ডাক্তারি করতে গিয়ে প্রতিদিনই কোনও না কোনও জ্যান্ত গল্পের সম্মুখীন হতে হয় । তবে গতকালের গল্পটা ছিল খুবই সাধারণ।
পঞ্চাশোর্ধ মহিলা, রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস বা এক ধরনের গিঁটে বাত। অনেক দিন যাবৎ চিকিৎসা চলছে। এই ধরনের ক্রনিক রোগের, বিশেষত রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস – যে রোগ জিনের সাথে জড়িত এবং রোগ প্রতিরোধ সিস্টেমকে ভূল পথে পরিচালিত করে- তার কার্যকারণ, ইতিহাস-ভূগোল রোগীকে অন্তত কিছুটা বোঝাতে না পারলে চিকিৎসা কিছুতেই সফল হয় না।
রোগটা যে সারবে না, সুস্থ থাকতে হলে সর্বক্ষণ রোগের সাথে লড়াই করে যেতে হবে- সেই কথাটা যদি রোগীর চেতনার গভীরে প্রয়োগ করা না যায়- তাহলে কোনও না কোনও অজুহাতে সে ওষুধপত্র ও চিকিৎসা বন্ধ করে দেবে।দেবেই। সেই কারণে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস রোগীদের বোঝানোর জন্য অনেক বেশি সময় দিই। এই মহিলাকেও অনেক বুঝিয়েছি। গিঁটেবাত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলেছি।
কিন্তু আমার সমস্ত পরামর্শ তিনি এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। প্রথমে কিছুদিন ওষুধ খেয়েছিলেন। বেশ ভালোই ছিলেন। তবে ব্যয়াম- ট্যয়াম করতেন না মোটেই। এভাবেই চলছিল। ব্যথা অনেক কম। তবে রোগী মোটেই সন্তুষ্ট নয়। তাঁকে দিনের পর দিন ওষুধ খেয়ে যেতে হচ্ছে -এটাই হল তাঁর আপত্তি ও অসন্তুষ্টির মূল কারণ। কিছুদিন পর থেকে অনিয়মিতভাবে দেখাতে আসতেন। তারপর একসময় হারিয়ে গেলেন। এরকম অনেক রোগীই হারিয়ে যায়। তাদের বেশীরভাগই আর ফিরে আসে না।
কিন্তু তিনি ফিরে এলেন। প্রায় তিন বছর পর।
“দাক্তাবাবু, আমাকে চিনতে পারছেন না?”
চিনতে সত্যিই পারিনি প্রথমে। এত রোগীর মধ্যে সম্ভবও নয় সবসময়। পরে পুরনো প্রেসক্রিপশন দেখে মনে পড়ল।
মুখ -চোখ ফোলা। অর্ধেকের বেশি চুল সাদা হয়ে গেছে। চোখের কোনে কালি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চেম্বারে ঢুকে সিড়ি দিয়ে উঠে সটান রোগীর কাউচে বসে পড়লেন। সবই তো তাঁর এক কালের চেনা !
“কি হয়েছে?”
“হাঁটুতে খুব ব্যথা।”
“ফুলেও তো গেছে দেখছি ! চোট লেগেছিল?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায়? বাড়িতে? পড়ে গেছিলেন?”
“না। কুম্ভমেলায়।”
“সে কি! স্নান করতে গিয়ে?”
“স্নান আর করলাম কোথায়? ভিড়ের চাপে বালিতে পড়ে পা মচকালো?”
“ যাহ্। স্নান হলো না?”
“স্নান না হোক, পুণ্য তো হল। ১৪৪ বছরে পরে পরে এরকম যোগ আসে, বুঝলেন? একবার ঘুরে আসুন। এই সুযোগ আর এ জীবনে পাবেন না।”
বললাম,
“দেখুন, আমি পাপীতাপি মানুষ। কাজকর্ম, রোগীপত্তর ছেড়ে কুম্ভমেলায় যাই কি করে? আবার না হয় পরের জন্মে দেখা যাবে!”
রোগিনী সামান্য বিরক্ত হয়ে বললেন,
“আপনারা ডাক্তাররা হলেন ভীষণ কূপমন্ডুক।”
“আমাদের কথা ছাড়ুন, কুম্ভমেলায় গিয়ে আপনার গিঁটেবাত কমল?”
“কমবে কমবে। সবে তো ফিরলাম ! ”
“এত পুণ্য অর্জন করেছেন। তার তো একটা ইনস্ট্যান্ট এফেক্ট হওয়া উচিত! ঠিক কিনা?”
“আর বললে তো আপনি রাগ করবেন।”
“বলুন, বলুন। রোগীদের কোনও কথাতেই আজকাল আর রাগ হয় না।”
“প্রয়াগ থেকে ফেরার পথে পারশনাথ গেছিলাম।”
“সর্বনাশ! এই পা নিয়ে? সে তো পাহাড়ে চড়তে হয় !“
“ হ্যাঁ । আবার কবে যাওয়া হবে না হবে, তার ঠিক আছে?”
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। “আসুন, আপনাকে একটা প্রণাম করি । আর ইয়ে, আপনি জীবনে এত পুণ্য সঞ্চয় করেছেন যে, স্বয়ং বিধাতা স্বর্গের দরজায় এসে আপনাকে বরণ করবেন নিশ্চয়ই !”
রোগিনী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে বললেন “কি যে বলেন!”
উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠল।