ছত্তিশগড়ে কাজ করার সময় কোমর ব্যথা দেখতাম লোহা খনির ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকদের মধ্যে। ঝুঁকে লোহা পাথর ভর্তি ঝুড়ি তুলতে গিয়ে তাঁদের কোমরে হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা দেখা দিত—ডাক্তারী পরিভাষায় এ রোগের নাম প্রোলাপ্সড ইন্ট্রাভার্টিব্রাল ডিস্ক বা স্লিপড ডিস্ক।
এখন যেখানে কাজ করি সেখানকার প্রধান অসংগঠিত শিল্প জরি শিল্প। এ শিল্পে দিনে ১৪-১৬ ঘন্টা একভাবে বসে কাজ করতে হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জরি শ্রমিকরা আরেক ধরনের কোমর ব্যথায় ভোগেন—যার নাম মেকানিকাল বা যান্ত্রিক কোমর ব্যথা।
এছাড়া দুর্ঘটনায় বা পড়ে গিয়ে কোমরে লেগে ব্যথাতো আছেই।
কোমরে ব্যথা বা low back pain সারা পৃথিবীরই এক গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যথার কারণ হিসেবে মাথা ব্যথার পরেই কোমর ব্যথার স্থান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক তথ্যে দেখা যায়—এডস, ক্যান্সার ও মস্তিষ্কের স্ট্রোক মিলিয়ে যত কাজের দিন নষ্ট হয়, তার চেয়েও বেশী দিন নষ্ট হয় কোমর ব্যথায়।
কোমরের গঠন
বিষয়ে ঢোকার আগে মেরুদন্ডের গঠন সম্পর্কে কিছু জেনে নিলে সুবিধা হবে।
মানুষ মেরুদন্ডী প্রাণী, অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রাণী থেকে মানুষের বড় পার্থক্য হল, সে দু’পায়ে হাঁটে। দু’পায়ে হাঁটার জন্য তাকে যে মাসুলগুলো দিতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম কোমর ব্যথা।
ভ্রূণ যখন মায়ের পেটে থাকে, তখন হাত-পা গুটিয়ে কুঁকড়ে থাকে সামনের দিকে, তার মেরুদন্ড থাকে ধনুকের মত পিছন দিকে বাঁকা। জন্মের মোটামুটি ৬ মাস পরে বাচ্চা যখন মাথা তুলতে শেখে, তখন মেরুদন্ডে গলার কাছটায় একটা বক্রতা তৈরী হয়, যার উত্তল দিকটা সামনের দিকে। যখন সে দুপায়ে দাঁড়াতে শেখে, তখন তার কোমরের অঞ্চলে আরেকটা অগ্রবক্রতা তৈরী হয়।
সুষুম্নাকান্ডকে রক্ষা করা ছাড়া মেরুদন্ডের আরেকটা বড় কাজ হল শরীরের ওজনকে বহন করা। দাঁড়ানো অবস্থায় শরীরের ওজন মেরুদন্ড বেয়ে কোমরের নীচের হাড় শ্রোণিচক্র (পেলভিস) ও শ্রোণিচক্র থেকে দুই পা বেয়ে জমিতে চলে আসে।
কোমরে ব্যথার জন্য দায়ী হল মেরুদন্ডের সামনে-পেছনে, ডাইনে-বাঁয়ে বাঁকার ক্ষমতা। ঘাড় ও কোমরে মেরুদন্ড সবচেয়ে সচল।
মোট ৩৩টা ছোট ছোট হাড় (কশেরুকা) পুঁতির মালার মত একটার ওপর একটা বসিয়ে তৈরী মানুষের মেরুদন্ড—ঘাড়ে ৭টা, বুক-পিঠে ১২টা, কোমরে ৫টা, তার নীচে ৫টা একসঙ্গে জোড়া হাড়, তারও নীচে ৪টা একসঙ্গে জোড়া হাড়। জটিলতা এড়াতে নামগুলো মনে রাখার দরকার নেই।
যেসব কশেরুকা নড়াচড়া করতে পারে তারা পরস্পরের সঙ্গে কয়েক ধরনের জোড় বা অস্থিসন্ধি এবং বন্ধনী বা লিগামেন্ট দিয়ে যুক্ত।
মেরুদন্ডের একেকটা হাড় অর্থাৎ কশেরুকা দেখতে যেন পাথর-বসানো আংটির মত। মাঝখানের ফুটোটা দিয়ে সুষুম্নাকান্ড নামে। ফুটোর সামনের অংশকে কশেরুকা কান্ড বলে, পেছনের অংশকে কশেরুকা খিলান বলে।
দুটো কশেরুকা কান্ডের মধ্যে থাকে একটা করে মেরু চাকতি (intervertebral disc)। উপাস্থি বা কার্টিলেজ দিয়ে তৈরী এই চাকতিগুলোর বাইরের দিকটা রবারের মত নরম আর চাকতির ভেতরের অংশটা জেলির মত—যাকে বলে চাকতি মজ্জা। চাকতি মজ্জাকে ঘিরে থাকে একটা শক্ত আবরণী, যা পর পর দুটো কশেরুকা কান্ডকে ধরে রাখে। দুটো কশেরুকার মধ্যে থাকা এই নরম গদির মত মেরু চাকতির জন্য আমরা মেরুদন্ডকে সামনে-পেছনে, ডাইনে-বাঁয়ে বেঁকাতে পারি।
সামনে ঝুঁকে কোনও ভারী জিনিস তোলার সময় অনেক ক্ষেত্রে মেরু চাকতির আবরণী ফেটে গিয়ে চাকতি মজ্জা মেরু নালী বা মেরু ছিদ্রে ঢুকে যেতে পারে। মেরুনালীতে সুষুম্নাকান্ড ও তা থেকে বের হওয়া স্নায়ুর গোড়াগুলো থাকে। সেগুলোর ওপর বেরিয়ে আসা চাকতি মজ্জা চাপ দিলে কোমর থেকে পায়ে ব্যথা নামে—সাধারণ কথায় এ ব্যথাকে বলা হয় সায়াটিকার ব্যথা।
কোমরে ব্যথার কারণ
কারণগুলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।
১। জন্মগত কারণ—কশেরুকার দুদিকের খিলানের মধ্যে ফাঁক থাকা (spina bifida), কশেরুকার কান্ডের অর্ধেকটা তৈরী না হওয়া (hemivertebra), কোমরের কশেরুকা কোমরের নীচে ৫টা জোড়া কশেরুকার মত হওয়া (sacralisation of lumbar vertebra), কোমরের নীচের ৫টা জোড়া কশেরুকা কোমরের কশেরুকার মত হওয়া (lumbarisation of sacral vertebra)।
এছাড়াও আরও দুটো কোমর ব্যথার গুরুত্বপূর্ণ কারণকে অনেকে জন্মগত কারণ বলে মনে করেন—খিলান বিকার (spondylolysis) ও কশেরুকা ভ্রংশ (spondylolisthesis)।
২। আঘাতজনিত কারণ—কোমরের পেশীর আঘাত ও মেরুদন্ডের আঘাত—কশেরুকাভঙ্গ (fracture) বা কশেরুকাচ্যুতি (dislocation)।
৩। প্রদাহজনিত কারণ—কশেরুকার যক্ষ্মারোগ (caries spine বা TB spine), পূঁজসৃষ্টিকারী মেনিনজাইটিস (pyogenic meningitis), যক্ষ্মাজনিত মেনিনজাইটিস (TB meningitis), রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, আংকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস।
৪। টিউমারজনিত কারণ—কশেরুকার বিভিন্ন টিউমার, স্নায়ুমূলের টিউমার, সুষুম্নাকান্ডের আবরণীর টিউমার থেকেও কোমরব্যথা হতে পারে। কোন টিউমার নিরাপদ (benign), কোনটা মারাত্মক (malignant)। এছাড়া শরীরের অন্য জায়গার ক্যান্সার কোষও রক্তস্রোতে ভেসে এসে মেরুদন্ডে জমা বাঁধতে পারে। ক্যান্সার ছাড়াও অনেক ধরনের মারাত্মক রোগের বাসা বাঁধার প্রিয় জায়গা মেরুদন্ড, এমনই একটা রোগ মাল্টিপল মায়েলোমা। এসব রোগেও কোমরে ব্যথা হয়।
৫। বুড়িয়ে যাওয়া—মেরুদন্ডের বিভিন্ন অংশ অকালে বুড়িয়ে গেলেও কোমর ব্যথা হতে পারে।
কোমর ছাড়া অন্য অঙ্গের রোগেও কোমর ব্যথা হতে পারে, যেমন—আমাশা, সাদা স্রাব, কোষ্ঠবদ্ধতা, প্রস্রাবে জীবাণুসংক্রমণ, মানসিক উদ্বেগ।
এঁরা কোমর ব্যথা বেশী ভোগেন
বয়স—৫৫ বছর বয়স অবধি কোমর ব্যথার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
লিঙ্গ—৬০ বছর বয়স অবধি কোমর ব্যথার সম্ভাবনা নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে সমান। তার পর থেকে মহিলাদের কোমর ব্যথার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
শরীরের মাপজোক—মোটা মানুষদের ও লম্বা মানুষদের কোমর ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা একটু বেশী।
শরীরের স্থিতি (posture)—শোয়া, বসা, দাঁড়ানো, ইত্যাদি ঠিকঠাক না হলে কোমর ব্যথা বেশী হয়।
মাংসপেশীর জোর—পেট ও পিঠের মাংসপেশী কমজোর হলে কোমর ব্যথার সম্ভাবনা বাড়ে।
সন্তান–জন্ম—বারবার প্রসব হলে বা সিজারিয়ান অপারেশন করে প্রসব হলে কোমর ব্যথা সম্ভাবনা বাড়ে।
পেশা—যাঁদের কঠোর ও ভারী কাজ করতে হয়, ভারী ওজন তুলতে হয়, কোনও কিছু টানতে, ঠেলতে বা মোচড়াতে হয়, যাঁদের অনেকক্ষণ বসে বা হাঁটু মুড়ে থাকতে হয়, যাঁদের নিজের পেশা একঘেঁয়ে বলে মনে হয়, তাঁদের কোমর ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
রোগ-নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
- এক্স-রে হল কোমরে ব্যথায় সবচেয়ে বেশী করা পরীক্ষা। কিন্তু এক্স-রে-তে হাড় ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতে রোগের কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কোমরের এক্স-রে করার আগের রাতে হাল্কা জোলাপ খেয়ে পর দিন পায়খানা করার পর একদম খালি পেটে এক্স-রে করলে এক্স-রে স্পষ্ট হয়।
- রক্তের নানা পরীক্ষায় রোগ-নির্ণয়ের নানা সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
- আগে সিটি স্ক্যান, এখন এম আর আই স্ক্যান কোমরের নানা রোগ-নির্ণয়ে সাহায্য করে, তবে দুটো পরীক্ষাই খরচ-সাপেক্ষ।
- সিটি স্ক্যান, এম আর আই স্ক্যান চালু হওয়ার আগে মায়েলোগ্রাফি নামে এক বিশেষ এক্স-রে পরীক্ষা করা হত অনেক ক্ষেত্রে।
- কিছু ক্ষেত্রে CSF বা মস্তিষ্ক-মেরুরস পরীক্ষাতেও রোগ ধরা পড়ে।
নানা রোগে নানা চিকিৎসা
- যান্ত্রিক কারণে কোমর ব্যথা হলে কাজ করা ও স্থির থাকার সময় যেসব ভুল অবস্থান কোমরে ব্যথার কারণ সেগুলোকে শুধরাতে হয়। এছাড়া পিঠ ও পেটের মাংসপেশীগুলোকে মজবুত করার জন্য ব্যায়াম করতে হয়।
- Lumbar spondylosis-এ কশেরুকার জোড়গুলোকে যে সব মাংসপেশী ধরে রাখে সেগুলোকে মজবুত করার ব্যায়াম করতে হয়।
- চাকতি সরে যাওয়া (slipped disc)-এ ব্যথা কমা অবধি একদম শুয়ে বিশ্রাম নিতে হয়, বসাও বারণ, কেননা তাতে কোমরে চাপ পড়ে সবচেয়ে বেশী। আল্ট্রাসাউন্ড চিকিৎসা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। ব্যথা কমার পর ব্যায়াম শুরু করতে হয়।
- খিলান বিকার (lumbar spondylolysis) ও কশেরুকা-ভ্রংশ (lumbar spondylolisthesis)-এ কাজ করার সময় বেল্ট ব্যবহার করতে হয়। মেরুদন্ডের প্রতিনমন ব্যায়াম (spinal extension exercise) অর্থাৎ উপুড় হয়ে ব্যায়াম করা বারণ। মেরুদন্ডের আনমন ব্যায়াম (spinal flexion exercise) অর্থাৎ চিৎ হয়ে করা ব্যায়াম এবং পেটের মাংসপেশী মজবুত করার ব্যায়াম (abdominal muscle strengthening exercise) করতে হয়।
কোমর ব্যথায় অপারেশন
কোমর ব্যথার রোগীদের ২৫০০ জনের মধ্যে অপারেশন লাগে মাত্র ১ জনের। মেরু চাকতি সরে যাওয়ার রোগীদের, মেরুনালী সংকোচনের রোগীদের কখনও কখনও অপারেশন করা হয়। তবে অপারেশন করার পর অনেকেরই কষ্ট আরও বেড়ে যায়। এখন ব্যথা কমানোর নানা আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ার পর অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে গেছে।
কোমর ব্যথা প্রতিরোধে ব্যাক স্কুল
যেসব পেশায় কোমর ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি বেশী সেখানে প্রতিরোধের এক অভিনব উপায় ব্যাক স্কুল। এখানে শেখানো হয়—
- কোমরের গঠন ও কাজ করার পদ্ধতি, বয়স হলে মেরুদন্ডে কি কি পরিবর্তন হয়।
- শরীরকে ঠিকঠাক চালানোর পদ্ধতি ও কোমরে আঘাতের প্রাথমিক চিকিৎসা।
- মনোচিকিৎসা, শরীরকে চাপমুক্ত ও মনকে উদ্বেগহীন রাখার উপায়।
- যাঁদের কোমরে ব্যথার ইতিহাস আছে তাঁদের জন্য ব্যায়াম।
সুইডেন, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, কানাডা ও ভারতের কোয়েম্বাটোরে এরকম ব্যাক স্কুল চালিয়ে ফল পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গে এখনও এরকম উদ্যোগ শুরু করা যায়নি।
আরও কিছু জানার কথা
- কোমর ব্যথার ৯০% রোগী কোনও ডাক্তারী সাহায্য ছাড়াই ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে ভাল হয়ে যান। ৫০% তো ১ সপ্তাহের মধ্যেই সেরে ওঠেন।
- হঠাৎ করে হওয়া কোমর ব্যথায় ৩৬ থেকে ৬২%-এর কোমর ব্যথা সারার পরও ঘুরে ফিরে আসে।
- হঠাৎ করে হওয়া কোমর ব্যথায় ২-৩ দিনের বেশী বিছানায় শুয়ে থেকে লাভ নেই। ৪ দিনের বেশী বিছানায় শুয়ে থাকলে স্বাভাবিক কাজে ফিরতে অসুবিধা হয়।
- হঠাৎ করে হওয়া কোমর ব্যথায় প্রথম পছন্দের ওষুধ প্যারাসিটামল। ৯০%-এর এতেই কাজ হয়।
- কোমর ব্যথা প্রদাহজনিত কারণে না হলে আইবুপ্রোফেন বা ডাইক্লোফেনাক-এর মত প্রদাহরোধী ওষুধে লাভ নেই।
- আফিমজাত বেদনানাশক কোডিন, ডেক্সট্রোপ্রোক্সিফেন, ইত্যাদি ভাল কাজ করে এমন প্রমাণ নেই।
- মাংসপেশীর খিঁচ কমানোর ওষুধ, এন্টিহিস্টামিনিক, ইত্যাদিকে প্রদাহরোধী ওষুধে মেশালে কার্যকারিতা বাড়ে এমন নয়।
- হঠাৎ করে হওয়া কোমর ব্যথায় বেল্ট ব্যবহার করলে লাভ হয় না।
- কোমরে গরম বা ঠান্ডা সেঁক দিলে তেমন লাভ নেই, ক্ষতিও নেই।
- হঠাৎ করে হওয়া কোমর ব্যথায় ডায়াথার্মি, মালিশ, আল্ট্রাসাউন্ড চিকিৎসা, চামড়ায় লেজার বা বৈদ্যুতিক উত্তেজনা, ট্র্যাকশন (টান) দেওয়া ইত্যাদিতে তেমন ফল পাওয়া যায় না।
ভালো লেখা।
তাহলে কো্মরে ব্যাথা হলে কি ফিজিওথেরাপি করবো।