আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।
মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি।
-মানুষ, নির্মলেন্দু গুণ।
“মানুষ নিয়ে লিখতে হবে তোমায়। ডাক্তাররাই তো বিভিন্ন ধরনের মানুষকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়।” সম্পাদক মশাই বলেই খালাস। ডাক্তার বলেই কি মানুষ চিনতে হবে নাকি? মানবশরীরের অ্যানাটমি, ফিজিওলজির গভীরে যে মানুষটা লুকিয়ে আছে তাকে চেনা কি এতোই সহজ? সার্জারির পুরো জ্ঞান নিয়ে ছেঁড়াখোড়া করলেও কোন অতল থেকে কি মানুষটাকে তুলে আনা যায়?
আর অর্ধাঙ্গিনী দ্ব্যর্থহীন ভাবে রায় দিয়েছেন যে আমি একেবারেই মানুষ চিনতে পারি না। ভাগ্যিস তিনি আমার জীবনের হাল ধরেছেন। জনজঙ্গলের শ্বাপদরা কবেই নাহলে আমাকে শেষ করে দিতো। অবশ্য কু-লোকে বলে স্ত্রীরা এরকম কথা সব স্বামীদের বলে থাকে। আমি সেইসব বাজেবকা লোকেদের কথা একদমই বিশ্বাস করি না।
সদ্য তখন বিয়ে হয়েছে। আমার এক চেনা ভদ্রলোক হাজার পাঁচেক টাকা ধার চাইলো। দুতিন মাসের মধ্যে ফেরত দিয়ে দেবে। তখন আমার মাস মাইনেই সাত হাজার টাকা। মিসেস আড়চোখে তাকানো ছাড়া আর কিছু বলেননি। (তখন মিসেসকে খুব একটা ভয় পেতেও শিখিনি।) তিন মাসের জায়গায় ছ’মাস পেরিয়ে যাবার পর ও জানালো যে ওই টাকাটা আমি কোনোদিনই ফেরত পাবো না। হন্তদন্ত হয়ে সেই ভদ্রলোকের কাছে গেলাম। বেচারি সত্যিই একটা অসুবিধায় পড়ে গেছে। এর মধ্যে তার ট্রান্সফার অর্ডার হয়েছে কোন এক ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে। বাঁধাছাঁদা সারা, পরদিন বেরিয়ে যাবে নতুন ঠিকানায়। আমার কাছে সেই রাতেই আসার পরিকল্পনা ছিল তার। পুরো ব্যাপারটা জানানোর জন্য। আমার অ্যাকাউন্ট নাম্বার নিয়ে নিল। দুতিন মাসের মধ্যে মানি ট্রান্সফার করে দেবে।
ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে ফেরার পর সেই প্রথম মিসেস বলেছিলেন যে আমি একদম মানুষ চিনতে পারি না। দুতিন মাস থেকে দুতিন বছর প্রায়শই ব্যাঙ্কের পাসবইটা লুকিয়ে খুঁজে দেখতাম কোনো অচেনা অ্যাকাউন্ট থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঢুকেছে কিনা। দুই দশক পেরিয়ে গেছে। সেই ভদ্রলোকও শুনেছি ভালোই আছে। তবু এখনো আমি মাঝেমধ্যে ব্যাঙ্কের পাসবইতে “বিশ্বাস” খুঁজে ফিরি।
তবে চিনতে পারি বা না পারি, পেশার স্বার্থে অনেক মানুষের কাছাকাছি আসতে পাই। অনেক মুখ স্মৃতির অ্যালবামে সাজিয়ে রেখেছি। সেই মানুষগুলোর গল্প শুরু করলে ব্যাসদেবের মহাভারত হয়ে যাবে। তবু কিছু কিছু কথা তো বলাই যায়। নামগুলো শুধু পালটে যাক।
রতন ঘোষের কথা যেমন। টাকাপয়সার গল্প রতনের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে। রতন ঘোষের ছেলে আমার আন্ডারে ভর্তি হয়েছিল মাথায় আঘাত পেয়ে। সাত বছরের ছেলে, নিয়ম অনুযায়ী ফিমেল ওয়ার্ডে ভর্তি হবার কথা। কিন্তু রতন কোনো মহিলা সঙ্গে আনেনি। তাকে বললাম যে ছেলে নিয়ে মেল ওয়ার্ডে চলে যেতে। বাবু যাবে না। রতনের ফিমেল ওয়ার্ডের কোনের বেডটাই পছন্দ। একবার যখন ওখানে বেড দেওয়া হয়েছে তখন কার পিতৃদেবের সাধ্য তাকে ওখান থেকে নড়ায়। ওয়ার্ডের অন্যান্য মায়েদের তীব্র প্রতিবাদ গায়ে না মেখে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে রতন। ছেলেটার ছোটবেলায় মা মারা গেছে। সুতরাং ওর বাবাই এখন মা। সেই অকাট্য যুক্তি শুনে স্তম্ভিত আমি অন্য কাজে চলে গিয়েছিলাম। রাতে কলবুক পেলাম যে রতনের ছেলের অবস্থার অবনতি হয়েছে। গিয়ে দেখলাম মাথার ভেতরে আঘাতের কিছু সিম্পটম ছেলেটার শুরু হয়েছে। তড়িঘড়ি রেফার করলাম কলকাতায়। কিন্তু রতন কিছুতেই কোন ছাড়া হবে না। বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম ওর অসুবিধেটা কোথায়। হড়বড় করে বলা অনেক কথার সারমর্ম যা তাতে বোঝা গেল যে রতনের ছেলেকে কলকাতা নিয়ে যাবার মতো টাকা নেই। এবং বাড়ি থেকে ফোন করে কাউকে দিয়ে টাকা আনানোরও কোনো উপায় নেই। এই জগৎসংসারে রতনের ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। এবং ভাইস ভার্সা। বিরক্ত হয়ে কিছুটা বোকার মতো পাঁচশো টাকা রতনের হাতে ধরিয়ে বলেছিলাম -“যত তাড়াতাড়ি পারো বিদেয় হও।”
স্ত্রীকে এই গল্প শোনালে আবারও অপদস্ত হবো। বেমালুম চেপে গিয়েছিলাম ব্যাপারটা।
সাতদিন বাদে আবার রতনের সঙ্গে দেখা। আমি আউটডোরে ঢোকার আগেই আমার খোঁজে সারা হাসপাতাল তোলপাড় করে ফেলেছে সে। যার সাথে দেখা হয় সে-ই জানায় যে একজন আমাকে খুঁজছে। শেষপর্যন্ত আউটডোরের গেটের মুখে মোলাকাত। আরও একপ্রস্ত বেশি পাগল হয়েছে। চুল এলোমেলো। আমার হাতে খুচরো পাঁচশো টাকা গুঁজে দিয়ে বলে -“গুনে নিন।’
গুচ্ছের দশটাকা গুনতে গুনতে রতনকে জিজ্ঞেস করি ছেলে কেমন আছে।
“কাল রাতে মারা গেছে, বাবু”।
চমকে উঠে রতনের মুখের দিকে চাই। চোখ দিয়ে জল পড়ছে না। অথচ এতো আকুল হয়ে কাউকে কাঁদতে দেখিনি।
মানুষের ওপর বিশ্বাস ফিরে পাবার ঘটনাটা চেষ্টা করেও মিসেসকে বলতে পারিনি আজও।
লেখাটি কৃষ্ণনগরের কাগজপত্র পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে বেরোচ্ছে।
দুই সম্পাদকের অনুমতিক্রমে ই-ফর্ম্যাটে পুনঃপ্রকাশিত।
অসাধারণ!!
💐💐💐🙏🙏🙏🌹🌹🌹
Sir, আপনার অসাধারণ লেখনির মাধ্যমে চোখের সামনে সমস্ত গল্প টা ছবির মতো ফুটে উঠেছে।মন টা বড্ড ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।
Thank you Riyanka😊🙏