(১২)
বিলু মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, বসে আছে আদিবাসী মহিলারা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু পুরুষ আছে বটে তবে বিশ পঁচিশ জন মহিলার তুলনায় সে সংখ্যাটা নেহাতই নগণ্য। সি এম এস এস -এর এই ক’জন পুরুষ কর্মীরা এই আসরে শুধুই নীরব দর্শক বলা চলে। বিলু-র বউ ভিড়ের সামনের সারিতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার রাগত চোখের দৃষ্টি বিলুর মুখের ওপর আটকে আছে। বিচার একটা চাই তার। মহিলা মুক্তি মোর্চার বর্তমান সভাপতি জানকী বিলুর দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় নির্দেশ দেয় তাকে দারু পান করার স্বপক্ষে আধ ঘন্টা সবার সামনে বক্তব্য রাখতে হবে। বিলু সংকোচে সিঁটিয়ে যায়। এ নিয়ম চালু করেছে মহিলা মুক্তি মোর্চা বাহিনী। শরাবের নেশা ছাড়খার করে দেয় তাদের পারিবারিক জীবন। বিলু-র বউ এসে ইউনিয়ন অফিসে অভিযোগ জানিয়েছিল বিলু গত রাতে মদ খেয়ে বউকে ধরে ঠেঙিয়েছে। কমরেডের তত্ত্বাবধানে দল্লি রাজহরায় শরাব বন্দী আন্দোলন জোরদার চলছে। মদ খেয়ে পরিবারের ওপর অত্যাচার করলে সে খবর ইউনিয়ন অফিসে পৌঁছলে তাকে ডেকে পাঠানো হয় সেখানে। সবার সামনে আধ ঘন্টা মদ খাওয়ার উপকারিতা সম্বন্ধে বলতে বলা হয়। শাস্তি প্রমাণ হলে ক্ষতি পূরণ বাবদ টাকা আদায় করা হয়। সেই টাকার ৫% কি ১০% ইউনিয়ন ফান্ডে জমা করে বাকি টাকা লুকিয়ে পৌঁছে দেওয়া হয় বউয়ের হাতে। মহিলা মুক্তি মোর্চা সি এম এস এস এর জন্মলগ্নের কিছু পরেই তৈরি হয়। উদ্দেশ্য ছিল মহিলা শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং তারা যাতে তাদের নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে পারে তার রাস্তা খুলে দেওয়া। অনুসূয়া বাঈ এর শহীদ হওয়া শ্রমিক মহিলাদের জেদ যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা শাসকের রক্ত চক্ষুকে ডরায় না। বিশেষতঃ এই শরাব বন্দী আন্দোলনে তাদের সক্রিয় ভূমিকা এই আদিম জনজীবনে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। কিন্তু শরাব ছাড়ো বললেই কি ছাড়া যায়? অনেক মরদই আছে যারা বোঝে তারা মদ খাচ্ছে না মদ তাদের খাচ্ছে। কিন্তু ছাড়তে পারছে কই? তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্ধ্যের সময়টা ইউনিয়নের নেতারা সেই সব নেশাড়ুদের নিজেদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরত। তাতে করে সন্ধ্যের সময়টা পেরিয়ে গেলে মদ খাওয়ার অবসর মিলত না আর। উপরন্তু নেতাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে তাদের চিন্তা ভাবনা, কাজকর্ম, জীবনের মান উন্নয়নের চিন্তা এই সব নেশাড়ুদের জীবনে একটা প্রভাব ফেলত। শংকর জানে আন্দোলনকে জনতার আন্দোলন করে গড়ে তুলতে গেলে কেবল নেতা হলে চলবে না। প্রতিটা সাধারণ মানুষকে যুক্ত করতে হবে এই সব আন্দোলনের সাথে। বিলু চাপের মুখে পড়ে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে। জানকীর কড়া জুবান শ্লেষ মাখা চাহনি আর নিজের বউয়ের ঘৃণা যেন কাঁটার মতো বিঁধছে ওকে। এখন আর মদের ঘোর নেই তাই লজ্জা আর অপমান টের পাচ্ছে। অবশেষে রফা হল এখন থেকে সন্ধ্যের দিকে তাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কমিটির মেম্বার হতে হবে। এই কমিটি শ্রমিকদের মনোরঞ্জনের জন্য সন্ধ্যার দিকে নাটক, লোকগীতি, লোক নৃত্যের আয়োজন করে। উদ্দেশ্য একটাই মদ থেকে শ্রমিকদের দূরে সরিয়ে রাখা। তাছাড়া এই সব অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তাদের মনের সুকুমার বৃত্তিগুলোর পরিচর্যা সম্ভব।
শংকর মাঝে মাঝেই টিলার সুঁড়ি পথ বেয়ে ওপরে চড়ে জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। ঘন জঙ্গলের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে তার মাথায় বিভিন্ন চিন্তা পাক খেতে থাকে। যদি সংঘবদ্ধ ভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হয় এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয় তবে শ্রমিক-কৃষক জোট বেঁধে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে হবে। বিভিন্ন ভাবনা মাথায় ঘুরতে থাকে। কত কাজ বাকী আছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, তাদের বাচ্চাদের শিক্ষা, মানুষ হিসাবে প্রাপ্য সম্মান এসবের জন্য ওদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য উদবুদ্ধ করার আগে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে সঠিক নেতা নির্বাচন অত্যন্ত জরুরী বিষয়। সংগঠন বা আন্দোলনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের প্রশ্ন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একজন সাধারণ মানুষের ভুল চিন্তা বা কাজে খুব বেশি মানুষের ক্ষতি হয় না। কিন্তু নেতৃত্বের ভুল চিন্তা বাঁ কাজের প্রভাব লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে পড়তে পারে। সে প্রভাব ভালও হতে পারে বা সে প্রভাব খারাপও হতে পারে। সাহসের সঙ্গে শ্রেণী সংগ্রামে অংশগ্রহণই হল নেতৃত্বের প্রথম পরীক্ষা। দ্বিতীয় পরীক্ষা হল উৎপাদন সংগ্রাম। উৎপাদনে আগ্রহ নেই এমন কাজে ফাঁকি দেওয়া লোক নেতা হওয়ার যোগ্য নয়। দেওয়ালির আগে যেমন ঘরের ঝুল ঝেড়ে পরিস্কার করতে হয় সেরকম শ্রমিকদের উচিত এই সব কর্ম বিমুখ নেতাদের চিহ্নিত করে ঝেঁটিয়ে ইউনিয়ন থেকে বের করে দেওয়া। কে হতে পারে উপযুক্ত নেতা? আজকের ভারতে যে নেতারা অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়নের মাথা হয়ে বসে আছে তারা মার্ক্স লেনিনের বই পড়ে একটু আধটু, মাঝে মাঝে তার থেকে উদ্ধৃতিও তুলে ধরে বক্তৃতার সময় । আপীল আবেদন লেখায় এরা ওস্তাদ। কিন্তু উৎপাদনে প্রতি এদের প্রবল অনীহা। ঘরোয়া ঝগড়াকে আন্তর্জাতিক বা ঐতিহাসিক তাৎপর্যের আলোকে বিচার করে। যা বলে তা করে না আর যা করে তা বলে না। সফল নেতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পরিস্থিতির জ্ঞান এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে সেই জ্ঞান প্রয়োগ করার ক্ষমতা। সততা আর আত্মত্যাগ নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতোই নেতার স্বাভাবিক গুণ হওয়া উচিত। মহৎ হওয়ার আকাংক্ষায় নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা না করাই শ্রেয়। অথচ আজকে ভারতের পরিস্থিতি দেখে বুঝে হতাশা গ্রাস করে মনে। মদের নেশায় সারা দেশ আচ্ছন্ন। মহিলাদের অপর অত্যাচার হয়ে চলেছে। ট্রেড ইউনিয়নের কেবল একটাই কর্মসূচী— বোনাস দাও, বোনাস দাও। বেতন বাড়ে জিনিসের দাম আরও বাড়ে। ঠিকাদার পয়সা বাড়ায়, মদের কারবারি তা লুটে নিচ্ছে। ঘরে বৌ মার খায় বাচ্চা না খেতে পেয়ে কাঁদে, শ্রমিকের জীবনের মান উন্নত হয় কই? হাওয়ায় ভর করে জঙ্গলের বুনো গন্ধ ছড়িয়ে যেতে থাকে চারপাশে। বুক ভরে নিশ্বাস নেয় শংকর। তার চেতনার গভীরে জন্ম নেয় যে অবসাদ তা যেন কবিতা হয়ে ঝরে পড়তে চায়। অবসাদ প্রয়োজন, সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন, নির্মাণের জন্য প্রয়োজন।