মন খারাপ হলেই ইস্পাত পড়ি, “হাউ দ্যা স্টিল ওয়াজ টেম্পার্টড”। উপন্যাস জুড়ে বামপন্থী কোনোটেসন বাদ দিন। কোইয়েট ফ্লজ দ্যা ডন এর মতো মহৎ না হলেও কী অসাধারণ উপাখ্যান। বারবার যেটা মুগ্ধ করে সেটা হল বাস্তবতা। ছোট বড় সব কটা চরিত্র যেন বাস্তবের মাটি থেকে উঠে এসেছে। এতটাই রক্ত মাংসের যে কখনও মনে হয় না লেখক বানিয়ে বানিয়ে লিখছেন। আর এই মুগ্ধতার পাশাপাশি এটাও মনে হয় যে এমন উপন্যাস বাংলায় লেখা হয় না কেন। এর কারণ মনে হয় যে মানিক, সমরেশ, মতি নন্দী এমন হাতে গোনা দু একজন ছাড়া অধিকাংশ বাঙালি সাহিত্যিকদেরই জীবনের অভিজ্ঞতা খুব সীমিত। তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে উঠেছেন। তাঁরা সে অর্থে না চেনেন উচ্চবিত্ত জীবন, না জানেন নিম্নবিত্ত মানুষজনকে, তাদের জীবন যাপনের ধারাকে।
গোটাটাই বানিয়ে বানিয়ে লিখতে গেলে কেমন অবাস্তব দাঁড়ায় সেটা দেখেছিলাম একটা নাম করা উপন্যাসে। উত্তরবঙ্গ-জাত এই জনপ্রিয় লেখকের ট্রিলজির প্রথমটা চা বাগান-কেন্দ্রিক, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-কেন্দ্রিক তাই কিছুটা উৎরে গেছিল। দ্বিতীয়টাও পাতে দেওয়া যায়। উনি ধ্যারাতে শুরু করলেন তৃতীয় পর্বে এসে। কি কুক্ষণে উনি ঠিক করলেন যে নায়ককে নিয়ে এসে ফেলবেন কলকাতার বস্তিতে। তো সেই কলকাতার বস্তির এমন বর্ণনা দিলেন যে যারা বিন্দুমাত্র পরিচিত তাদের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার কথা অমন অবাস্তব বর্ণনা পড়ে। এহ বাহ্য। অনেক পাঠক পাঠিকারই পেটে খিল ধরে নি। কারণ ওই লেখকের মতো তারাও মূলত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কাজে কাজেই বস্তির জীবন যাত্রা সম্বন্ধে লেখকের মতই তারা অপরিচিত। বস্তির ভয়াবহ জীবন যাপন, অন্ধকার জগতে ঘোরা ফেরা করা চরিত্রগুলির গতিবিধির প্যাটার্ন সর্ম্পকে তারাও সেই সবিশেষ অজ্ঞ। ফলে বাস্তব সম্মত চরিত্র নির্মাণ সেই হাহুতাশ পর্যায়েই রয়ে গেল। শুধু নিম্নবিত্ত নয়, উচ্চবিত্তের জীবন যাপন নিয়েও সেই একই অবাস্তব হাস্যকর চিত্রায়ণ। এক বাঙালি মহিলা সাহিত্যিক বিরাট জনপ্রিয় হওয়ার সুবাদে তাঁর দু একটি লেখা পড়ে দেখার চেষ্টা করেছিলাম। আদৌ কিস্যু না জেনে তিনি আবার এক উচ্চবিত্ত চিকিৎসকের জীবন যাপনের গ্লানি ও বিবেক যন্ত্রণার উপাখ্যান তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন।এত অবাস্তব যে পড়তে গিয়ে দুঃখ নয়, হাসির চোটে চোখে জল এসে গিয়েছিল।
এই কথা সাহিত্যিকদের একটা অংশই আবার চলচ্চিত্রকার, টিভি সিরিয়ালের কাহিনীকার। তাঁরাও অবলীলাক্রমে অকুতোভয়ে সেই নিম্ন বা উচ্চ বিত্তের জীবন নিয়ে গল্প বানিয়ে যাচ্ছেন যা তাঁদের সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জগৎ। ফলে বাস্তবতার পিন্ডি চটকে এক অদ্ভুত অবাস্তব জগৎ তৈরি হচ্ছে, পরাবাস্তব বা জাদু বাস্তব বলে কেউ আবার ভুল করে বসবেন না। “ইস্পাত” তো অনেক দূরের ব্যাপার, একটা “পুতুল নাচের ইতিকথা” বা একটা *বিটি রোডের ধারে” বা একটা “শিবার ফিরে আসা” আবার কবে বাঙালির কলম থেকে বেরোবে তার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া বোধহয় বাঙালি পাঠকের আর কোনো উপায় নেই।