সনাতন বৈরাগী। হাসপাতালের আউটডোরে দেখা নেই অনেকদিন। পার্কিনসনে ভুগছে। অথচ কিছুতেই নিউরো দেখাবে না।
দিস্তা সাইজ প্রেসক্রিপশন টেবিলে রাখতে রাখতে সে বলবে হরেকৃষ্ণ। প্রতিশুভেচ্ছায় আমিও হরেকৃষ্ণ বলি।
তারপর বসার টুলটায় এমন জুৎ করে গুছিয়ে সে বসে, যে মনে মনে হেসে ফেলি। সময় তো সাকুল্যে একমিনিট। ভনিতাতেই তো সময় চলে যায়!
-এবারও তুমি নীলরতন যাওনি।
-পান খাওয়া দাঁত বের করে সে হাসে!–ভালোই তো আছি বাবাজী। ও তুমিই পারবা। আর উপরে গোবিন্দ আছে। আমার আর কি চিন্তা।
আমি বাধ্য হয়ে লিখি। সাধ্যের বাইরে গিয়ে দেখি।জানি ভুল হয়। প্রতিদিন রেফার লিখে নিয়ম বাঁচাই। ভয় দেখাই। কিন্তু সনাতন বৈরাগীর হুস ফেরে না। লাঠি ভর করে,কাঁথা সেলাই করা পুটুলি আর তিলক কাটা কপাল নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ভালোই থাকে।
বাড়ি বাড়ি রুগী দেখতে গিয়ে তার ডেরা দেখতে পেলাম। আমায় দেখে চমকে ওঠে বৈরাগী।
-বাবাজী যে। কি সৌভাগ্য। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ।
আমি সরাসরি লাইনে আসি–হাসপাতাল যাও না যে! আছো কেমন?
-ভালো আছি তো। নকডাউন উঠলেই যাবনে।
আচ্ছা বাবাজি আমার ছেলেডারে একটু দেখবা?সনাতন বৈরাগীর চোখে মুখে আবদার।
কোনোদিন তার ছেলেকে দেখিনি। আজ দেখলাম। আঠারো বছরের জন্মান্ধ! লিকলিকে হাত পা।খসখসে চামড়া। দাঁত বেরকরা হাসি। আমি ঘসঘস প্রেসার মাপি, অপুষ্টির অপরিমেয় প্যারামিটার গুলি হাতড়াই। আবোলতাবোল ভাবি। কি লিখবো বুঝতে পারি না। কোথা থেকে শুরু করবো চিকিৎসা ভাবতে ভাবতে অন্ধ লাগে নিজেকে।
সনাতন বৈরাগী দাঁত বের করে হাসে–প্রেসারডা ঠিক আছে না বাবা!
আমি হুমম বলি। আমার পি পি ই পরা পিঠ ঘামতে থাকে। হসপিটালে এস মঙ্গলবার। ওকে কিছু ওষুধ দিয়ে দেব। টুকটাক খাবার চার্ট বলে তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসি।
নির্ভয় সনাতন বৈরাগী কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে আমি আর কোনোদিন এন আর এস যাবার কথা বলবো না। বলতে পারবো না।
নিপেন বিশ্বাস। অনেকদিন আমার পেসেন্ট ছিল।ইদানিং আসে না বহুদিন। তাঁর পাড়ায় ক্যাম্প হচ্ছে শুনে এসে গেছে।
কিগো আজকাল ওষুধ খাওনা!
খাই বাবু। এখন জওহরলালে দেখাই। ওষুধ গুলা ফিরিতে পাই। বোজেনি ই তো …।
এই বোঝেনিতো টা নিপেন বিশ্বাসের ট্রেড মার্ক। যাই বলেন না কেন তার কথা শেষ হয় : বোঝেনি তোওও দিয়ে।
ওষুধ খাওনি কেন?
কাল এট্টু চাকদা গেসলাম। বেয়ান বাড়ি। বোঝেনি তোও ও।
বিড়ি খাওয়া ছাড়বা কবে!!
সেই তিরিশ বচ্ছরের নেশা। বোঝেনিতো ও ও।
নিপেন বিশ্বাস হকার। প্রায় বছর দশেকের ডায়বেটিক। আমাদের হাসপাতালে দেখাতো আগে। বাট মেটফরমিন আর গ্লিমেপিরাইডের বাইরে ওষুধ এখানে কিনতে হয়। সাপ্লাই নেই। জওহরলালে সে ফ্রিতে সব পাচ্ছিল। কিন্তু লক ডাউনে ট্রেন বন্ধ। বন্ধ তার বাদাম বিক্রিও। ওষুধ শেষের দিকে। সমস্যা তার দুদিকেই। স্যাম্পেল থেকে আপাতত কিছুদিন তার ব্যবস্থা করা গেল।
তোমার বাড়ি তাহলে এদিকে।
হ্যাঁ বাবু। বোঝেনি তো ও।
বাড়ি বাড়ি, পাড়ায় ঘুরলে এদের সাথে দেখা হয়। অনেক দিনের প্রায় ভুলতে বসা মুখ চকচক করে ওঠে। ‘ভালো আছেন তো ডাক্তারবাবু’! আমি ঘাড় নাড়ি। হাসি। আউটডোরের নিক্তি মাপা সময়ের স্রোতে অপরিচিত লোকগুলি আপন হয়ে ওঠে। তাদের ঘর বারান্দা, জলের গ্লাস, পলিথিন ছাদ, অপুষ্ট পরিবার, একমুখ হাসি স্পষ্ট করে দেয় রোগ, অসুখ। এমনকি সুখটাও।
বাড়ি ফেরার সময় ভরা রোদ উপুড় হয়ে থাকে। ফিন ফিনে হাওয়া বয়। আড়াই পাক ঘুরে কুন্ডুলী পাকিয়ে ঝিমোয় কুকুর। রেশনের চালের গাড়ি থেকে টুকটাক পড়ে থাকা চাল খুঁটে খুঁটে খায় পায়রা ..ঘুঘু। একটা ছায়া ছায়া গাছের নিচে বাইক দাঁড় করাই। হাওয়া মাখি। নির্জন রাস্তায় ঘুঘুর দুপুর ভারী করা ডাক আর ফিনফিনে হাওয়া সনাতন বৈরাগীর মতন নিশ্চিন্ত ভাব এনে দেয়। ভালো থাকি। ভালো থাকতে শুরু করি। ভেতরে ভেতরে।
খুব ভালো লাগলো । সর্বদা থাকো অন্তরে ।
Darun..
এই প্রথম আপনার লেখা পড়ছি। ডাক্তার না হলে ভালো লেখক হতেন। সারা বছর নকডাউনের ফিনফিনে বাতাস গায়ে মেখে সনাতন বৈরাগী দের দেখতে থাকুন।
Tomar lekha ta mon k chuye jay
আপনি আগে ভালো মানুষ, তারপর ডাক্তার, তারও পর লেখক।
Like!! I blog quite often and I genuinely thank you for your information. The article has truly peaked my interest.
I am regular visitor, how are you everybody? This article posted at this web site is in fact pleasant.
These are actually great ideas in concerning blogging.