দিরাং থেকে নামার পথে অরূপ-দের গাড়িকে পাশ কাটিয়ে ‘ছুটিতে ছুটি’ নামক ভ্রমণ সংস্থার গাড়িটা খানিক এগিয়ে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো। রাস্তার এখানে ওখানে পাহাড় ফাটিয়ে আর্মির বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন রাস্তা চওড়া করছে। রাস্তা জুড়ে কাদা আর ধ্বস। অত্যন্ত সাবধানে পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়েও সামনের চাকা একটু পিছলে গেছিল। আর একটু হলেই…..। এখন কষ্ট হলেও কয়েক বছর বাদে অতি সহজে রাস্তা ও রেলে তাওয়াং পৌঁছে যাওয়া যাবে। যদিও রাস্তার এই অ্যাডভেঞ্চার নিশ্চয়ই আর ততটা থাকবে না।
বিদিশার আব্দারে তাওয়াং যাওয়া হয়েছিল এবার। ওদের সঙ্গে আর একটা পরিবারও ছিল। বিদিশার সহকর্মী এবং তার ডাক্তার স্বামী। তাওয়াং মনাষ্ট্রি, লেক ইত্যাদি দেখে দিরাং হয়ে ফেরার পথে ওরা অন্য রাস্তায় পাশিঘাট চলে গেছে। ওদের আরো বড় ট্যুর।
অরুণাচল প্রদেশ অর্কিডের সাম্রাজ্য। ভালুকপং-এর ঠিক আগেই তিপ্পির অর্কিড গবেষণাকেন্দ্র। তাওয়াং যাওয়ার পথে তাড়াহুড়োয় ভালো করে এটা দেখা হয় নি। আর একবার ওখানে থামার ইচ্ছে অরূপের। ডিরেক্টর ভদ্রলোক বাঙালি। নাম মানিক দাস। বোটানী-র লোক। উদ্ভিদের প্রজাতি আর শ্রেণীবিন্যাস সম্বন্ধে ভদ্রলোকের অগাধ জ্ঞান। আরো একটা বিষয়। উনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। অরূপ একসময় পড়িয়েছে উত্তরবঙ্গে।
ফেরার পথে চেক পোষ্ট পার হয়ে রাস্তার মোড় ঘুরে থামল ওরা। যাওয়ার সময় এই চেকপোষ্টে ইনার লাইন পারমিট দেখাতে হয়েছিল। এখন ফেরার সময়েও পারমিটে ছাপ লাগাতে হল। ভারতীয় নাগরিকদের অরুণাচলে ঢুকতে ইনার লাইন পারমিট লাগে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ অনুমতি ছাড়া বিদেশীদের চেকপোষ্ট পার হয়ে যেতেই দেওয়া হয় না।
ভালুকপং আর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। রাস্তার ধারেই প্রায় দশ হেক্টর জায়গা নিয়ে অর্কিড সেন্টার। অর্কিডেরিয়াম, মিউজিয়াম, ল্যাবরেটরি নিয়ে এক এলাহি বন্দোবস্ত। কিন্তু মানিকবাবুকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অর্কিড সেন্টারের এক কর্মী তোনজিন বলল,
‘দাস সাহেব কিছুক্ষণ পরেই এসে পড়বেন। আপনারা ততক্ষণ দেখতে থাকুন।’
‘কোথায় গেছেন উনি?’
‘ভালুকপং। কয়েকটা জিনিসপত্র কিনতে।’
‘আমরা তো ওখানেই যাব এরপর।’
কথা বলতে বলতে অর্কিডেরিয়াম ঘুরে দেখছিল ওরা। অন্ততঃ হাজার খানেক প্রজাতির অর্কিড আছে এখানে। বেশীরভাগই স্থানীয়। কিছু বিদেশী প্রজাতির। তোনজিন সব বুঝিয়ে দিচ্ছিল। এমন সময় একটা মাহিন্দ্রা বোলেরো গাড়ি কম্পাউন্ডের ভেতরে ঢুকে আওয়াজ করে থেমে গেল। ডিরেক্টর মানিক দাস গাড়ি থেকে নেমে এলেন।
‘আপনারা? কেমন ঘুরলেন তাওয়াং?’
‘খুব সুন্দর জায়গা। মনাষ্ট্রী আর লেক তো অসাধারণ। সে লা পাস ও। তবে রাস্তা এখনো খুব একটা ভালো না।’
‘কয়েক বছর পরে এলে আর চিনতে পারবেন না। চীনের চাপে এই পান্ডব বর্জিত রাজ্যও বদলে যাচ্ছে।’
‘ভীষণ গরম।’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বিদিশা বলল।
‘বৃষ্টি হবে মনে হয়। আরেকটু উপরে গেলেই আবহাওয়ার কোনো মাথামুন্ডু নেই। পেয়েছেন নিশ্চয়ই। এই এক ঘন্টা ঝকঝকে রোদ, তো এই বৃষ্টি। চলুন, ল্যাবের ভেতরে যাই। ওখানে ঠান্ডা হবে।’
ল্যাবরেটরির ভেতরটা বেশ সাজানো। অনেক কাজকর্ম হয় মনে হল। মানিকবাবুর তৎপরতায় একটা টিস্যু কালচার সেন্টার হয়েছে। জেনেটিক ল্যাবরেটরিরও পারমিশন এসে গেছে। সামনের বছর চালু হবে।
‘ফান্ডিং এর কোনো অভাব নেই, বুঝলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রজেক্ট কি না।’
অরূপ খুব কৌতুহলী হয়ে বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’
‘করুন।’
‘অর্কিড বিষাক্ত হতে পারে?’
‘পারে, দুয়েকটা। তবে খুব মারাত্মক হয় না কখনো। মারাত্মক বিষাক্ত জিনিসও অবশ্য আছে এখানে।’
‘কি সেটা?’
‘মাশরুম।’
একটা সেরামিক পাত্রে গজিয়ে ওঠা উজ্জল কমলা রঙের ছাতা আর সাদা ডাঁটি ওয়ালা কয়েকটা মাশরুম দেখিয়ে দাস বাবু বললেন, ‘ফ্লাই অ্যাগারিক। এখানে কম। ইউরোপে বেশী হয়।’
বিদিশা বলল, ‘কি সুন্দর ব্যাঙের ছাতা!’
‘মানুষ মারতে এর এক ড্রপ রসই যথেষ্ট। মাসকারিন থাকে এতে।’
‘এট্রোপিন ইঞ্জেকশন দিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি।’ বিদিশা মুখ ফসকে বলে ফেলে।
‘ম্যাডাম, আপনি কি ডাক্তার?’
‘না, আমি নার্স। তবে এগুলো আমাদেরও পড়তে হয়েছে।’
‘ইউরোপের মাশরুম এখানে সংরক্ষণ করছেন কেন?’ অরূপ জিজ্ঞেস করে।
‘তা জানি না। ডিপার্টমেন্টের পলিসি। তবে এখানকার লোকাল মাশরুমও আছে। ভালো মাশরুম আবার পুষ্টিকর খাদ্য। গ্রামের লোকেরা চাষ করে। আমরা সাহায্য করি। বেশ লাভজনক ব্যাবসা।’
কিছু কিছু অর্কিড অপূর্ব সুন্দর। অরূপ ওর ক্যানন সেভেন-ডি ক্যামেরায় অনেক ছবি তুলল। মোবাইলে ক্লোজ আপ ছবি ভালো আসে না।
মিউজিয়ামটাও বেশ দেখার মত। ওরা ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর স্যুভেনির শপে কিছু কেনাকাটা করে কোল্ড ড্রিংস খেয়ে গাড়িতে চড়ে বসল। গেট পর্যন্ত আসতে ছাতা খুলতে হল বিদিশা কে। এত রোদ! ভালুকপংয়ে জিয়াভরলি নদীর পাশে আসাম সরকারের ট্যুরিষ্ট লজে উঠবে ওরা। লাঞ্চ বলা আছে।
(চলবে)