আমার এক বান্ধবী বছর খানিক আগে ফোন করেছিল আমেরিকা থেকে—“শোনো না, মাকে একটু পাঠাবো তোমার হাসপাতালে। দু পাতা জ্বর সর্দির এন্টিবায়োটিক দিয়ে দিয়ো। আমাদের এক আত্মীয় নেক্সট মান্থে আসবে এখানে। ওষুধগুলো তাহলে সাথে করে নিয়ে আসতে পারবে।”
বান্ধবীটি নিজেই চিকিৎসক। বস্তুত, আমারই কলিগ ছিল এককালে। হাসতে হাসতে তাই ঠাট্টা করলাম খানিক–“কেন রে? তোদের দেশে এন্টিবায়োটিক পাওয়া যায় না?”
উত্তরে মহিলা বলেছিলেন–” না গো। রেজিস্টার্ড ডক্টরের প্রেসক্রিপশন ছাড়া প্রায় কোনো ওষুধই পাওয়া যায় না। আমার রেজিস্ট্রেশন তো এদেশে ভ্যালিড নয়। … তুমি বরং এক কাজ করো। একটা প্রেসক্রিপশনও করে দিয়ো। ইন্ডিয়ায় ছেড়ে দিলেও আমেরিকার এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি আটকে দিতে পারে…।”
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে মিনিট খানিক ধরে ভেবেছিলাম। একমাত্র ঘুমের ওষুধ ছাড়া এদেশে সব ওষুধ পাওয়া যায় দোকানে গেলেই। প্রেসক্রিপশন লাগে না। ঘুমের ওষুধও পাওয়া যেত আলবাত। যায় না স্রেফ এই কারণেই যে, ওটি খেয়ে আত্মহত্যা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, দোকানদারের পুলিশি লাফড়া।
বিশেষ একধরণের কাশির সিরাপ, যার কম্পোজিশন –‘ কোডিন’, এখন মোটের ওপর পাওয়াই যায় না দোকানে। ভারতের দোকানে। প্রেসক্রিপশন পেলেও না। এমনকি কোনো কোনো কোম্পানি তো বন্ধও করে দিয়েছে এই ওষুধের প্রোডাকশন। কারণ কী? না… কারণ হলো এই যে, এই ওষুধটি নিয়ে লোকজন নেশা করে। তাই ভারত সরকারের তরফ থেকে নির্দেশিকা এসেছে– ওষুধটি কোনো দোকানদার বিক্রি করলে, সেই দোকানীকে প্রেসক্রিপশনের কপি/ ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার টুকে রাখতে হবে।
ব্যাস! এত ঝামেলায় যায় কে! ওষুধটা দোকানে রাখাই বন্ধ করে দাও। আরো তো ওষুধ আছে। যেগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই দেওয়া যায় বিন্দাস চোখ বন্ধ করে। কোডিন সিরাপ হঠাও।
এবং যেইহেতু দোকানে রাখা হচ্ছে না, সেই হেতু বিক্রিবাট্টা কম। এবং সেইইই হেতু, কোম্পানিও দিল প্রোডাকশন বন্ধ করে।
অথচ, এ ওষুধ দরকার। কখনো কখনো ভীষণ দরকার। যেসব টিবি রোগীর কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে, তাদের কাশি থামানো/ সাপ্রেস করার জন্য জরুরি। তবুও পাওয়া যায় না মার্কেটে। লাফড়ায় যাবে কে?
তো এই হচ্ছে দেশের অবস্থা। কেউ ভাবেনি। এতদিন। বিন্দাস দোকানে যাচ্ছি আর বলছি র্যালা নিয়ে–” একটা প্যান ফরটি দিন তো।” অথবা কাউন্টারে কনুই রেখে বলছি–” গলা খুসখুসে কাশি। একটা ওষুধ দিন না।”
আমার আউটডোরে আমি যতগুলো খারাপ রোগী পেয়েছি, তার সিংহভাগ এতদিন–” ওষুধ দোকান থেইক্যা দাবাই খাইতে ছিলাম।”
সেই ” খাইতে খাইতে” রোগ যখন মারাত্মক পর্যায়ে, তখন শেষমেশ হাজির হয়েছে কোঁকাতে কোঁকাতে। রোগ ততদিনে বিচ্ছিরি অবস্থায়।
আর ইমারজেন্সি ডিউটির সময় পেয়েছি ‘ব্রট-ডেড’/ মৃত রোগী, যাঁর পরিবার গত আট ঘণ্টা ধরে বুকের ব্যথাতে গ্যাসের ওষুধ খাইয়েছেন দোকান থেকে এনে।
এসব নিয়ে কেউ ভাবেনি এতদিন। বা বলা ভালো, আমরা, চিকিৎসক তথা সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা ছাড়া আর কেউ ভাবিত ছিলেন না। মনে মনে ভেবে নিয়েছিলেন–“হাত বাড়ালেই ওষুধ। বি-ন্দা-স। সাধারণ সর্দি কাশির জন্য কেউ ডাক্তার দেখায় নাকি? বুকে চাপ? ও কিছু না…. গ্যাস জমেছে। অজ্ঞান? ধুর… গ্যাসের ওষুধ খাওয়াও… মাথায় গ্যাস উঠেছে।”
আজ, আরো একবার সুযোগ দিচ্ছে আপনাদের এই পৃথিবী। ভাবুন। রি থিংক। সারা বিশ্বে এখন করোনার আতঙ্ক। অনেক খেটেখুটে বিজ্ঞানীরা এমন দুটি ওষুধ পেয়েছেন, যেগুলো –“মোটামুটি কাজ করছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে।” ওষুধ দুটি এখনো করোনার ওষুধ বলে ঘোষণা হয়নি। তবে, ভবিষ্যতে হতেও পারে। চিকিৎসাটা একটা বিজ্ঞান। এখানে তাই ‘ ট্রায়াল এবং এরর” পদ্ধতি নিতে হয় কখনো কখনো। এই ওষুধ দুটিও সেইভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে, এই ওষুধদুটি ভবিষ্যতে নোভেল করোনার ওষুধ হিসেবে ঘোষিত হবে।
আর শুধু কি তাই? এরকমও হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে এটা স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর ব্যবহৃত হবে। যাতে, সেই স্বাস্থ্যকর্মীরা, যখন বাড়ি ফিরবেন, যেন করোনার জীবাণু বহন করে নিয়ে না যান।
সারা দেশের তো লক ডাউন থাকার কথা। জরুরি পরিষেবার লোকদের ছাড়া। এবং এই জরুরি পরিষেবা প্রদানকারীদের মধ্যেও স্বাস্থ্যকর্মীরা সবচাইতে রিস্কে। এঁরাই করোনা/ সাসপেক্টেড করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসছেন। যাতে তাঁদের থেকে রোগ না ছড়ায় তাই জন্যও এই ওষুধ/ অন্য কোনো ওষুধ ব্যবহৃত হতে পারে ভবিষ্যতে।
কিন্তু পোড়া কপাল। যেই মাত্র সরকারি ভাবে ঘোষিত হলো–” অমুক এবং অমুক ওষুধ পরীক্ষামূলক ভাবে করোনাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও মিলেছে”… ওমনি, সেই ওষুধ দুটি লোকে মুড়ি মুড়কির মতো কিনতে লাগলো। পেয়েও গেল বিনা প্রেসক্রিপশনে।
শেষমেশ এমন পরিস্থিতি দাঁড়ালো যে, সরকারের তরফ থেকে নির্দেশিকা প্রকাশিত হতে হলো–“বিনা প্রেসক্রিপশনের কপি নিয়ে/ চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নিয়ে, এই ওষুধ যেন বিক্রি না হয়।”
এই হলো আমার দেশ।
যদি বেঁচে থাকি, এবং যদি আপনি বেঁচে থাকেন, তবে ভবিষ্যতে এগুলো মাথায় রাখবেন। দাবি উঠুক সর্বত্র। যেন–“এরপর থেকে, প্রেসক্রিপশনের কপি/ রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ছাড়া কোনো ওষুধ দোকানে দেওয়া না হয়।”
শুধু দাবি তুললেই হবে না। সেটা পালন করুন। দোকান থেকে নিজে নিজে ওষুধ কিনবেন না। নয়ত একদিন হয়ত আবিষ্কার করবেন– গলা খুশখুশের ওষুধ বলে যেটা এতদিন খেয়ে খেয়ে সাবাড় করে দিয়েছেন, সেটাই নতুন কোনো রোগের মহৌষধী।
আর একটা কথা।
অনেকেই দেখলাম হা হুতাশ করছেন–” ডাক্তারদের উপযুক্ত বর্ম দেওয়া হচ্ছে না,পোশাক দেওয়া হচ্ছে না করোনা ফাইট করার জন্য।”
অনেকেই দেখলাম এই নিয়েও ব্যথিত যে–” এ দেশে যথেষ্ট পরিমাণে করোনা টেস্টিং ফেসিলিটি নেই।”
তাঁদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার। বলার, জীবনানন্দ স্টাইলে-
“এতদিন কোথায় ছিলেন?”
হেল্থ বাজেটের সময়? সীমান্ত যুদ্ধ কিংবা মন্দির মসজিদে ছিলেন, তাই তো? লড়কে লেঙ্গে অমুকস্তান!
এখন কাঁদলে হবে?
যা যা ভুল করেছেন, তার ফল তো ভোগ করতেই হবে। তাই না?
স্রেফ এটুকু জেনে রাখুন ওই ‘প্রায় নেই’ স্বাস্থ্য বরাদ্দ নিয়েও লড়ে যাচ্ছি আমরা। আমরা স্বাস্থ্য কর্মীরা। লড়ে যাবোও।
আপনারা “ইস আপনাদের জন্য চিন্তা হচ্ছে, কেন যে এই অবস্থা” বলা বাদ দিয়ে, স্রেফ বাড়িতে বসে থাকুন।
যা হবে, আমাদের হোক।
আপনারা ভালো থাকুন।
কিন্তু যদি করোনা পরবর্তীতে বেঁচে থাকেন সব্বাই ,তবে প্লিজ, আরো একবার ভেবে দেখবেন কোনটা জরুরি।
জীবন? নাকি সীমান্ত যুদ্ধ?
ভালো থাকুন
ভাবতে শিখুন।
বাড়িতে বন্দী থাকুন।
অনবদ্য ?