লেবার রুমের ভিতরটা গুমোট গরম । একে ভাদ্র মাস তায় পড়ন্ত বিকেলের পুরো রোদটাই পড়ে পশ্চিমমুখো লেবার রুমে। গর্ভবতী এবং প্রসূতিরা ঘামে জবজবে। প্রচুর ডেলিভারি কেস হয় এখানে। রোজ। পরিবার পরিকল্পনার বালাই নেই। একেকজনের চার পাঁচটা করে সন্তান। এই জেলা হাসপাতালে আমিই একমাত্র স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ। কাজেই গায়নোকলজি এবং ধাত্রীবিদ্যার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করতে হয়। আমার যদিও মন্দ লাগেনা। লোকজন দারুণ সমীহ করে। বিলেত ফেরত ডাক্তার বলে কথা! তাও আবার এই আধা মফস্বলে। এমনকি পড়শি গ্রামগুলোর পঞ্চায়েত নেতারাও সমঝে চলে আমাকে।
“সিস্টার!” চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। “পরের পেশেন্ট রেবা দাসকে পাঠিয়ে দিন শিগগির। যারা কপার-টি পরতে চায়, একে একে ডাকুন।”
কপার-টি পরিয়ে, অথবা টিউবেকটমি করিয়ে নারীদের বন্ধ্যা করা হয়। বুঝিয়েসুজিয়ে বেশ কিছু মহিলাকে বাঁচিয়েছি ক্রমপ্রসবের রুগ্নতা ও রক্তাল্পতা থেকে। এলাকায় আমার খ্যাতি বেড়েছে। আসলে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারাই ডাক্তারির সাফল্যের চাবিকাঠি। জনপ্রিয় চিকিৎসক যদি রাজনীতিতে নামেন তবে বিধান রায় হন। বাকিরা কল্কেও পায় না।
বাটির মুড়িমাখার শেষটুকু খেয়ে আমি টাওয়েলে হাত মুছে নিলাম। জলপাই তেলে মাখা। আমার ভাগের মুড়িমাখায় পেঁয়াজ কুচির সঙ্গে জলপাইয়ের আচার আর কাঁচালঙ্কা রাখতে বলেছি । আমার এই একটাই আবদার। সিস্টাররা ঠিক জোগাড় করে রাখেন জলপাইয়ের তেল। আসলে জলপাইগুড়ির ছেলে যে আমি। যাকে বলে ভূমিপুত্র। শৈশব থেকেই জলপাই নামটার প্রেমে পড়েছিলাম। কবে থেকে যে জলপাইয়েরও ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম কে জানে! অথচ আমাদের বাড়ির সাহেবি রীতিনীতিতে জলপাইয়ের বদলে বয়ামে অলিভ থাকত। জলপাইয়ের আচার বানাত মণি। তখনই আমার প্রথম জলপাই টেস্ট করা। তাও মা’কে লুকিয়ে। পরে অবশ্য আমার বোন ইভাও গোপনে কিনে আনত মেলা থেকে। আমাদের বাড়িতে ছিল সাহেবি রীতিনীতি । ব্রেকফাস্টে টোস্ট, বেকন, হ্যাম, অমলেট আর অলিভ স্যালাড। জামাকাপড় আসত কলকাতার হগ মার্কেট থেকে। এসবের কারণ আমার ডাক্তার বাবা। মা নিজেও খুব ফ্যাশনদুরস্ত ছিলেন। জর্জেটের শাড়ির সঙ্গে বিলেতি সুগন্ধি মাখতেন।
ইংল্যান্ডে গিয়ে এম আর সি পি করার পর বিয়েও করেছিলাম বাবার মনোনীত ব্রিটিশ পাত্রীকে। অ্যানি। বাবার বন্ধুর মেয়ে। অ্যানি মারা যাওয়ার পর লন্ডনে আর মন বসেনি আমার। ছেলেপুলে হয়নি। বিলেতে ডাক্তারি তো অনেক হল। এবার একটু দেশের লোকজনের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখি।
দেশগাঁয়ের সমস্যা হল, জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি কেউ খায়না এখানে। হাজার বোঝালেও না। অথচ পিলপিল করে লোক বাড়ছে। জনসংখ্যার বিপুল বিস্ফোরণই যে আমাদের গরিবিয়ানার মোদ্দা কারণ, কে বোঝাবে? কোনও রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে একটাও কথা বলবে না। ভোট হারানোর ভয়। অগত্যা সাময়িক বন্ধ্যা করার জন্য কপার-টি ই ভালো। সিস্টার রোগিণীকে বেডে শুইয়েছে। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ এক আর্তকণ্ঠ ভেসে এল।
“তুমি?”
আমার গ্লাভস পরা হাতে কপার-টি। জরায়ুমুখে বসাব বলে প্রস্তুত হয়েছি। হাত কেঁপে গেল।
ততক্ষণে রোগিণী উঠে বসেছে। ঘোমটা খসে পড়েছে। নিজের হৃৎস্পন্দন নিজেই শুনতে পাচ্ছি জোরে জোরে। বহুদূরের আকাশ থেকে ‘পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা’ বলে একটা পাখি ডাকতে ডাকতে এগিয়ে আসছে। লেবার রুমের জানলা দিয়ে তেরছা আলো ঢুকে মায়াবী করে তুলেছে ঘরটাকে।
“মণি ?”
তাজ্জব হয়ে গেলাম। কী চেহারা হয়েছে মণির! সেই প্রাণবন্ত কিশোরী মেয়েটার আজ এইরকম শীর্ণ চেহারা! অথচ ও তো আমার বোন ইভার বয়সী। দু’এক বছরের বড় ছিল। ইভা এখনও স্বাস্থ্যের দীপ্তিতে ঝলমল।
“না , না।” তীক্ষ্ণ চিৎকার করে রোগিণী নেমে পড়ল বেড থেকে। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে গেল। হতচকিত আমি জানলা দিয়ে দেখলাম রাস্তায় ওর পিছনে একদঙ্গল বাচ্চা ।
সিস্টার শ্যামাদি বেরিয়ে গিয়েছিলেন মণির পিছু পিছু। দশ মিনিট বাদে ফিরলেন।
“নাহ, হবে না স্যার। বলছে যে আপনি, মানে আপনার কাছে ও ইয়ে পরবে না।”
মণি যখন আমাকে চিনে ফেলেছে তখন ওর লজ্জা হওয়াই স্বাভাবিক। সিস্টারকে বললাম, “খেয়াল রাখুন মেয়েটিকে। এভাবে ছেড়ে দেওয়া যাবেনা। কপার-টি পরাতে হবে । আপনি অ্যাটেম্পট নেবেন।”
“ডক্টর সেন, মেয়ে কাকে বললেন? ওর তো চারটে বাচ্চা। বড় ছেলের বয়স সতেরো।”
উত্তপ্ত লেবার রুমের ভাপ অসহ্য লাগল আমার। দুজন জুনিয়র সিস্টার মিটিমিটি হাসছে। আমাকেই উদ্দেশ্য করে নয়ত? কান গরম হয়ে উঠল।
মণি ছিল প্রতিবেশী বিনুকাকুদের কাজের মেয়ে। তেলে আর জলে যে মেশে না সেটা তখনই জেনে গেছিলাম, যখন আমি তেরো আর ইভা ন’বছরের। আমরা থাকতাম জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায়। কাছাকাছি বস্তিতে থাকত মণির মা। মণি জন্ম নেওয়ার আগেই ওর বাবা চলে গিয়েছিল । তাই ও বাবাকে দেখেনি। মণির মাও আরেকজনকে বিয়ে করে পালালো। আমি তখন ক্লাস টেন। কষে পড়াশোনা চলছে। আমার চিকিৎসক বাবার ইচ্ছে বিলেতফেরত ডাক্তার বানাবেন পুত্রকে। আর ইভাকে ইউনিভার্সিটির লেকচারার।
ইভা এখন সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায়। মেলবোর্নের এক কলেজে পড়ায়। ইভা যখন নীল সাদা ইউনিফর্মে স্কুল যেতো, মণি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হাসত। ওর টিকলো নাকে সস্তা পাথরের নাকছাবি, ছোট্ট কপালে টেনে পিছনে বেড়াবিনুনি বাঁধা। বিনুকাকুদের বাড়ির উঠোনে বসে বাসন মাজতে মাজতে ওর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠত আমাদের দেখলে। বিশেষত দাদুকে। আমার ঠাকুরদাদা খুব মাই ডিয়ার ছিলেন। বাবার মতো রাশভারি নয়। পুরনো দিনের গল্প বলতেন আমাদের। রূপকথার গল্প, সুয়োরানি, দুয়োরানি সব তার বলার ধরনে আশ্চর্যরকম জীবন্ত লাগত। মণিও শুনত সেসব।
বিকেল হলেই মণি উসখুস করত। আসলে প্রচণ্ড ভয় পেত বিনুকাকুদের। দাদুর মুখে গল্প শুনতে শুনতেও ওর আনমনা ভাবটা ঠিক ধরা পড়ে যেত।
“এখন যাই রে ইভা।” মণি হাসত। আমার মনে হত এই হাসির মধ্যেও লুকিয়ে থাকত একরাশ গোপন কান্না। মণি তাই কোনওদিন কাঁদেনি। অথচ দুয়োরানির গল্প শোনার সময় ওর কী কখনও চোখ ভিজে আসত না ? নাকি বুকে পাথরচাপা দিয়ে রাখত মণি ?
দাদু বলতেন, “এই সুয়ো দুয়ো শুধু মেয়েদের মধ্যেই নয়, পৃথিবীর সব মানুষদের মধ্যে আছে। কেউ প্রচুর টাকার মালিক আর কারও কিস্যু নেই। হ্যাভস অ্যান্ড হ্যাভস নটস।”
আমি না বুঝে ঘাড় নাড়তাম।
“কী বুঝলে দাদাভাই ? দাদু আমাকে ঠেলা দিতেন”।
বিজ্ঞের মতো মুখ করে বলতাম, “বুঝেছি , কী বলতে চাইছ। সবার টাকা পয়সা সমান হোক। কিন্তু দাদু, মানুষ তো তার মেধার জোরে কামিয়ে খাচ্ছে। তাই কারওর অনেক পয়সা আর কারওর ফুটো কড়ি।”
দাদু বলতেন, “অন্যকে ঠকাতে মেধা লাগেনা। এটা একটা বিশেষ ক্ষমতা।”
মণি হাঁ করে দাদুর কথা গিলত। দাদু বলতেন, “এই যে তুমি বিলেতে ডাক্তারি পড়বে, নতুন অনেক কিছু জানবে। শেষে কিন্তু দেশে ফিরে গরিব লোকেদের জন্য কিছু করো। দেশেই থেকে যেও। নয়তো তোমার একার সুখে লবডঙ্কা। ভাগ না করলে সুখ বাড়ে না।”
বাবার সঙ্গে দাদুর দু’একবার তর্ক হয়েছে এই নিয়ে। আড়াল থেকে শুনেছি। বাবার ইচ্ছে আমি বিলেতেই থেকে যাই পাকাপাকি। দাদু চান আমাকে ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে আনতে।
ইভা মাঝে মাঝে মণিকে নিয়ে আসত আমাদের বাড়িতে। কিন্তু মণি কখনওই আমাদের বিছানায় বসত না। ইভা চাইত মণিকে দারুণ ঝলমলে ফ্রক পরাতে। কাচের চুড়ি কিনে দিতে। হেয়ার ব্যান্ড, ক্লিপ। তারপর একসঙ্গে বসে পুতুলের ঘর সাজিয়ে রান্নাবাটি খেলতে। মণি কিন্তু ইভার ফ্রক ছুঁয়েও দেখত না। নিজের পিঁজে যাওয়া ফ্রকটা টেনেটুনে , মাথায় কালো ফিতে বাঁধা বেড়াবিনুনি নাড়িয়ে চলে যেত বিকেল হলেই। আমি বুঝতাম, বিনুকাকুদের বাড়িতে ওর এখন জল তোলা, আটা মাখার কাজ বাকি। আরও বুঝতাম, দুয়োরানিরা কস্মিনকালেও সুয়োরানি হতে পারেনা।
তাহলে দাদু কেন আমাকে বলেন দেশে ফিরে আসতে?
বাবা নিচু গলায় মা’কে বলতেন, “ওল্ড ফুল। সবসময় সর্বহারা সর্বহারা করছেন। পৃথিবী থেকে কম্যুনিস্ট কান্ট্রিগুলো মুছে যাচ্ছে এক এক করে। উনি শুধু সাম্যবাদের ভূত দেখছেন।”
মণি মাঝে মাঝে কাজে আসত না। অনেকদিন বাদে ফিরলে দেখতাম, ওর ফর্সা গায়ে কালশিটে। মুখে নখের দাগ। শুনতাম সৎ বাবার আদর। বিনুকাকুদের বাড়ি থেকেও দু’এক সময়ে ওর আর্তনাদ ভেসে আসত। ইভা আর আমি ছুটে যেতে চাইতাম কিন্তু মা আটকে দিতেন।
ইভা জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদত নিঃশব্দে। ওর মনে হতো, বিনুকাকিমার চপ্পলের মার ওর গায়েই পড়ছে।
দাদু একবার দৌড়ে গেছিলেন মণিকে বাঁচাতে। উল্টে দাদুকেই অপমানিত হতে হয়েছিল। মণি নাকি ওদের মাছের বড় পিস লুকিয়ে বাড়ি নিয়ে যায় জামার ভিতরে। দুধ চুরি করে খায়।
দিব্যা ভারতী যেদিন মারা গেল সেদিন মণির কী আফসোস। চুল বাঁধেনি, ভাত খায়নি। কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে , খয়েরি চোখের মণিদুটো দিয়ে অনেক দূরের আকাশে কী যেন দেখছিল মণি। আকাশ ফুঁড়ে হয়ত বা চলে গেছিল ওর দৃষ্টি ।
“এতো সুন্দর মেয়েটা কেন মরল সৌম্যদা? ওর নামেও কি দুধচুরির নালিশ করেছিল কেউ?”
দেওয়ালে সাঁটানো দিব্যা ভারতীর পোস্টারগুলোর দিকে তাকিয়েছিলাম। শুনলে লোকে হাসবে, কিন্তু মণির চোখদুটো অবিকল দিব্যার মতো লেগেছিল সেদিন। ওইরকম কোঁকড়া কোঁকড়া চুল।
তারপর একদিন চিকিৎসক বাবার দেখানো পথে মেডিকেল কলেজে রওনা দিলাম আমিও। ইভা তদ্দিনে ক্লাস ইলেভেন। আর মণি? দেখতে পেলাম না ওকে। হয়তো নতুন কোনও বাড়িতে কাজে লেগেছিল।
যেখানে যাই হোক না কেন, সপ্তাহান্তে শনি-রবি ও ঘুরেফিরে আসত আমাদের বাড়িতে। মা ওকে ঝড়তিপড়তি কেকের টুকরো দিত। আহ্লাদে তাই চেটেপুটে খেত। ইভা নিজের বাংলা গল্পের বই দিতে চাইত কিন্তু ও বলত বই নিয়ে কী হবে? মাইনের টাকায় একটা ফেয়ারনেস ক্রিম কিনে এনেছিল বলে আমি খুব রাগ করেছিলাম।
“ছিঃ মণি, তুইও এসব হাবিজাবি মাখিস? তোকে আমি অন্যরকম ভাবতাম।”
“কেন সৌম্যদা, সিনেমায় দেখায় যে। এই মেখেই তো ঘুঁটেকুড়ুনি দুয়োরানিরা সুয়োরানি হয়। ”
আমার চোখের ভর্তসনা মণিকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ঐ ক্রিম বদলিয়ে ইভার জন্য একটা ঝর্ণা কলম নিয়ে এসেছিল ও। আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন।
“শ্রীকৃষ্ণ স্টোর্স থেকে কিনলাম । পছন্দ হয়েছে দ্যাখো তো ?”
“ওয়াও, নাইস ফাউন্টেন পেন।” ইভা খিলখিল করে হেসে কলমটাকে চুমু খাচ্ছিল। মণি অপলক চোখে চেয়ে ছিল ইভার দিকে।
ইভার নামিদামী কলমের মধ্যে সস্তার বেমানান কলমটা তবু সবথেকে যত্নে আদরে ছিল। বহুদিন অবধি আমি ওটাকে ইভার কলমদানিতে দেখেছি।
তবে ‘সময়’ এমন এক নায়িকা যে সবকিছু উলটপালট করে দেয়। মণির কথা ভুলে গেল সবাই খুব তাড়াতাড়ি। শুধু হোস্টেল থেকে ফিরে, শনি-রবি দুপুরে মাংসভাত খেয়ে গড়ানোর সময় মনে হত কে যেন নেই। ইভার চোখ বারবার বারান্দার দিকে যেত। অনেকদিন আগে একবার সপরিবারে ইংরেজি ফিল্ম দেখতে গেছিলাম আমরা। মা ইভার একটা পুরনো জামা আর একজোড়া হিলজুতো মণিকে পরতে দিয়েছিল । ওকে মনেই হচ্ছিল না কাজের মেয়ে। গাড়িতে উঠেছিলাম সবাই মণিকে নিয়ে। সেদিন একবর্ণ ইংরেজি না বুঝেও মণির মুখে একটা উজ্জ্বল আলো ফুটে উঠেছিল।
দাদু হেসে বলেছিলেন, “দাদুভাই এঁরাই তোমার দেশ। বিপ্লব , মার্ক্সবাদ আওড়ালেই কি সব পাল্টে যায়? সমাজতন্ত্র একটা বিজ্ঞান। কোনও দেশ ফেল করলেই সেটা ব্যর্থ হয়না। আর সাম্যবাদ আসলে একটা জীবনচর্চা। ঘর থেকে সেটা শুরু হয়। যারা রিকশওয়ালা, মুটে মজুরকে তুই তোকারি করে তারা আর যাই হোক, মানুষ নয়। কম্যুনিস্ট তো নয়ই।”
অ্যানি মারা যাওয়ার পর লন্ডনে বসে দাদুর কথাগুলো প্রায়ই মনে করতাম। দাদু ওঁর সারাজীবনের সঞ্চয় দান করে গেছিলেন, কিন্তু আসল উত্তরাধিকার দিয়ে গেছিলেন আমাদের দুই ভাইবোনকে। ইভার অনুপ্রেরণায় আবার ফিরে এলাম দেশে। চাকরি নিলাম গ্রামীণ হাসপাতালে। বিদেশি ডিগ্রি থাকার জন্য ডিসট্রিক্ট হাসপাতালে পোস্টিং পেলাম।
জীবন থেমে থাকে না কখনওই। একা বাউন্ডুলে মানুষ। আমার কিছু সিনিয়র কলিগ আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লাগল গাঁটছড়া বাঁধানোর জন্য। আবার বিয়ে করলাম। নতুন বউ আমারই এক সিনিয়র ডাক্তারের মেয়ে। অ্যানির সঙ্গে এর আকাশ পাতাল ফারাক। অ্যানিকে কখনও বিদেশিনী মনে হয়নি। সে তার ব্রিটিশ পরিজন , প্রতিবেশিদের সঙ্গে আমার আত্মীয়দের কোনও তফাত করেনি কোনওদিন। নতুন বউ কিন্তু এব্যাপারে বড্ড কঠোর এবং শ্রেণিসচেতন। আমার কিছু করার ছিলনা। কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হলাম। অগত্যা বর, বউ দু’পক্ষই ভাববাচ্যে কথা বলতে লাগলাম। শ্বশুরবাড়ির অতি উৎসাহে আবার আমাকে ইংল্যান্ডের পুরনো আস্তানা আর পুরনো চাকরির খোঁজ করতে হল। স্ত্রীও মহা তাগাদা দিতে লাগলেন।
ইভাকে মণির কথা জানানো হয়নি। ইচ্ছে করেই বলিনি। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন করে ইভা আজকাল এমনিই কান্নাকাটি করে। ইভার বর নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েরা কেউ বাংলা শেখেনি। ইভার সঙ্গে বিস্তর মানসিক , সাংস্কৃতিক দূরত্ব। আজও তার নিজেকে দূরদ্বীপবাসিনী মনে হয়। প্রতিবার দেশে ফিরে মোটে হপ্তাদুয়েক কাটাতে পারে। ফেরার তাড়ায় ইচ্ছেমত ঘোরাঘুরি হয়না । মেঝেতে আসন পিঁড়ি হয়ে ফ্যানা ভাতে গাওয়া ঘি মেখে খাওয়ার স্বাদ ভুলে গেছে । ভুলে গেছে জলপাই আচার, চা বাগানের গন্ধ। এইসব ইনিয়েবিনিয়ে বলতে থাকে ইভা।
সরকারি হেলথ সার্ভিস ছেড়ে একেবারে চলে যাব শুনে সারা গ্রামে কী উত্তেজনা সেদিন! গ্রামের মানুষের এতো বড় আশা ভরসার জায়গা ছিলাম সেটা বুঝতে পারিনি। ওয়ার্ডমাস্টার এসেই বললেন, “আপনাকে কেউ যেতে দেবে না স্যার। লোক মরে যাবে আপনি চলে গেলে।”
বিশ্বাস করিনি প্রথমে। ধ্যুত, তাই আবার হয় নাকি? এই ইহজগতে কে কার? অচিরেই ভুল ভাঙল যখন ছুটে এলেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। এমনকি স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট। এলাকাবাসী নাকি মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি ফেলে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রেখেছে। ডাক্তার সৌম্য সেনকে যতক্ষণ না অবধি রাজ্য সরকার ফিরিয়ে দেবে, তাদের প্রতিবাদ জারি থাকবে। জেলাশাসক আমাকে অনুরোধ করলেন, চাকরিতে থেকে যাওয়ার।
কিন্তু আমার যে আর ফেরার পথ নেই। সরকারি চাকরিতে রেজিগনেশন জমা দিয়েছি। পাসপোর্ট , ভিসা সব ক্লিয়ার। আগামী বুধবার হিথরো এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় থাকবে আমার পুরনো হাসপাতালের সহকর্মী। ওখানেই আবার জয়েন করব। তেমনই কথা হয়েছে চিঠি চাপাটি, ই-মেল মারফত। স্ত্রী আড়চোখে দেখছেন গ্রামের লোকের কান্ডকারখানা। শ্বশুর -শাশুড়ি মালপত্র বাঁধাছাঁদার লোকদের পরিচালনা করছেন। সবকিছু ঠিকঠাক গুছাতেই তিন-চারদিন লেগে যাবে।
পশ্চিমমুখো লেবার রুমের দেওয়ালে সূর্যটা আরও একটু তেরছাভাবে পড়েছে আজ। একজন গ্রাম্য মহিলা দাঁড়িয়ে। সঙ্গে এক কিশোর। কাছে আসতেই ঘোমটা সরিয়ে আমার দিকে চাইল মহিলা। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। দিব্যা ভারতী বেঁচে থাকলে কি এই বয়সে এমনই হত দেখতে?
চুল একটাও পাকেনি কিন্তু জীবনসংগ্রামের ছাপ চোখেমুখে। বলিরেখা পড়েছে আর শীর্ণ হয়েছে গালদুটো। চোখদুটো কিন্তু আজও স্বচ্ছ খয়েরি । কিশোরী দিব্যা।
“মণি তুই ? সেদিন অমন পালিয়ে গেলি যে?”
ওর শিরা ওঠা হাতে একটা বয়াম ।
ইতস্তত ভাব দেখে বুঝলাম কিছু এনেছে।
“এতে কী ?”
“আচার খেও। আমি নিজে বানিয়েছি।”
বিনাবাক্যব্যয়ে বয়ামটা হাতে নিলাম।
“ইভা কেমন আছে সৌম্যদা ? কতদিন দেখিনি। ”
ভালো বলব? নাকি অতটা ভালো নয়! মণির থেকে তো কোটিগুণ ভাল । সিডনির সমুদ্রসৈকতে বিলাসবহুল বাড়ি, বাগান, সুইমিং পুল। বছরে দু’বার ওয়ার্ল্ডট্যুর। হুডখোলা দামি গাড়িতে লং ড্রাইভে যায়। তবে ইভা প্রায়ই বলে, আমাদের জলপাইগুড়ির মাঠঘাট, অলিগলি ও খুব মিস করে। সেই যে প্রায়ই আমরা উইকেন্ডে চা বাগানে চলে যেতাম। হাত বুলাতাম বড় গাছের বাকলগুলোয়। পিকনিক করতাম দলবেঁধে। আর শিলিগুড়ি যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই মাঝেমধ্যে দেখা যেত কাঞ্চনজঙ্ঘা। বুকটা কেঁপে উঠত আনন্দে। জীবনের সব ধনরত্ন যেন জমা রাখতাম ওখানে। দু’মিনিট বাদে বাদে তাকিয়ে দেখে নিতাম শৈলচূড়া। চোখের পাতার রোম খসে পড়লে ডান হাতের মুঠিতে বন্দি করে কী যেন প্রার্থনা করত ইভা। তারপর ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিত।
আচ্ছা, পুরোপুরি ভালো থাকা কাকে বলে? কে দেবে এর উত্তর?
“দাদু বেঁচে আছে সৌম্যদা?”
“নাহ। মারা গেছেন তাও এক যুগ। তুই কেমন আছিস মণি?”
“দুয়োরানিরা যেমন থাকে।” মণি ম্লান হাসল।
“বাবা! ভুলিসনি দেখছি কিছুই। তোর বর কী করে? এদ্দিন এখানে ডাক্তারি করছি জানতে পারলাম না তো ! নেমন্তন্নও করলি না !”
মণির শাঁখাপরা হাত চুপচাপ বয়ামের ঢাকনির প্যাঁচ টাইট দিতে লাগল।
“কীসের আচার মণি ?”
মণি নিরুত্তর।
“জলপাইয়ের, না রে?”
মণি লাজুক হাসল। “সৌম্যদা, আমার বড় ছেলেকে কিন্তু পড়ালেখা শেখাচ্ছি। ক্লাস টেন।”
“বাহ, চমৎকার। তা কী পড়বে ভবিষ্যতে, ঠিক করেছে ?”
মণি আমার দিকে সোজাসুজি তাকাল। “বেশি ভেবে কী হবে বলো? যা হওয়ার হবে। ভাগ্য ভাল হলে তোমাদের মত উঁচুতে উঠবে নয়তো এই ইয়েতেই… ”
“মানে?”
“হয় ওর বাবার সঙ্গে ভাগচাষ করবে নয়তো আমার বড় ননদাইয়ের সঙ্গে কলকাতায় কাজের খোঁজে যাবে। যাহোক কিছু জুটে যাবে। আমাদের আর ঠিক বেঠিক!”
“তুই সেই একরকম দুয়োরানি হয়ে রয়ে গেলি মণি!”
আমাকে চমকে দিয়ে মণি সুর করে চেঁচিয়ে উঠল, “ওমা! তাইই তো হবে। এমনই তো হওয়ার কথা। দাদুর গল্পগুলো সব গুল ছিল জানো। গুলগপ্পো।”
খিলখিল করে হেসে ফেলল মণি হঠাৎ। হাসির আওয়াজে একজন নার্স উঁকি মারতেই অপ্রস্তুত হয়ে ঘোমটা টেনে নিল পরক্ষণে।
একটু বিরক্তই হলাম। বলছে কী ? আমার দাদুর মতো শিক্ষিত মানুষের ভুলভ্রান্তি বার করছে? তাও আবার এভাবে প্রকাশ্যে!
মণির নাকছাবিটা ঝিলিক দিয়ে উঠল। ঘোমটা খসে পড়েছে উত্তেজনায়।
“আমি তো দেখছি এত বছর সৌম্যদা। আজও সুয়োরানিরা দিব্বি বেঁচেবর্তে আছে গো। দাদু কিন্তু প্রত্যেকটা গল্পের শেষে বলত, সুয়োরানি জঙ্গলে যায় আর দুয়োরানি পাটরানি হয়। কী বোকা ছিলাম ! সেটাই বিশ্বাস করতাম।”
“মণি দাঁড়া। চলে যাস না। লেবাররুমের নোংরা ঘেঁটেছি। হাতটা ধুয়ে আসি।”
শ্যামাদি নতুন সাবান এগিয়ে দিলেন। “নিন, আজ আপনার নতুন সাবান, তোয়ালে। ইনডেন্ট করে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আপনি আবার ঐসব খাবেন নাকি স্যার? পচা টচা হতে পারে কিন্তু।”
শ্যামাদির চোখে সন্দেহ।
আমি কিন্তু বুঝেছি মণি কী এনেছে । রোদেপোড়া খাটিয়ে শরীরটা কৃশ হলেও লাবণ্য মিলিয়ে যায়নি। মাতৃত্বর সঙ্গে বালিকার মতো চপলতা মেশানো। লেবাররুমের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল মণি।
হাত ধুয়ে এলাম। স্ত্রী এর মধ্যেই তিনবার কল করেছেন মোবাইলে। মিসড কলের নোটিফিকেশন এল।
বয়াম খুলে একটুকরো আচার মুখে দিলাম। টাকরা আর জিভে ঘষলাম বারকয়েক। কিন্তু কী আশ্চর্য! আজ আমি আর স্বাদ পাচ্ছিনা, গন্ধও। বয়স হলে কি এমন হয়? নাকি আমার জিভের স্বাদকোরকগুলোও আমার মতো নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দিয়েছে? অথচ কী ভালবাসতাম এই জলপাই! সেটা আমাদের শহরের নামের জন্য নাকি ছোটবেলার স্বাদের জন্য কে জানে!
“সিস্টার, ঐ মেয়েটিকে ডাকুন তো!”
“মেয়ে?” শ্যামাদি ফের ভ্রূভঙ্গি করল।
দ্রুত উঠে পড়লাম চেয়ার থেকে। বারান্দা খাঁ খাঁ।
হাসপাতালের কাচের জানলা। পাল্লা খুলে ঝাপসা চোখে দেখলাম ছেলের হাত ধরে মণি ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে।