মাইকতোলির চাঁদঃ
এবারে আমরা যাবো পিন্ডারি গ্লেসিয়ার ট্রেক করতে। উত্তরাখন্ডের কুমায়ুনে। কথিত আছে পান্ডবরা এখানে পিন্ডদান করেছিল, তাই নাম হয়েছে পিন্ডারি।
আমরা অকাল তখত অমৃতসর এক্সপ্রেসে উঠেছিলাম কলকাতা স্টেশান থেকে ১৩.১০.২০১৯. রবিবার। লক্ষ্মী পুজোর দিন সকাল ৭-৪০ মিনিটে। পরদিন ১৪ ১০.২০১৯ তারিখ সোমবার সকাল ৬ – ১২ মিনিটে পৌঁছে যাই বেরিলি স্টেশানে। এখান থেকে গাড়ি নিয়ে যাই বাগেশ্বর। এখানে কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগমের বাংলোতে থাকি।
এবার আমাদের দল বেশ ছোট। আমরা তিনজন শিশিরদা, কৌশিক আর আমি।
পাহাড়ি রাস্তায় কৌশিকের প্রথমদিনের রুটিন বমি করা ছাড়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে শিশিরদারও বমি করা। শিশিরদা ব্যাপারটাতে খুবই উদবিগ্ন হয়ে পড়ে। বার বার বলতে থাকে, আমার কখনোই বমি হয়না এবার কেন হোলো। আমি বলার চেষ্টা করছিলাম যে কোনো জিনিস তো একবার প্রথমবার হয়। কিন্তু আমার ক্ষীণ স্বর চাপা পড়ে গেল শিশিরদার গলা থেকে বেরনো বমি করার আওয়াজে। যাইহোক কোনো ওষুধে কাজ না হতে এক বিশেষ টোটকা ওষুধ প্রয়োগ করে আমি আর কৌশিক মিলে শিশিরদাকে ঠিক করে বাগেশ্বর নিয়ে এলাম।
বাগেশ্বর জায়গাটা বেশ সুন্দর। সরযূ আর গোমতি নদির সঙ্গমে আছে বাঘনাথ মন্দির। কথিত আছে স্বয়ং শিব বাঘের রূপ এবং পার্বতী গাইমাতা রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এখানে তাই বাঘনাথ নাম এখানে শিবের। আরো কয়েকটা মন্দির আছে বাগেশ্বরে।
১৫. ১০.২০১৯ তারিখ মঙ্গলবার সকালে প্রাতরাশ সেরে আমরা গাড়িতে পৌঁছলাম খারকিয়া। একটা জিনিস বলে নিই।এই যে কি বার কত তারিখ লিখছি, সব বাড়ি গিয়ে ক্যালকুলেশান করে। খবরের কাগজ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক দেহ রেখেছে খারকিয়া থেকেই। তাই দিনকালের হিসেব কিছু ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি তার জন্যে এত আনন্দে ছিলাম, বলে বোঝানো যাবে না। এই খারকিয়া থেকেই আমাদের হাঁটা শুরু বা যাত্রা শুরু। আমাদের সাথে এখানে পরিচয় হয় হন্সির, যার হোম স্টে-তে আমরা জয়কুনে গিয়ে থাকব। এ হচ্ছে মোহন সিংএর বোন। এই মোহন সিংকেই আমরা গাইড হিসেবে কন্ট্যাক্ট করি।
যেহেতু আমরা বর্ষা শেষে এসেছি, চারদিক একেবারে সবুজে ঝক ঝক করছে। রাস্তায় পেলাম ফুলে ফেঁপে ওঠা ঝর্না।খারকিয়া থেকে জয়কুন গ্রাম চার কিলোমিটার মত। রাস্তা প্রথমে দু কিলোমিটার মত নামতে হবে, তারপর মোটামূটি সোজা রাস্তা তারপর চড়াই। আরো দেড় কিলোমিটার গেলে খাটি গ্রাম (২২১০ মিটার)। খাটিতে জনবসতি বেশী। থাকার জায়গাও বেশী। কিন্তু সে তুলনায় জয়কুন অনেক শান্ত জায়গা। লোকজনও কম। আমরা জয়কুনেই ছিলাম। হন্সির হোম স্টেতে।
পথে অনেক ফিরতি ট্রেকারদের সাথে দেখা হোলো। তাদের কেউ কানাকাটা পাস, কেউ সুন্দরডুংহা, কেউ পিন্ডারি করে ফিরছে। পিন্ডারি করে যারা ফিরছে সবাই বলল কয়েকটা জায়গা ধ্বসে বেশ খারাপ হয়ে গেছে। বেশ কঠিন।অধিকাংশ টিমের একজন দুজন কঠিন জায়গাটা পর্যন্ত গেছে তারপর আর যায়নি। তবে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেকার্সদের টিপিক্যাল উৎসাহ দেওয়া কথা, একটু গাইডের হাত ধরে নেবেন কোনো অসুবিধা হবে না। তখন বুঝিনি কিন্তু এই ‘অসুবিধাটা’ ঠিক কতটা। যথাস্থানে বলব।
সন্ধ্যেবেলা এল আমাদের গাইড দেবেন্দার। সাথে পোর্টার নরেন্দার। দুজনেই কম বয়সী ছেলে। ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়স। মোহন সিং নিজে যেতে পারবেনা বলে এদেরকে পাঠিয়েছে। দেবেন্দার কথাবার্তা বলল, তবে একটু চিন্তিত ভাবেই বলল আপনারা তিনজনেই বয়স্ক। তারপর স্বগতোক্তি, তবে চলে যেতে পারবেন। একটু সময় বেশী লাগবে।মিনমিন করে বললাম আমরা গত বছর হর কি দূন করেছি। ও পাত্তাই দিল না, বলল ওখানে তো ওই কালিপাত্তি ধারের চড়াই ছাড়া কিছু নেই। বাকি তো সহজ।
ভাবলাম এটা টিপিক্যাল গাড়োয়ালি আর কুমায়ুনিদের ইগোর লড়াই, কার রাস্তা কত কঠিন আর কোন গাইড কত ভালোভাবে নিয়ে যায়। তাই আবার বললাম, কিন্তু পিন্ডারি তো সহজ ট্রেক… কেউ কেউ মজা করে লেডিজ ট্রেকও বলে। দেবেন্দার চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ সহজ। তবে এখন একটু কঠিন হয়ে গেছে। ‘কঠিন’ ব্যাপারটা বেশী ভাঙ্গলো না। আমরাও অনেক পরে বুঝেছি!
জয়কুনের রাতটা ভুলব না। তখন রাত দুটো আড়াইটে হবে হয়ত। কৌশিক আমাকে তুলে দিয়ে বলল, বাইরে চল। ধড়মড় করে জ্যাকেট চাপিয়ে বাইরে চলে এলাম। সারা বিশ্ব যেন সাদা চাঁদনির চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছে। দিনের আলোয় দেখা সবুজ পাহাড়গুলোর অদ্ভুত মায়াবী রূপ। আর সবার উপরে মাইকতোলি শৃঙ্গের কি স্নিগ্ধ কিন্তু তীব্র রূপ।চাঁদের আলোর প্রতিটা কণা যেন মাইকতোলির গায়ে লেগে প্রাণ পেয়ে আমাদের দেহের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। আমরা চন্দ্রাহত হলাম!
এলাম দ্বোয়ালিতেঃ
পরদিন অর্থাৎ ১৬.১০.২০১৯. বুধবার চলতে শুরু করলাম জয়কুন থেকে। খাটি গ্রাম পেরোলাম, যার কথা যাত্রা শেষে বলেছি। আজকে আমাদের গন্তব্য জয়কুন থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে দ্বোয়ালি (২৫৭৫ মিটার)।
রাস্তা যেমন হয় কখনো একটু চড়াই কখনো উৎরাই। রাস্তার সৌন্দর্য অসাধারণ। রাস্তার এক দিক দিয়ে বয়ে চলেছে নীল রঙের পিন্ডারি নদী।আর আমরা এগিয়ে চলেছি পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে। কখনো বড় বড় গাছের ডালপালা ঢাকা ঠান্ডা রাস্তা দিয়ে, কখনো ঝকঝকে রোদের মধ্যে দিয়ে ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে গরমে ঘামতে ঘামতে যাচ্ছি। কিছু জায়গায় সরু বাঁশের জঙ্গল। দুদিক দিয়ে নুইয়ে পড়া বাঁশের ডালপালা যেন সবুজ তোরণ তৈরি করেছে। নীচে বাঁশ পাতার সবুজ গালিচা। আমরা হেঁটে যাচ্ছি সেখান দিয়ে। নদীর ওপার দিয়ে বা অন্য দিক দিয়েও চলে গেছে পাহাড়ের পর পাহাড়ের সারি। সব শেষে উঁকি দিয়ে যায় তুষার শুভ্র শৃঙ্গ। আর দেখছি অসংখ্য পাহাড়ি ঝর্না, বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে জলপ্রপাত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কখনো আমাদের রাস্তার ওপর দিয়ে বা ছোট্ট সাঁকোর তলা দিয়ে অথবা কখনো সরাসরি… গন্তব্য সেই পিন্ডারি নদী।
চলা শুরুর কিছুক্ষনের মধ্যেই দেবেন্দারকে জানিয়ে দিলাম আমরা একেবারেই অ্যাডভেঞ্চার করতে আসিনি।পাহাড় ভালোবাসি তাই এসেছি। যতদূর যেতে পারব যাবো। এমনকি পিন্ডারি জিরো পয়েন্ট না যেতে পারলেও কিছু যায় আসে না। আমাদের এই কথা আর হাঁটা দেখে দেবেন্দারের হয়ত কিছুটা কনফিডেন্স বাড়ল আমাদের ওপর।নীল আকাশের নীচে পাহাড় ঘেরা জায়গায় সরকার থেকে করে দেওয়া ছোট্ট শেডে প্যাকেটে আনা রুটি সব্জির লাঞ্চ করার সময় জানিয়ে দিল আমরা তিনজনকেই ও জিরো পয়েন্টে নিয়ে যেতে পারবে! আসলে ২০১৩ সালে উত্তরাখন্ডের যে ভয়ঙ্গকর বন্যা হয়েছিল তাতে পিন্ডারির মূল রাস্তা অনেক জায়গাতেই ধুয়ে মুছে গেছে। নতুন রাস্তা নদীর পাশ ছেড়ে অনেক উঁচুতে করতে হয়েছে। তার সাথে এবার সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকের ধ্বস। সব মিলে পিন্ডারির রাস্তা আগের থেকে কঠিন হয়ে গেছে।
আমাদের হিসেবে দ্বোয়ালির কাছে চলে এসেছি তখন। দেবেন্দারকে জিজ্ঞাসা করতে বলল আর এক কিলোমিটারের একটু বেশি আছে। আমরা বললাম তাহলে তো আর আধঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট। ও বলল সামনে বোল্ডার জোন আছে তাই ঘন্টা খানেকের বেশী লাগবে।একটু অবিশ্বাস নিয়েই বোল্ডার জোনের অপেক্ষা করছিলাম। তিনি এলেন।বুঝলাম কেন সময় লাগবে।
জায়গাটা আসলে পিন্ডারি নদী আর কাফনি নদীর সঙ্গম স্থল। ভীষণ ভাবে ধ্বস প্রবণ। যার জন্যে নদীপথগুলোই ছড়িয়ে গেছে। মূল ধারার সাথে সাথে ছোট ছোট আরো ধারা এদিক ওদিক দিয়ে চলে গেছে। আসলে ধ্বসে যেখানে বোল্ডারের বাধা পেয়েছে নদী ঘুরে অন্য রাস্তা খুঁজে নিয়েছে।কোনটি আসল নদী সঙ্গম স্থল, ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না।অনেক দূরে পাহাড়ের ওপর কে এম ভি এন বাংলো দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সামনে এক ফালি ছোট্ট মাঠ ছাড়া বাকিটা প্রায় নব্বই ডিগ্রিতে ধ্বসে গেছে। জানি না আর কতদিন বাংলোটা থাকবে। আমাদের এখনকার রাস্তা ছেড়ে ধ্ব০সের ধ্বংসলীলা দিয়ে নেমে শেষমেষ খাড়া উঠে ওই বাংলোয় যেতে হবে।
যাইহোক লাঠিটা শক্ত করে ধরে নদীখাতে নামতে শুরু করলাম। কোথাও রাস্তা বলে কিছু নেই। এ পাথর ও পাথরের ওপর দিয়ে কখনো দুই পাথরের ফাঁক দিয়ে চলতে লাগলাম। অবশেষে দূর থেকে দেখা সাঁকোটার কাছে চলে এলাম।তিনটি কাঠের গুঁড়ির ওপর কিছু আড়াআড়ি কাঠ বাঁধা। পরে আরো একটা এমন সাঁকো পাবো। যাই হোক নড়বড়ে হলেও যাওয়া যায়। চলে গেলাম ওপারে। এবার যে বোল্ডার জোন এল সেটাই আসল ঝামেলার। বেশ কয়েক জায়গায় চারহাত পা কাজে লাগাতে হোলো। এক জায়গায় এসে একটু আঁতকে উঠলাম যেদিকে দাঁড়িয়ে আছি তার থেকে উঁচু একটা পাথরে উঠতে হবে, দুটো পাথরের মাঝে দু তিন ফুট শূন্যস্থান। দশ বারো ফুট নিচে শুকনো না একটা জলধারা আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেবেন্দার লাঠি বাড়িয়ে দিয়ে ধরতে বলছিল। আমি ঠিক ভরসা পেলাম না।দাঁড়িয়ে শক্তি সঞ্চয় করে মনঃসংযোগ করে লাফিয়ে ওদিকে গেলাম, তিপ্পান্ন বছরের হার্টের ধুকপুকুনি বাড়িয়ে।কৌশিকও চলে এল।
এর মধ্যে শিশিরদা পোর্টার নরেন্দারকে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেছিল। আমরা দেখতেও পাচ্ছিলাম না।ভাবছিলাম বাংলোয় চলে গেল নাকি! তবে আরো কিছু উঁচু পাথর হাঁচড় পাঁচড় করে পার হয়ে দেখলাম একজায়গায় জলের ধারে দাঁড়িয়ে শিশিরদা নরেন্দারকে খুব চোটপাট করছে। কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝলাম। আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ ছিল ‘আগে গেলে বাঘে খায়’। সেটাই হয়েছে। শিশিরদা দ্রুত যেতে গিয়ে পড়ে গেছে। কিন্তু দোষটা নাকি নরেন্দারের। ও নাকি খারাপ রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল! নরেন্দার প্রাণপণে বোঝাচ্ছিল তা নয়, কিন্তু শিশিরদা বুঝবে না। যাই হোক নরেন্দারকে বললাম শিশিরদার ষাটের ওপর বয়স। যেন ঠিকঠাক দেখভাল করে। সাথে ফিসফিস করে নরেন্দারকে কিছু টিপস দিলাম। তারপর থেকেই পুরো ট্রিপ শিশিরদা নরেন্দারের প্রিয় ‘আঙ্কেলজি’ হয়ে গেল। চোট গুরুতর ছিল না। একটু ওষুধ লাগাতে হয়েছিল।
অবশেষে পৌঁছলাম দ্বোয়ালি কে এম ভি এন বাংলোয়। গরম চা খাওয়ানোর বাদে দেবেন্দার চলে গেল রাতের খিচুড়ি ডিম ভাজা বানাতে।
সন্ধ্যের একটু আগেই পিন্ডারি করে আমাদের বাংলোয় চলে এল আমাদের পুরান ট্রেকিং বন্ধুর আর একটা দল.. আর এক কৌশিক, সজল, তীর্থ আর দীপক। অনেক দিন বাদে দেখা হওয়ার উচ্ছ্বাস মেটার পর রাস্তার হালচাল জিজ্ঞাসা করলাম। সজল প্রায় আঁতকে উঠল। দুটো তিনটে জায়গা খারাপ কিন্তু একটা জায়গা খুবই খারাপ। ধ্বসের জায়গায় প্রায় দেয়াল সেঁটে এগোতে হবে, অন্যদিকে খাদ, রাস্তা বলে কিছু নেই। ইত্যাদি।
ওদের কৌশিক স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিমাতে সাহস দিয়ে বলল। চিন্তার কিছু নেই গাইড পেছন থেকে ধরে থাকবে, চলে যাবে। শুধু ওই দুটো মিনিট তোমার মনে হবে একটু বেশী লম্বা।
‘যাত্রা শুরু’ করলাম কিন্তু ‘যাত্রা শেষ ‘করতে পারব তো? চিন্তা নিয়েই শুতে গেলাম।
ক্রমশ…