‘গলব্লাডার আবার একটা অপারেশন নাকি? আমি সব জানি। আমার খুড়তুতো ননদের হয়েছে! অপারেশনের সাতদিন বাদে সে মন্দারমনি বেড়াতে চলে গেল।’
‘আপনার দিদির সাথে চুড়ান্ত অন্যায় হয়েছে। ডাক্তারগুলো গাদাগাদা টাকা নেবে। বিদেশে বেড়াতে যাবে। লাক্সারি জীবন উপভোগ করবে। তারপর রোগী মেরে ফেলবে। কোনো দায়িত্ব নেই। বলবে, আমরা কি ভগবান?’
‘আমি শেয়ার করেছি। তুইও শেয়ার কর।’
‘এদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া উচিত।’
‘জেলে ভরে দেওয়া উচিত।’
এতকিছু অসংলগ্ন লেখার মধ্যে আসল বক্তব্য যা উদ্ধার করতে পারলাম তা হল,
এক, ডাক্তার গাদাগাদা টাকা নেয়।
দুই, বিদেশে বেড়াতে যায়। (সম্ভবতঃ অন্যের পয়সায় কথাটা বলতে চেয়েছে)।
তিন, রোগী মরলেই ডাক্তার হল খুনী।
প্রথম এবং তৃতীয় পয়েন্টে যাওয়ার আগে দ্বিতীয় পয়েন্ট নিয়ে একটু আলোচনা করি। এখানে আমার নিজের ঢাক নিজে পেটানোর একটু ব্যবস্থা আছে। তাই, নিজগুণে মার্জনা করবেন।
বহু মানুষের ধারণা আছে যে ডাক্তাররা হয় নিজের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করে অথবা ওষুধ কোম্পানীর টাকায়।
সব ডাক্তার দধিচীর মত আত্মত্যাগী বা সত্যযুগের মত সৎ- একথা বললে ঘোড়ায় হাসবে। সুতরাং বলতে চাই না।
সব ডাক্তার কেন? সব শিক্ষক সৎ? সব গবেষক? সব সেনা কর্তা?
শত্রুদেশের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে – সেনা গবেষক দেশের গোপন গবেষণার খবর সুন্দরী মহিলার গুপ্তচরের পদতলে অর্পন করে তারপর গ্রেপ্তার হয়েছে- এ তো একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা। পুলিশ-প্রশাসক-রাজনীতিবিদদের কথাতো ছেড়েই দিলাম। বই প্রকাশক কোম্পানী বা পোষাক প্রস্তুতকারক কোম্পানীর টাকায় কিছু শিক্ষক ফূর্তি করছে- এ তো ঘটে। তাই বলে যেসব প্রাতঃস্মরণীয় শিক্ষকদের জন্য আজ আমি এখানে আসতে পেরেছি- তাঁরাও অসৎ ছিলেন? একথা ভাবার আগেই যেন আমি মুক ও বধির হয়ে যাই!
সমাজের নোংরা কাদার ছিটে স্বাভাবিক ভাবেই সব পেশার কিছু লোকের গায়ে লাগবে- ডাক্তাররাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাঁরা কোনো মঙ্গলগ্রহ থেকে আসে নি।
বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, শিল্পী, সাহিত্যিক, অধ্যাপনার সাথে যুক্ত ব্যাক্তিরা যে নিজের টাকা বা অন্যের অসৎ টাকা ছাড়াও গবেষণা, প্রশিক্ষণ, কনফারেন্স, মিটিং, আমন্ত্রিত অধ্যাপনা-র কারণে আমন্ত্রিত হয়ে বিদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা সংগঠনের অতিথি হয়ে প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই বিশ্ববিদ্যালয় বা সংগঠন-ই সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তির বিমানযাত্রা, হোটেলভাড়া, রাহাখরচ-এর ব্যবস্থা করে থাকে- এই সম্ভাবনা বহু মানুষের চিন্তাশক্তির বাইরে।
২০১০ সালে সিঙ্গাপুর থেকে ব্রিসবেন যাচ্ছি AO spine fellowship করতে। অনেকবার অ্যাপ্লিকেশন ও ইন্টারভিউয়ের পরে শিকে ছিঁড়েছে। AO একটা জার্মান-সুইস আন্তর্জাতিক অর্থোপেডিক সংস্থা। পুরো কথাটা খুব খটমট – Arbeitsgemeinschaft für Osteosynthesefragen. আমার এবং আমার আগে-পরে অসংখ্য অর্থোপেডিক, ম্যাক্সিলোফেসিয়াল ও নিউরোসার্জেন এই ফেলোশিপ বা ট্রেনিং নিয়েছেন। তো তারা (AO) আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলো, আমার কাজ দেখে তবেই অতগুলো সুইস ফ্রাঁ আমার জন্য খরচ করেছিল!
ব্রিসবেন এয়ারপোর্টের ট্যাক্সিবুথে দাঁড়িয়ে মোবাইলে (তখন স্মার্ট ফোনও নেই। নোকিয়া এক্সপ্রেস মিউজিক মডেল ব্যবহার করতাম) একটা ছবি তুলিয়ে ফেবুতে পোষ্টিয়েছিলাম। তার কয়েকদিন নতুন নতুন ফে-বুর সদস্য হয়েছিলাম তো! বেশ একটা আদেখলে ভাব। সঙ্গে সঙ্গে আমার পোষ্টে আমার মেডিক্যালের এক সহপাঠীর মন্তব্য- ‘মেডিক্যাল কাউন্সেল ধাওয়া করবে’। (যেন আমি ওষুধ কোম্পানীর অসৎ পয়সায় বিদেশ বেড়াচ্ছি)।
কি আর বলব? লিখলাম “তাদের আসতে বল।’ বুঝুন, সে আমার সহপাঠী! তখন সে সিনিয়র ডাক্তার! তাহলে সাধারণ মানুষ কি বলবে বা ভাববে ?
এর পরেও ISSLS fellowship পেয়েছি- সুইডেনের গোথেনবার্গ থেকে। যারা প্রতি বছর পৃথিবীতে মাত্র একজনকেই এই ফেলোশিপের যোগ্য মনে করে। ২০১৫ সালের ফেলো হিসেবে ISSLS ওয়েব সাইটে এই শর্মা-র নাম আছে। সন্দিগ্ধ পাঠক ইন্টারনেটে দেখে নিতে পারেন। https://www.issls.org/clinical-travelling-fellowship…/
২০০৭ সাল থেকে ক্রমাগত চেষ্টা করার পরে ২০১৪ সালে গিয়ে তার জন্য মনোনীত হই। তারপর ওদেরই আমন্ত্রণে বক্তৃতা দিতে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ডে (স্ট্যানফোর্ড খায় না মাথায় দেয়- দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না যেন) যাই।
অবশ্য যে দেশের উচ্চতম ব্যক্তিদেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অভিযোগ ওঠে- সেদেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ টাকা খাওয়া আর ঘুষ দেওয়ার বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারবে না- এটাই তো স্বাভাবিক।
নিজের ঢাক বেশ কিছুটা পেটানো হল – এবার প্রথম পয়েন্টে যাই।
ডাক্তার গাদাগাদা টাকা নেয়।
উত্তর: আপনারা দেন কেন? সরকারি হাসপাতালে বিনে পয়সায় যথেষ্ট ভালো চিকিৎসা হয়। সেখানে যান না কেন?
আপনারা বলেন, নোংরা।
উত্তর: হাসপাতালের সাদা দেওয়ালে ডাক্তার-নার্সরা পানের পিক ফ্যালে?
আপনারা বলেন ভীড়।
উত্তর: আচ্ছা বলুন তো, বত্রিশ লক্ষ সাতাশি হাজার বর্গ কিলোমিটারের দেশে (যেখানে চীন পঁচানব্বই লক্ষ বর্গকিলোমিটার!) পিঁপড়ের মত বংশবৃদ্ধি করে একশ’ চুয়াল্লিশ কোটি কারা বানিয়েছে? সেখানে হাসপাতাল কি ফাইভষ্টার হোটেল বা রাজপ্রাসাদের মত হবে?
সুতরাং, আপনারা, যাদের পয়সা আছে এবং সময় নেই তারা- কর্পোরেট হাসপাতালে গিয়ে গাদাগাদা টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখান। আমিও এক কর্পোরেট হাসপাতালে রোগী দেখি। সেদিন হাসপাতালের এক ম্যানেজার এসে বলল,
‘স্যার, আপনার ফী বাড়ান।’
‘কেন?’
‘আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও লোকে আপনার কম ফী শুনে ড্যাং ড্যাং করে আপনার থেকে অনেক জুনিয়রের কাছে চলে যাচ্ছে।’
বাধ্য হয়ে ফী দেড় গুণ করে দিলাম। আয় পত্তর আমারও দরকার। অথচ আমার ব্যক্তিগত ক্লিনিকে গত পাঁচ বছর ধরে একই ফী।
উকিলের চেম্বারে গিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে বলতে সাহস পান না তো ‘উকিল গাদাগাদা টাকা নেয়।’
বা, ‘হরিশ সালভে কেন একটা কেসে তিরিশ লক্ষ টাকা ফী নেন?’
বলেন না- কারণ বলার মত কোনো যুক্তি নেই। এটা ওঁদের পেশা- তার ফী তো ওঁরাই ঠিক করবেন, তাই না! আমাদের সামর্থ্যে কুলোলে যাব। নয়তো যাব না। সহজ-সরল বিষয়।
সবশেষে, তৃতীয় পয়েন্ট।
‘ডাক্তার (না কি) খুনী।’
আচ্ছা ভেবে দেখছেন কি, খুনীর খুন করার উদ্দেশ্য বা লাভ কি?
১ রাগ?
২ পূর্ব ঘটনার প্রতিশোধ?
৩ খুন করে টাকা পাওয়ার আশা। (সুপারী কিলার?)
৪ যথেচ্ছ সাইকোপ্যাথিক খুন ? (ষ্টোনম্যানের মত।)
এর মধ্যে কোন উদ্দেশ্যে ডাক্তার তার রোগীকে খুন করে?
চিকিৎসা শুরুর আগে থেকেই কি ডাক্তার এই রোগীকে চিনত? তাকে খুন করার প্ল্যান করেই কি ডাক্তার তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিল?
তার সঙ্গে শত্রুতা ছিল?
প্রশ্নগুলো সোজা। কিন্তু উত্তর নেই। কোনো উত্তর নেই। কারণ, কোনো যুক্তি নেই। শুধু আছে অসংখ্য আলটপকা মন্তব্য।
আর আছে ভবিষ্যত। উকিলের কড়া চিঠি পৌঁছলেই গলায় গামছা দিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা। যা আমরা বছর দুয়েক আগে ব্যারাকপুরের এক সবজান্তা মহিলা ও তার স্বামীর ক্ষেত্রে হতে দেখেছি।
বি:দ্র:
১। ওই পোষ্টের শেয়ার কারি এবং কারিণীদের অনেকে আমার পূর্ব পরিচিত। আমি নিরানব্বই শতাংশ নিশ্চিত, গল ব্লাডারটা শরীরের কোথায় থাকে এবং শরীরে তার কাজ কি – সেটা তাদের অজানা এবং তারা উকিলের চিঠি পেলে এক সেকেন্ড দেরী না করে গলায় গামছা দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
২। এই লেখা শেষ করতে না করতে ওই বিষাক্ত পোষ্ট অভিযোগকারিনী সরিয়ে নিয়েছে দেখছি।
যাঃ