যাঁরা নেটফ্লিক্সে ‘দ্য গুড ডক্টর’ সিরিজটা দেখেছেন তাঁরা সবাই ডক্টর শন মার্ফিকে নিশ্চই চেনেন। তিনি একজন অটিস্টিক যুবক যিনি স্যান জস্ হাসপাতালের সার্জিক্যাল রেসিডেন্স। তিনি রুগিদের সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারেন না বা সমস্যা বুঝিয়ে বলতে পারেন না কিন্তু একজন সার্জেন ও ডাক্তার হিসেবে তিনি অসম্ভব দক্ষতার অধিকারী। রুগির দেহের সমস্যা তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুলেট কোথা দিয়ে ঢুকে ঠিক কোন রক্তনালিকে ছিন্ন করে চলে গেছে সেটা তিনি মনশ্চক্ষে দেখতে পারেন। তাঁর সার্জিক্যাল স্কিলও সাঙ্ঘাতিক। যেন এক ফোটোগ্রাফিক মেমরি দিয়ে তিনি সব সার্জারির ধাপগুলো নিখুঁতভাবে মনে রেখে দিয়েছেন। আপনি সেই সিরিজ দেখলে তাঁকে নিঃসন্দেহে একজন জিনিয়াস বলেই মনে করবেন।
অটিজমে আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে যদিও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ স্বাভাবিক বা অনেক বেশি বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হতে পারেন কিন্তু একথা ঠিক শন মার্ফির মত তেমন কোনো ডাক্তারের কথা আমি এখনও শুনি নি। হয়ত সেটা ‘সিনেম্যাটিক জাস্টিস’। তবে মানসিক ব্যধির শিকার হয়েও নিজেদের সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরাট নজির রেখে যাবার ঘটনা ইতিহাসে একেবারেই দুর্লভ নয়। উলটে তাঁদের সংখ্যা এতই বেশি যে অনেকে মনে করেন জিনিয়াসের সাথে মানসিক ব্যধির নিশ্চই কোনো নিবিড় যোগ আছে। এই নিয়ে তাই অনেক গবেষণাও হয়েছে।
আমাদের সাথে ডাক্তারিতে দেবব্রত একসাথে পড়ত। ওর বাড়ি ছিল কাঁকিনাড়ায়। ও এবং ওর বাড়ির অনেকে স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিল। দেবু ছিল আমার দেখা প্রথম জিনিয়াস। ওকে নিয়ে একটি গল্পও লিখেছিলাম। আমার দ্বিতীয় ছোটগল্পের বইটিতে তা সংকলিত আছে। অসম্ভব অন্তর্মুখী এবং অন্যান্য স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের অনেকের মত ডিলিউশনে ভুগত। ওর আক্রমণের কেন্দ্রে ছিলেন ওর বাবা। ও তাকে ‘আমেরিকার গুপ্তচর’ বলে মনে করত।
আপনারা নিশ্চয়ই ‘গেম থিওরির’ আবিষ্কর্তা নোবেল বিজেতা আমেরিকান গণিতজ্ঞ জন ন্যাশের নাম শুনেছেন। যাঁকে নিয়ে বিখ্যাত ‘দ্য বিউটিফুল মাইন্ড’ ছবিতে রাসেল ক্রো ন্যাশের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ন্যাশ প্যারানয়েড ছিলেন। তিনি মনে করতেন লাল টাই পরা যে কোনো ব্যক্তিই আসলে রাশিয়ার গুপ্তচর। তারা তাঁকে অনুসরণ করে চলেছে। ন্যাশ তাঁর এমন মানসিক ব্যধি নিয়েও নোবেল পেয়েছেন।
আমাদের দেবব্রত ডাক্তারি পাশ করে ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। ওর কথা আগে আপনাদের বলেছি। ও দুই হাত দিয়েই লিখতে পারত। অ্যারামাইক এবং আরবির মত ডানদিক থেকে বাঁদিকে লিখত মাঝেমাঝে। আমার এখনও ওর অ্যানাটমি পরীক্ষা দেবার কথা মনে আছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে ও সারা শরীরের লসিকা সংবহনতন্ত্র এমনভাবে বলে যাচ্ছে যেন সামনে ছবি দেখতে পারছে। ঠিক যেমন ডক্টর শন মার্ফি দেখতে পায়। পরীক্ষক তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু দেবব্রত তার উপযুক্ত জায়গায় পৌঁছতে পারে নি। হয়ত তেমন মেন্টর পেলে পারত। শুধু দেবব্রত নয়, প্রায় প্রতি ব্যাচের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই এমন কেউ না কেউ থাকে। যারা জিনিয়াস বা তার কাছাকাছি কিন্তু তাদের মধ্যে কতজন আমাদের দেশে তেমন উন্নতি করতে পারে, তাদের প্রতিভার প্রকাশ করতে পারে এটা একটা খুব মৌলিক প্রশ্ন।
আধুনিক বিজ্ঞানের কথা বললে যার নাম প্রথমেই আসে তিনি নিউটন। আমরা নিউটনের সাথে তাঁর কুকুর ডায়মন্ডের গল্পটি প্রায় সবাই জানি। ডায়মন্ড তাঁর সব ম্যানুসক্রিপ্টের ওপর মোমবাতি ফেলে দিলে তাঁর সবটাই পুড়ে খাক হয়ে যায়। নিউটন তাই দেখে একটুও না রেগে তাঁর কুকুরটিকে কোলে নিয়ে বলেন, ডায়মন্ড তুমি জান তুমি কী করেছ? ছোটবেলায় এই গল্প পড়ে আমার নিউটনকে খুব সংবেদনশীল একজন মানুষ বলেই মনে হত। কিন্তু পরে জেনেছি তিনি সম্ভবত অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন। বাই পোলার ডিসঅর্ডারের রুগি ছিলেন সারাজীবন। অসম্ভব অন্তর্মুখী ও বদমেজাজি মানুষ ছিলেন। নিজের সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। এডমন্ড হ্যালি ছাড়া বিজ্ঞানী মহলে তাঁর সেরকম বন্ধুবান্ধব কেউ ছিলেন না।
শুধু তাই নয় সূর্যের রশ্মি পরীক্ষা করবেন বলে তিনি ঠায় খালি চোখে সূর্যের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ২৭। এতে তাঁর চোখের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারত। ভাগ্য ভাল হয় নি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ তাকে অন্ধকার ঘরে কাটাতে হয়। একটা তারকে নিজের অক্ষিগোলকের ভেতরে ঢুকিয়ে তিনি ১৮০ ডিগ্রি পাক খাইয়ে দেখেছিলেন যে সেটা কোথাও আটকাচ্ছে কিনা। ভাগ্য ভালো আমাদের চোখের যত নার্ভ বা রক্তনালী সব পেছনের দিকে থাকে। তাই সেই তার সেখানে পৌঁছায় নি। উল্টোটা হলে তাঁর চোখে স্থায়ী ক্ষতি এমনকি অন্ধত্ব পর্যন্ত হতে পারত। এত সবের পরও নিউটন একজন অসাধারণ জিনিয়াস। ইংলন্ডে যখন প্লেগের মহামারী দেখা দিচ্ছে তখন ২৪ বছরের যুবক নিউটন কিছুদিন তার গ্রামের খামার বাড়িতে কাটান। দু’মাস সেখানে থেকে তিনি ক্যালকুলাসের বেসিক প্রিন্সিপাল আবিষ্কার করেন। আমরা তো প্রায় দেড় বছর করোনায় কাটালাম। আমরা কী করেছি?
আরেক শতাব্দীর সেরা জিনিয়াস আইনস্টাইন ছোটবেলায় অটিজমের শিকার ছিলেন। লোকজনদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ ক্ষমতা তাঁর প্রচন্ড কম ছিল। নিজের অবৈধ সন্তানকে তিনি স্বীকার করেন নি। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী যিনি কিনা তাঁর তুতো বোন ছিলেন তাঁর সাথে প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করতেন। এই লক্ষণগুলোর অনেকই তাঁর মানসিক ব্যধির প্রকাশ। তবু তিনি আইনস্টাইন। লেনিনের মত তাঁর মস্তিষ্কও আজ সংরক্ষিত আছে শুধু এটুকু জানার জন্য যে জিনিয়াসদের মস্তিষ্কে কী এমন থাকে যা আমাদের নেই। এটা চিরকালীন এনিগমা, ধাঁধাঁ।
আরেক জিনিয়াস চার্লস ডারউইন। যিনি অভিযোজনবাদকে সারা পৃথিবীতে প্রথম উপস্থাপিত করেন। বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত তাঁর মতবাদকেই মেনে নিয়েছেন কারণ এখনও তাঁর মতবাদকে সরিয়ে দেবার মত অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য মতবাদ তাঁরা পান নি। ডারউইন জীবনের বেশিরভাগ সময়ই গৃহবন্দী হয়ে কাটিয়েছিলেন। তিনি অ্যাগারোফোবিয়ায় ভুগতেন। এই অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ঘরের নিরাপত্তা ছেড়ে বাইরে জনসমক্ষে, ভিড়ের মধ্যে যেতে ভয় পান। সারাজীবন একা একা কাটিয়ে গেছেন। অথচ যেই সময়টুকু তিনি এইচ এম এস বীগল জাহাজে করে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের বিচিত্র জীবজন্তুদের সাথে মোলাকাত করেন তাতেই তাঁর মনে অভিযোজনবাদের যুগান্তকারী ধারণা উঁকি দিয়েছিল।
শুধু বিজ্ঞানী নয় বিখ্যাত সুরসৃষ্টির জাদুকর ও শিল্পীদের মধ্যেও অনেক মানসিক ব্যধির উদাহরণ আছে।
মোৎজার্ট তাঁর জীবনের শেষের দিকে অর্থকষ্টে ও অসুখে প্রচন্ড ডিপ্রশনে আক্রান্ত হন। বীঠোফেন বাইপোলার ডিসঅর্ডারের শিকার ছিলেন। অন্য কারোর সাথে অসম্ভব খারাপ ব্যবহার করতেন। জীবনের মাঝামাঝি যখন তার শ্রবণশক্তি পুরোপুরি চলে যায় তখন পাকাপাকিভাবে চরম ডিপ্রেশনের শিকার হন। কিন্তু সেই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত বধির অবস্থাতেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতগুলো সৃষ্টি করেছিলেন। আরেক বিখ্যাত সঙ্গীতকার শ্যুম্যান মানসিক হাসপাতালেই মারা যান।
মানসিক ব্যাধির কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে চিত্রশিল্পীর নাম আসে তিনি ভ্যান গখ। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হবার পর তাঁর মানসিক সমস্যা প্রচন্ড বেড়ে যায়। তিনি স্কিৎজোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডারের রুগি ছিলেন। তাঁর মধ্যে প্রচন্ড রকম নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। তিনি নিজের বাম দিকের কান নিজের হাতে কেটে এক বেশ্যাকে উপহার দিয়েছিলেন। তারপর নিজের ডানকানে ব্যান্ডেজ জড়ানো এক পোট্রেট আঁকেন। নিজেকে আঘাত করার ক্ষতবিক্ষত করার এই প্রবণতা পরবর্তীকালে ডাক্তারি শাস্ত্রে ‘ভ্যান গখ সিন্ড্রোম’ নামে পরিচিত হয়।
আজও আমরা তাঁর ছবিতে রঙের তীব্র ব্যবহার দেখে অবাক হই। তাঁর ‘স্টারি নাইট’ ছবিতে আকাশের ঘন নীল, ‘সানফ্লাওয়ার্স’ সিরিজের উজ্জ্বল সূর্যমুখির রঙ, ‘আমন্ড ব্লসমস্’ সিরিজের মায়াবি রঙ দেখে কে বলবে শিল্পী জীবনে সবসময় নিজের সাথে সংঘর্ষ করে কাটিয়েছেন। তাঁর বন্ধু, প্রতিপক্ষ পল গ্যঁগার দিকে ছুরি হাতে করে তেড়ে গেছেন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে পিস্তল দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।
অন্য এক কিংবদন্তি ভাস্কর ও শিল্পী মিকেলাঞ্জেলো অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন। সারা জীবন প্রায় নির্বান্ধব ছিলেন। আপনি যদি আজকেও তাঁর ডেভিডের দিকে ফিরে তাকান যতবারই দেখুন না কেন সেই আশ্চর্য বিরাট ভাস্কর্যকে প্রতিবার আপনি নতুনভাবে আবিষ্কার করবেন। পিকাসোও কি সুস্থ ছিলেন? অসম্ভব নার্সিসিস্টিক, ম্যানিক এই শিল্পীর জীবন জুড়ে এমনই নানান গল্পকথা ছড়িয়ে আছে।
এভাবেই মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন বহু জিনিয়াস যাঁরা তাঁদের সৃষ্টি ও আবিষ্কারের মাধ্যমে আমাদের সমৃদ্ধ করে গেছেন তাঁরা অনেকেই মানসিক ব্যাধির শিকার ছিলেন। কিন্তু মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন কবি ও লেখকেরা। আমরা তাঁদের জীবনের কথা শুনলে দেখব তাঁদের মধ্যে অনেকেই কি সাঙ্ঘাতিক রকমের মানসিক পঙ্গুতায় জর্জরিত ছিলেন। তবু কিন্তু তাঁরা তাঁদের সৃষ্টিশীলতাকে সামনের দিকে নিয়ে গেছেন।
তবে এটা কি স্বাভাবিক যে মানসিক ব্যধির সাথে জিনিয়াসদের সরাসরি যোগ আছে, নাকি এটা কেবলই কাকতালীয়?।
(চলবে)
চমৎকার