যান্ডের কার্যক্ষমতায় কোন ফারাক নেই।
আরেকটা ব্যাপার অনেকেই খেয়াল করেন না। ওষুধের মোড়কের পিছনে ‘manufactured at’ আর ‘marketed by’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলাদা কোম্পানী। এমনটা সম্ভব হয় আমাদের দেশের ওষুধ ও প্রসাধনী আইনে ‘loan licence’ –এর প্রথা থাকার ফলে। ওষুধ নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে লোন লাইসেন্স নিয়ে এক কোম্পানী অন্যের কোম্পানীতে ওষুধ তৈরি করাতে পারে। ফলে নামী কোম্পানীর দামী ব্র্যান্ড বলে আমরা যে ওষুধ কিনি, তার অধিকাংশই এমন অনামী কোম্পানীতে তৈরি যারা জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে।
কিন্তু জেনেরিক নামের ওষুধ বাজারে পাওয়াই যায় না
মমতা ব্যানার্জী-নরেন্দ্র মোদী ডাক্তারদের নির্দেশ দিচ্ছেন জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার জন্য। কিন্তু জেনেরিক নামে আজকাল ওষুধ উৎপাদিতই হয় না। বড় বড় ওষুধ কোম্পানীগুলোর জেনেরিক ডিভিশনও আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের উৎপাদিত ওষুধে ব্র্যান্ড নাম দেয়, এদের বলা হয় ‘ব্র্যান্ডেড জেনেরিক্স’। জেনেরিক নামের প্রেসক্রিপশনে দোকানী তাঁর ইচ্ছা মতো ব্র্যান্ডেড জেনেরিক ওষুধ দেন। স্বভাবতই যে ব্র্যান্ডের ওষুধে তাঁর লাভ বেশী সেটাই তাঁর পছন্দের ওষুধ হয়।
স্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখা হোক এমনটা আমরাও চাই
অনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তাঁরা এমন দুর্বোধ্য হাতের লেখায় প্রেসক্রিপশন লেখেন যে বিশেষ ওষুধের দোকানী ছাড়া অন্য কেউ তা পড়তে পারেন না। ডাক্তাররা আবার স্পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন না লেখার পেছনে সময়াভাবকে কারণ দেখান। ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে এম সি আই স্পষ্ট অক্ষরে, সম্ভব হলে ব্লক ক্যাপিটালে ওষুধ লেখার কথা বলার পর থেকে, পশ্চিমবঙ্গে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ পরিচালিত ১১টি জনস্বাস্থ্য কর্মসূচীতে ডাক্তাররা ব্লক ক্যাপিটালে ওষুধের নাম লেখা শুরু করেন। দেখা গেছে তাঁদের অতিরিক্ত অনেকটা সময় লাগছে এমন নয়। বরং ওষুধ ডিস্পেন্সিং-এ ভুল অনেক কমে গেছে।
সরকার যদি মানুষের কল্যাণ চায়
তাহলে ডাক্তারদের জেনেরিক প্রেসক্রিপশন করতে বাধ্য করার পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানীগুলিকে বাধ্য করুক ব্র্যান্ড নামে ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করতে। ব্র্যান্ড নাম না থাকলে ওষুধের দাম এমনিতেই অনেক কমে যাবে।
সরকার যদি চায় ডাক্তাররা যুক্তিপূর্ণ প্রেসক্রিপশন লিখুন, ওষুধের যুক্তিপূর্ণ ব্যবহার করুন, তাহলে—
- সমস্ত অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন বন্ধে কোম্পানীগুলিকে বাধ্য করুক।
- রোগী কোন সমস্যা নিয়ে এলে, কোন কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে, কোন ওষুধ লেখা হবে, কখন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হবে, তা নির্দিষ্ট থাকুন প্রামাণ্য চিকিৎসা বিধি বা standard treatment guidelines-এ।
- ওষুধ যাঁরা লেখেন তাঁদের ওষুধ সম্পর্কিত বিশদ তথ্য জানাতে থাকুক drug formulary।
এই পদক্ষেপগুলি ছাড়া ন্যাশানাল মেডিকাল কমিশনের নির্দেশে মানুষের কোনও লাভ হবে না।
খুব প্রয়োজনীয় এবং প্রাসঙ্গিক লেখা।