কোভিড নিয়ে অন্য অনেকের মতোই ভয়ে ছিলাম| আকাশবাণীতে কাজ করতে গেছি যখন মাস্ক, স্যানিটাইজার, লিক্যুইড সাবান… সব সঙ্গে নিয়েছি| নিজে তো ব্যবহার করেইছি, সঙ্গে সহ-উপস্থাপককেও বাধ্য করেছি সে সব করতে| বাড়িতে সব্জি আনলে নুন দেওয়া গরমজলে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে, তুলে, রোদে রেখে, তারপর ফ্রিজে তুলেছি, বাইরে থেকে এসেই মাথা থেকে পা অবধি ধুয়েছি, জামাকাপড় সব কেচেছি, অর্থাৎ, যা যা বলা হয়েছে করতে, তাই তাই পালন করার চেষ্টা করেছি| তারপরেও যখন তিনি হানা দিলেন, তখন ঐ রবীন্দ্রনাথ ধার করে বলতে হয় “ভেঙ্গে গেল ভয়”…| মৃত্যুর চেয়ে তো বড় নয়.. বেশি পাত্তা দিলেই মাথায় উঠবে…. ভেবে নিলাম মনে মনে…
কিন্তু বাস্তবটা অত সহজ-ও ছিল না| গলা বসে যাওয়া আর হালকা জ্বর দিয়ে শুরু| তারপরের দু’দিন আবার জ্বর রইলও না| তৃতীয়দিন থেকে জ্বর, গা-হাত-পা ব্যথা, হাঁপধরা শুরু হ’ল| তারপর টেস্ট… টেস্টে পজিটিভ… ওষুধ শুরু..এজিথ্রোমাইসিন, বিকোস্যুল সঙ্গে জিঙ্ক, আর ভিটামিন সি| সঙ্গে কেনা রইল অক্সিমিটার, মাঝেমাঝেই চলল পালসরেট আর অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখা| ডাক্তারবাবু বল্লেন, স্যাচুরেশন ৯০%-এর নীচে না নামলে চাপ নেই| আর সাহস যোগালেন বাড়িতে থেকেই সুস্থ হবে, আলাদা ঘর, আলাদা বাথরুম, আলাদা খাবারের বাসন, গরম জল খাওয়া, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, ভেপার নেওয়া, প্রচুর ফল আর প্রোটিন ডায়েটে রাখা… এভাবে চল্লেই সুস্থ হয়ে ওঠা যাবে ঘরে থেকেই| সঙ্গে আমার দাদা আর ভাই বুদ্ধি দিলেন শ্বাসের ব্যায়াম করতে…. শুরু হ’ল কোভিডের সঙ্গে আমার যুদ্ধ, একেবারে সম্মুখ সমর যাকে বলে!
একদিন সকালে মনে হ’ল, বা:, শরীরটা দিব্য লাগছে.. শ্বাসের ব্যায়ামের সঙ্গে আরো একটু ব্যায়াম করে নিলাম, সকালে যে দু’বার ভেপার নিতাম, সেটা আর নিলামনা.. ভালোই তো লাগছে শরীর.. বিকেলে নেব’খন..! ব্যাস, দুপুরেই জ্বর প্রায় দুই, হাঁপ ধরে যাওয়া প্রবল, সঙ্গে স্যাচুরেশন ৯২-৯৩%.. যেখানে সকালেই ছিল ৯৭-৯৮%…!! পাঁচদিনের এজিথ্রোমাইসিনের কোর্স শেষেও আমার জ্বর কমলো না, তখন ডক্সটি এস এল এবং মন্টেয়ার এলসি-র আবার পাঁচদিনের একটা কোর্স চালু করলেন ড: তন্ময় ব্যানার্জী| এই ওষুধ দুটি একবার পড়তেই ম্যাজিকের মত সুস্থ বোধ করলাম আমি….!
কোভিড ১৯, ডাক্তার বা বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ বলতে পারবেন; তবে, আমি একজন সাধারণ রোগী হিসেবে এই ভাইরাসটিকে এক’দিনে যেটুকু পড়তে পারলাম, তা হ’ল, ভাইরাসটি অতীব চালাক| আপনাকে যদি কেউ গ্যারি কাস্পারভের সঙ্গে দাবা খেলতে বসিয়ে দেন, এবং, গ্যারির যাবতীয় সব আনপ্রেডিক্টেবল মুভের সঙ্গে আপনাকে পাল্লা দিতে হয় চেকমেটটা না খাওয়ার জন্য, তাহলে যে চাপা টেনশন আর উত্তেজনা কাজ করবে, ঠিক সেরকম মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়েই আপনি যাবেন এই অসুখে| আর, মানসিক চাপের জায়গাটা আরো বেড়ে যায়, কারণ আপনার আশেপাশের মানুষজন বুঝে নিয়েছে আপনার সঙ্গে ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’ বজায় রাখতে হবে| তার সঙ্গে আরো কিছু জ্ঞান তাঁরা অর্জন করেছেন, যেমন, আপনার বাড়ির দিকে তাকালেই আপনার প্রতিবেশীর করোনা হয়ে যেতে পারে, আপনাকে পাশেরবাড়ির ছাদ থেকে ‘কি, কেমন বোধ করছেন আজ?’ জিজ্ঞেস করলেই তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হতে পারে!
আমার স্মরণে আসে, ছোটবেলা থেকে একাধিকবার সিজনচেঞ্জের সময় জ্বর হ’তো.. তারপর বাড়ির সবাইকে ধরাশায়ী করে তবে প্রস্থান করতেন ভাইরাসটি| মজা ক’রে অনেকে বলতেন, ওষুধ খেলে এক সপ্তাহে সারবে, নচেৎ সাত দিন লাগবে…! এই কোভিড ১৯ ভাইরাসটি সেসবের পিতৃপুরুষ-ই হবেন হয়তো, মানে তেজ আরো বেশি, তোয়াজ-ও চান বেশি| এই কোভিডের সবচেয়ে খারাপ জায়গাটা হ’ল, যে-বাড়িতে একজনের কোভিড হচ্ছে, সে- বাড়িতে বাকি সবাই ঘরবন্দী হয়ে গেল| আর যেহেতু ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে আগেই বলা হয়েছে ‘সামাজিক দূরত্ব’, তাই, রাস্তায় থুতু ফেলা, যাবতীয় নাগরিক-নিয়মকানুন অমান্য করা মানুষ-ও হঠাৎ করে বড্ড সচেতন হয়ে সিস্টেমের তৈরি করা ক্যাচলাইনে মজে গিয়ে অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’…!
চোদ্দোদিন ব্যাপী এই যুদ্ধটা, যতটা শারীরিক, ততটাই মানসিক… তাই, সবশেষে, আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে বাকি সমস্ত সহনাগরিকদের প্রতি (করোনা-জয়ী মানুষের কাছে এবং আমাদের আশেপাশে যে সব সংবেদনশীল প্রকৃত শিক্ষিত মানুষজন রয়েছেন, তারা বিষয়টা সম্পর্কে অবগত আছেন এই বিশ্বাস রেখে)যে, দৈহিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করাই এই সময়ের দাবী| অসুস্থ মানুষটির বাড়িতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যেহেতু তাঁরা কেউ বাড়ির বাইরে যেতে পারছেন না, পৌঁছে দেওয়া, রান্না করে দিয়ে আসার মতো অবস্থা থাকলে সেটা করা, অসুস্থ পরিবারটির হাতে পয়সাকড়ি আছে কিনা খবরাখবর করা, ফোন বা মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা, আশ্বস্ত করা যে আপনি অপরাধী নন, আপনি একা নন, আপনার একটু শরীর খারাপ হয়েছে, দু’হপ্তার মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবেন, তদ্দিন আমরা আছি, কোন টেনশন নেবেন না….!
এটুকুও যদি প্রতিবেশীর জন্য না করতে পারি তাহলে কোভিডের প্রয়োজন নেই, আমরাই আমাদের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট|
আমি একদম এক মত সোহিনী র সঙ্গে। তাঁরা কোভিড এ আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের কষ্টের ভাগ আমরা নিতে পারব না। কিন্ত সেই কষ্ট টা কে যদি একটু সহনশীল করে তোলা যায়, যদি সহমর্মী হয়ে ওঠা যায়, যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়। আজ একজনের হয়েছে, কাল আমার হতে পারে, এই সহজ কথাটাই আমরা ভুলে যাচ্ছি।
Excellent & very informative post.
Thank you very much.
দূরত্ব বজায় রাখার বার্তাটি আগাগোড়া ভুলভাবে প্রচার করা হয়েছে বলেই মানুষের মনে এক অদ্ভুত ভয় চেপে বসেছে। দৈহিক দূরত্ব রেখে যদি অসুস্থ মানুষগুলোর পাশে না দাঁড়াতে পারি, তাহলে নিজের যখন হবে, তখন কি হবে এটা মানুষ ভাবছেন না। সেই লড়াইটাই যে সবচেয়ে কঠিন।যার কোন ওষুধ তো নেইই, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও প্রচুর।
Lekha ta besh manomugdhokar ebong jothajato hoyechhe. Ei shomoye daNriye emon informative writing piece manusher mone shahosh jogabe, ebong socially kachhe aante shahajyo korbe. Thanks Sohini for penning down the thoughts so wonderfully
Inspiring and very useful write up from a brave girl.
Khub bhalo lekha…manusher mone ajotha voy dur korte ebong tader sathik siddhanto nite help korbe…
Kudos to you Sohini for coming out of this experience on such a positive note. We falter many times in not being sensitive enough to understand the actual needs, your write up is an eye opener…. Salutes, take care
কুর্ণিস জানাই সোহিনী। কুর্ণিস তোর তেজ, স্পষ্টভাষণ, মনোবল আর সহমর্মিতা। যান্ত্রিক সভ্যতা বেশির ভাগ মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছে তার বোধ, কর্তব্য আর যথাযথ বুদ্ধিবৃত্তি। দিয়েছে স্বার্থপরতা ও অমানবিকতা। যদি একটু পাশে থাকা, আশ্বাস দেওয়া, প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিশেষ করে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে এই রোগ কি আর জাঁকিয়ে বসে! তোর শেষ বাক্যটি অত্যন্ত মূল্যবান। আশা করি আমরা সবাই মিলে একসাথে পারবো একে অপরকে সাহায্য করতে। পাশে দাঁড়াতে। আবারও বলি আজকের অবস্থায় এই লেখাটি খুব দরকারী। যেনো সচেতন, সংবেদনশীল, দায়িত্বশীল হই আমরা। Salute to you.
Bhison joruri akta barta lekhatar modhey diye pelam ,ja samajer jonjo o bhison joruri .Jekono byapare amader halka chintabhabna ta bodhhoy ektu badlabar din esechhe.Ei osukh jekono samay jar tar sathe hote pare,kam se kam setuku bhebe amader manobik howata boddo joruri.
Sathe dewa osudh r bayamer byaparta details e likhe aro sahajjo korechhis manus ke.
Rogsajjate theke jebhabe tui amake sahos dichhili ,sotti Sohini tor sahos ke Salam. By the way congratulation aro akbar. You are a true Covid Warrior .