(১০)
নয়া ছত্তিশগড় গড়ে তুলতে গেলে ছত্তিশগড়ের সমস্যাগুলো নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে ভাবনা চিন্তা করা খুব দরকার। অথচ মোটেই সময় করে উঠতে পারছে না সে। এত কাজের চাপ যে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আজকাল আশেপাশের গ্রাম থেকেও লোকজন নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে চলে আসে ইউনিয়ন অফিসে। সবার মুখে এক কথা তুমি আমাদের ‘বাইগা’ তুমি যেমন বলবে তেমন হবে। নিজের বাচ্চাদের জন্য একটুও সময় দিতে পারে না। আশা বিরক্ত হচ্ছে। বাড়িতে এই নিয়ে ঝামেলা লেগে যাচ্ছে প্রায়ই। কিন্তু এসব ছোটখাটো সমস্যা শংকরকে ছুঁতে পারে না। সাময়িক যন্ত্রণা দেয় ঠিকই। কিন্তু সে সব ব্যক্তিগত অনুভূতি নির্মমভাবে দমন করতে জানে শংকর গুহ নিয়োগী। তাকে এগিয়ে যেতে হবে বৃহত্তর লক্ষ্যে। আজ ইচ্ছে করেই একা পালিয়ে এসেছে রাজহরা পাহাড়ের কোলে নির্জন এই জঙ্গলে। এই মাথা তুলে দাঁড়ানো বৃক্ষরাজি ওকে মনে সাহস জোগায়। যেন শিক্ষকের মতো একতা আর সংহতির পাঠ শেখায়। ইউনিয়নের কাজ বেশ ভালই এগোচ্ছে। এখন শুধু দরকার এদের নিজেদের মতো স্বাবলম্বী করে তোলার। তাকে এখানের কাজ শেষ করে বেরোতে হবে। মনের মধ্যে অনেক চিন্তা পাক খেতে থাকে। ছত্তিশগড়ের আদিবাসী জনজীবনে এক নতুন জাতি সত্ত্বা জাগিয়ে তোলা দরকার। ছত্তিশগড়কে প্রধানতঃ তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে নিলে বুঝতে সুবিধা হয়। শহরাঞ্চল, সমতল্ভূমি আর পাহাড় ও জঙ্গল। অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে, চার থেকে পাঁচ রকম ভাগ দেখা যায় যেমন শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য,কৃষি, জঙ্গল। শংকর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়। শিল্পের ক্ষেত্রে বড়ো ছোট সব ক্ষেত্রেই পুঁজি বিনিয়োগকারী যারা তারা বেশীর ভাগই পাঞ্জাবি, মারোয়াড়ী, সিন্ধ্রি। শ্রমিকদের কথা ধরলে দক্ষ শ্রমিক বেশির ভাগই বাইরের লোক, অদক্ষ শ্রমিকরা বেশির ভাগ ছত্তিশগড়ী। ব্যবসা বাণিজ্যতেও সেই অবস্থা। পাঞ্জাবি। মারোয়াড়ি, সিন্ধ্রিরা এসে এখানে মহাজনী ব্যবসা চালাচ্ছে। শিল্প, খনি, জঙ্গলের ঠিকাদারি ব্যবসাও অ-ছত্তিশগড়ীদের কুক্ষিগত। কৃষিজীবী মানুষের বেশির ভাগ অবশ্য ছত্তিশগড়ী। চাষবাসের সাথে যুক্ত মানুষের মধ্যে যে শ্রেণীগুলো আছে তাতে পড়ে ভূমিহীন, গরীব ও মধ্যবিত্ত কৃষক,অবস্থাপন্ন কৃষক আর জমিদার গোষ্ঠী। নতুন কিছু জমিদার উদ্ভুত হয়েছে যারা অ-ছত্তিশগড়ী। আর কৃষকদের ছোট্ট একটা অংশ আদিবাসী উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ যারা ছত্তিশগড়ের মানুষের সাথে এখনও মিলতে পারে নি। এই প্রতিটা ক্ষেত্রে অ-ছত্তিশগড়ীদের হাতে ছত্তিশগড়্রের ভূমিপুত্ররা শোষিত ও নির্যাতিত। ছত্তিশগড়ের মানুষকে এই সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, আধা সামন্ততান্ত্রিক শোষক শ্রেণী, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গেলে নিজেদের জাতি সত্ত্বা সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। এরা কখনই চায় না ছত্তিশগড় অঞ্চলের সামগ্রিক বিকাশ হোক। এখন প্রশ্ন হল এই আন্দোলনের শক্তি ও নেতৃত্ব কারা দেবে? শংকর চিন্তায় মগ্ন হয়ে জঙ্গলের পথে আনমনে ঘুরে বেড়াতে থাকে। এখানে এলে সে যেন এক অদ্ভুত শান্তি পায়। তার মনের মধ্যে পাঁক খেতে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর হঠাত করেই মাথায় খেলে যায়। একটা পূর্ণ জাতির মর্যাদা পেতে গেলে রাজনৈতিক সার্ব্বভৌমত্ব জরুরী। আকাশের গায়ে ভেসে থাকা কালো মেঘের অন্তরাল থেকে তীক্ষ্ণ সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়। সোনার পাড় ঢাকা মেঘের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে এই সমাজ গবেষক। এখানকার জাতিগত আন্দোলনের বিকাশের লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে প্রথম ধাপ হল চেতনার বিকাশ আর আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার। এখন শংকরকে যেটা করতে হবে সেটা হল ছত্তিশগড়ী মানুষের সামনে তাদের ইতিহাসকে এনে দাঁড় করাতে হবে। যাতে তারা নিজেদের সত্ত্বাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারে। চাই এমন একজন চরিত্র যাকে সামনে রেখে আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে ওরা।
সোনাখান যেতে হলে কসডৌল হয়ে যেতে হয়। নির্জন এক রাস্তা ধরে কসডৌল পেছনে রেখে শংকর আর সাহু সামনের দিকে এগিয়ে পড়ল। সামনে জোঁক নদী। নদী পেরিয়ে দক্ষিণের দিকে এগিয়ে পড়ল ওরা। সোনাখান যাওয়ার সিদ্ধান্ত সংগঠনের পক্ষ থেকেই নেওয়া হয়েছে। সোনাখান শহীদ বীরনারায়ণ সিং এর জন্মভূমি। কে ছিলেন এই বীর নারায়ণ সিং? তিনি ছিলেন সোনাখানের জমিদার। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরাজেদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তিনি। বলা চলে স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধে ছত্তিশগড়ের প্রথম শহীদ। । ১৮৫৬ সালে সোনাখান ও আশেপাশের অঞ্চল জুড়ে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ চলছে। ইংরেজের দালাল জোতদারের গোলায় খাদ্য শস্য মজুত থাকা সত্ত্বেও সে প্রজাদের দিতে রাজি নয়। তখন বীর নারায়ণের নেতৃত্বে লুট করা হল মজুত শস্য, ইংরেজদের হাতে বন্দী হলেন গোন্দ জাতির বীর নারায়ণ। অবশ্য জেল থেকে পালালেন কিছু দিন পর। সোনাখানে পালিয়ে এসে ৫০০ সৈন্য নিয়ে একটা ফৌজ গঠন করলেন তিনি। ইংরেজ সরকার খবর পেয়ে বিশাল সেনা পাঠালো বীর নারায়ণ সিং কে পরাস্ত করতে। ইংরেজদের সাথে লড়তে লড়তে ওদের গোলা বারুদ সব শেষ হয়ে যায়। বীর নারায়ণ সিং ধরা পড়েন। তাঁকে রায়পুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে বিচারের পর ফাঁসি দেওয়া হয়। গিন্ডোলার কাছে এসে দেখা গেল সারা জায়গা জুড়ে শুধু পাথর আর পাথর। শংকর পাথরগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে, ছোট বড় মাঝারি নানা আকারের পাথর পড়ে আছে চারপাশে। এই পাথরের গায়ে যেন লেখা আছে বীর নারায়ণ সিং-এর নেতৃত্বে শুরু হওয়া একশো পঁচিশ বছরের পুরোণো সংগ্রামের গল্প। যেন মনে হল নারায়ণ নিজে শংকরের কানে কানে বলে উঠলেন, “কী দেখছ, তোলো এই পাথর, জোতদার আর ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলাম, আমার অপূর্ণ সেই সংগ্রামকে বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার, তোমাদের।“
শংকরের মন ছুঁয়ে যেতে লাগল এই অঞ্চলের বাতাস, গাছপালা, ঝরণা সব কিছু। সব কিছুতেই যেন সেই অপূর্ণ ইচ্ছার প্রতিচ্ছায়া। সেগুন, বিজা, কররা, সেলহা, বেল, আমলকী গাছের জঙ্গল পেরোতে পেরোতে সে মন ঠিক করে নিল। এই অঞ্চলের এক খন্ড ইতিহাসকে সে তুলে নিয়ে গিয়ে রোপণ করবে সমগ্র ছত্তিশগড়ের সংগ্রামী মানুষের মনে। বীর নারায়ণ সিং হোন তাদের রোল মডেল।
পরের দিন ভোরে শংকর আর সাহু পৌঁছে গেল সোনাখান গ্রামে। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানল আজও তারা দশহরার দিন স্মরণ করে বীর নারায়ণ সিংকে। গ্রামের পশ্চিমদিকে ছোটখাটো একটা পাহাড় আছে নাম কুরুপাট ডোংরী। এখানেই বীর নারায়ণ সিং কুরুপাট দেওতার পুজো করতেন। গ্রামবাসীদের কাছে শুনল ওরা আজও দশহরার দিন সংলগ্ন আঠেরোটা গ্রামের লোক এখানে পুজো দিতে আসে। ১৮৫৬-৫৭ সালের বিদ্রোহের দিনে এই আঠেরোটা গ্রামের কৃষকদের রক্ত এই মাটিতেই চুইয়ে চুইয়ে পড়েছে। তারা শোষণহীন এক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিল। সেই স্বপ্ন কি সফল হয়েছে? তারা কি আজও সেই স্বপ্ন দেখে। শংকরের মাথায় ঘুরতে থাকে ভাবনাগুলো। একটা লোককে শহীদ করে দিলেই কি বিদ্রোহ থেমে যায়। বিদ্রোহ তো আসলে সময়ের প্রতিরূপ। সময় কে কি ঠেকিয়ে রাখা যায়? শংকর জড়ো হওয়া গ্রামের মানুষদের কাছে জানতে চায়, “বীর নারায়ণ সিং-এর কি প্রয়োজন আছে?” ওদের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। সমস্বরে বলে ওঠে, “আছে, আছে!” কমরেড নিয়োগী বোঝে ছত্তিশগড়ের বুকে বিদ্রোহ দানা বাঁধছে তাতে নতুন গতি সঞ্চার করার এই প্রকৃষ্ট সময়।