যদিও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তথ্য ও তত্ত্ব আবিষ্কার হয়ে চলেছে, তথাপি নৃতাত্ত্বিকদের মতে প্রায় দু লক্ষ বছর এবং তার আগে থেকেই বিবর্তনের (Evolution) মাধ্যমে বুদ্ধিমান মানুষের (Homo sapiens) আবির্ভাব এখনকার আফ্রিকা মহাদেশে। তারপর খাদ্যের অভাব এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে নতুন বাসস্থানের খোঁজে আদিমানব আজ থেকে প্রায় ৭০ হাজার থেকে এক লক্ষ তিরিশ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন বর্তমান ভারতীয় ভূখণ্ডের দাক্ষিণাত্য এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ সহ। এটিকে মহাপরিব্রাজন (Great Migration) বলা হয়। ভারতীয় ভূখণ্ডে আফ্রিকা থেকে যে আদি মানবরা এসেছিলেন তারাই আমাদের দেশের সবচাইতে আদি বাসিন্দা। বর্তমান পূর্ব, পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভূমিজ ও জনজাতিদের (Aborigines and Tribes) পূর্বপুরুষ। আবার হিন্দুত্ববাদীরা যাদের নিয়ে খুব গর্ব করে থাকেন সেই যাযাবর পশুপালক ও শিকারি আর্যরা খাদ্য ও বাসস্থানের সন্ধানে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বর্তমান পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়া থেকে পরিব্রাজন করতে করতে মধ্য এশিয়া হয়ে উত্তর পশ্চিম ভারতভূমিতে প্রবেশ করেন।
জীবজন্তু, পাখি, মাছ প্রভৃতিদের ক্ষেত্রেও পরিব্রাজন আকছার দেখা যায়। বেশ কিছু মহাপরিব্রাজনের কথাও জানা যায়। প্রতি বছর বৃষ্টিপাতের গতিপথের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগানের কারণে লক্ষ লক্ষ ওয়াইল্ড বিস্ট, জেব্রা, গেজেল, এল্যাণ্ড প্রভৃতি জন্তু তানজানিয়ার সেরেঙ্গেটি অরণ্য থেকে মারা নদী সহ ২৫০ কিলোমিটার বন্ধুর জলাজঙ্গুলে পথ অতিক্রম করে কেনিয়ার মাসাইমারা অরণ্যে পৌঁছয়। তাদের পিছন পিছন পৌঁছয় সিংহ, চিতা, চিতাবাঘ, হাইনা, কুমীর প্রমুখ খাদকের দল। প্রবল শীতকে এড়াতে প্রতি বছর আর্কটিক বা উত্তর মেরু অঞ্চলের গ্রীষ্ম থেকে আন্টারটিকা বা দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের গ্রীষ্মে, পুনরায় সেখান থেকে উত্তর মেরু অঞ্চলের গ্রীষ্মে প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেয় আর্কটিক টার্ন পাখির ঝাঁক। প্রচণ্ড শীতকে এড়াতে রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে বিভিন্ন প্রজাতির সারস, হাঁস প্রভৃতির ঝাঁক ১৫ – ২০ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ভারত সহ এশিয়া ও আফ্রিকার শীতে চলে আসে। আবার সাইবেরিয়ার গ্রীষ্মে সম পরিমাণ পথ উড়ে সেখানে ফিরে যায়। এই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে যুগ যুগ ধরে। অবন ঠাকুর বুড়ো আংলার চোখ দিয়ে এই মহাপরিব্রাজনের এক চমৎকার বিবরণ লিখে গেছেন।
পরিব্রাজন (Migration), দেশান্তর (Emigration) ও অভিবাসন (Immigration): আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে প্রাকৃতিক বা অন্য কোন কারণে কোন এক জায়গার বাসিন্দা অথবা বাসিন্দারা যদি অন্য এক জায়গায়, সেটা ভৌগোলিকভাবে অন্য গ্রাম / শহর বা ব্লক বা জেলা বা রাজ্য বা দেশ বা মহাদেশ হোক না কেন, চলে যায় তাকে পরিব্রাজন (Migration) এবং সেই ব্যক্তিদের পরিযায়ী (Migrant) বলা হয়। পরিব্রাজন অনেক কারণেই হতে পারে এবং হতে পারে সাময়িক (Temporary), স্থায়ী (Permanent), ঐচ্ছিক (Voluntary) অথবা বাধ্য হয়ে (Forced)।
এবার কোন ব্যক্তি, পরিবার অথবা গোষ্ঠী পরিব্রাজন করে অন্য দেশে চলে গেলে প্রক্রিয়াটিকে দেশান্তর (Emigration) এবং সেই ব্যক্তি, পরিবার অথবা গোষ্ঠীকে দেশান্তরী (Emigrant) বলা হয়। অন্যদিকে কোন ব্যক্তি, পরিবার অথবা গোষ্ঠী অন্য কোন দেশে এসে বসবাস করলে প্রক্রিয়াটিকে অভিবাসন (Immigration) এবং সেই ব্যক্তি, পরিবার অথবা গোষ্ঠীকে অভিবাসী (Immigrant) বলা হয়। কর্মসূত্রে বা অন্য কারণে অন্যদেশে অস্থায়ীভাবে থাকলে তাদের প্রবাসী (Expatriate) এবং স্থায়ীভাবে থেকে গেলে সেখানকার বাসিন্দা (Resident) বলা হয়। কোন দেশে বা অঞ্চলে অন্য কোন দেশ বা জাতির বাসিব্দারা একটি জনগোষ্ঠী হিসাবে প্রজন্ম পরম্পরায় যদি থেকে যায় সেক্ষেত্রে তাঁদের মূল দেশ বা জাতির বংশোদ্ভূত (Diaspora) বলা হয়। বিভিন্ন ধরনের থাকার অনুমতিপত্র (Visa), স্থায়ীভাবে থাকার (Permanent Residency) সুযোগ, নাগরিকত্ব (Citizenship) ইত্যাদি গন্তব্য দেশের এবং সেখানকার সরকারের বিভিন্ন স্তরের আইনি ছাড়পত্র। কোন নিরাপত্তার কারণে অন্যদেশে আশ্রয় নিলে তাদের আশ্রয়প্রার্থী (Asylum Seeker) বলা হয়।
পরিব্রাজন, দেশান্তর এবং আভিবাসন যুগে যুগেঃ
“কেহ নাহি জানে কার আহবানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথায় অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন –
শক – হুন – দল পাঠান – মোগল এক দেহে হল লীন। … “
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘ভারত তীর্থ’ কবিতার এই পঙক্তিতে সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে কিভাবে যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি ভারতীয় ভূখণ্ডে এসে অভিবাসী হয়েছেন।
প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডের বিশেষত সিন্ধু – গঙ্গা সমতলের অনুকূল জলবায়ু, অবারিত উর্বর চারণ ও কৃষি ক্ষেত্র, পর্যাপ্ত বর্ষা ও মিষ্টি জলের সংস্থান, অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ, সহজ সমৃদ্ধ জীবনযাত্রা প্রভৃতি কারণে পরিব্রাজন করে আগত জাতিগুলি এখানে স্থায়ীভাবে অভিবাসী হয়েছেন। পূর্বোক্ত আর্যরা উন্নত সিন্ধু সভ্যতার জনজাতিদের মুলত অশ্বারোহী বাহিনীর সাহায্যে পরাজিত করে প্রথমে সিন্ধু অববাহিকা ও পাঞ্জাবে বসতি স্থাপন করে ক্রমে পূর্ব বাহিনী হয়েছেন। মধ্য এশিয়ার আক্রমণকারী যোদ্ধা জাতি হুনরা ক্রমে হয়ে গেছেন রাজপুত। উন্নত সভ্যতার জনজাতিদের যুদ্ধে পরাজিত করে আরও দক্ষিণে পাহাড় অরণ্যে ঠেলে দিয়ে শুধু আঞ্চলিক আধিপত্যই নয় এই অভিবাসী জাতিগুলি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বনে গিয়ে হিন্দু ধর্মীয় সামাজিক কাঠামোর শীর্ষে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে তার আগে থেকেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে বিভিন্ন অনার্য দ্রাবিড় জাতির উন্নত সভ্যতা। পরে মধ্য এশিয়ায় ইসলামি আগ্রাসনের পর পার্সি এবং ইহুদীদের একাংশ দেশান্তরী হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলে আশ্রয় নিয়েছেন। আর্মেনীয়রা ব্যবসা করতে ট্রান্স – ককেসিয়ান অঞ্চল থেকে পরিব্রাজন করতে করতে ভারতে এসে পৌঁছেছেন। তুর্কি, আফগান, আরব, ইরানি, তুরানি, মোঙ্গলদের সিংহভাগ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পশ্চিম এশিয়া, আরব ও মধ্য এশিয়া থেকে বহু পথ পরিব্রাজন করে ভারতে রাজত্ব স্থাপন, বাণিজ্য প্রভৃতির মাধ্যমে অভিবাসী হন। ইউরোপ, আরব, চীন প্রভৃতি অঞ্চল থেকে দীর্ঘ স্থল এবং জল পথ পরিব্রাজন করে বহু পর্যটক, বণিক, তক্ষশীলা – নালন্দা প্রভৃতি বিশ্ব বিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষালাভে ছাত্ররা ভারতে এসেছিলেন। ভারতীয় বণিক, পর্যটক, বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকরাও রেশম পথ সহ বিভিন্ন স্থলপথে এবং সমুদ্রপথে মধ্য এশিয়া, তিব্বত, চীন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রভৃতিতে পরিব্রাজন করেন। শক্তিশালী ভারতীয় নৃপতিরা গান্ধার, তাম্রপর্ণী, চম্পা, কম্বোজ, সুবর্ণভূমি প্রভৃতিতে রাজ্যবিস্তার করেন।
অতীতে যেমন গ্রীক, পারথিয়ান, ব্যকটেরিয়, শক, কুশান, মোঙ্গল প্রভৃতি জাতি উত্তর পশ্চিম গিরিখাত ধরে, সেরকমই পরবর্তীকালে পর্তুগিজ, দিনেমার, বেলজিয়ান, ডাচ, ফরাসি, ব্রিটিশরা সমুদ্রপথে ভারতের অতুলনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ; মূল্যবান মশলা, ধাতু, পাথর, হাতির দাঁত ইত্যাদি; উৎকৃষ্ট খাদ্য ও ভোগ্য সামগ্রী; সূক্ষ্ম কার্পাস ও পশম বস্ত্র সহ উন্নত শিল্প সামগ্রীর সন্ধানে ভারতে পরিব্রাজন করে বাণিজ্য কুঠি এবং উপনিবেশ গড়ে তোলেন। তাঁদের সঙ্গে ভারতীয়দের মিলনের ফলে এক বর্ণ সংকর ভারতীয় জনসমষ্টির সৃষ্টি হয়। আর সামগ্রিকভাবে ভারতীয়রা তো বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে এক বর্ণসংকর জাতিই বটে। একসময় আফ্রিকার হাবশি (ইথিওপিয়ান) প্রমুখদের দাস হিসাবে ভারতে নিয়ে আসা হয়, সেরকমই দরিদ্র ভারতীয়দের ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা ফিজি, সুরিনাম, গাইয়ানা, ত্রিনিদাদ, টোবাগো প্রভৃতি অঞ্চলের আখের ক্ষেতে সস্তা শ্রমিক হিসাবে পাঠায়। যেমন এশিয়া মাইনর, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা থেকে দাসদের গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্যে কিংবা পরবর্তীকালে পশ্চিম আফ্রিকার জনজাতিদের দাস হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের রাজ্যগুলির তুলোর ক্ষেতে অথবা ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে জনজাতিদের ধরে উত্তরবঙ্গ ও অসমের ব্রিটিশদের চা বাগিচাগুলির বেগার খাটার মজুর হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়। কালক্রমে তাঁরা সেখানকার অভিবাসী ও অধিবাসী হন।
কেন এই পরিব্রাজন, দেশান্তর এবং আভিবাসন? কিছুক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় ভ্রমণ, বাণিজ্য, উচ্চ শিক্ষা প্রভৃতি কারণে ঘটলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির চাপে বা বাধ্য হয়ে। অতীতে যেগুলি মুলত ছিল অনুকূল জলবায়ু এবং শিকার, খাদ্য ও পানীয় জলের কারণে পরবর্তী সময়ে সেগুলি নির্দিষ্টভাবে হল জলবায়ুর পরিবর্তন, নিরাপত্তা, কর্ম সংস্থান ও বাসস্থানের সুযোগ, সহজ জীবনযাত্রা বা উন্নত জীবনযাত্রার সুযোগ, বলপূর্বক দাস বা মজুর হিসাবে নিয়ে যাওয়া, চাকরির বদলি, রাজনৈতিক আশ্রয়, যুদ্ধ বা জাতিদাঙ্গার অভিঘাত প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে। ১৭৫৭ – ১৯৪৭ অবধি বিশ্বের সবচাইতে ধনী ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রধান উপনিবেশ। সেটিকে লুঠ ও শোষণ করে ব্রিটেন হয়ে গেল বিশ্বের সবচাইতে ধনী দেশ। ব্রিটিশ সামন্ত ও ধনীদের খিদমত খাটার ভৃত্য, মজুর, সাফাই কর্মী হিসাবে বেশ কিছু ভারতীয়কে জাহাজে চাপিয়ে দীর্ঘ পরিব্রাজন ঘটিয়ে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হল। তাঁরা বংশানুক্রমে ব্রিটেনের অভিবাসী ও অধিবাসী হয়ে গেলেন। সেভাবেই ইউরোপ ও আমেরিকার অধিবাসী হয়ে গেলেন আফ্রিকার কৃষ্ণ গাত্রবর্ণের (ঔপনিবেশিক আখ্যানে নিগ্রো) জনজাতিদের একটি অংশ। আবার ক্ষমতা ও সম্পদের কেন্দ্র ইউরোপ ও আমেরিকায় নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, কর্ম সংস্থান ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ, উন্নত জীবনযাত্রার মান, শীতল আবহাওয়া ইত্যাদির কারণে উপনিবেশগুলি থেকে দলেদলে দারিদ্র্য ও সমস্যায় থাকা মানুষ সেখানে বৈধ – অবৈধ যে কোন উপায়ে পরিব্রাজন করে অভিবাসী হয়েছেন, হচ্ছেন বা অভিবাসী হওয়ার চেষ্টা করছেন (Reverse Colonialization)। ব্রিটেনের ভারতীয়, চীনা, আফ্রিকান, ক্যারিবিয়ান, নেপালীদের মত দ্য নেদারল্যান্ডসে সুরিনামিজ, ফ্রান্সে আলজিরিয়ান, জার্মানিতে টার্কি ও গ্রীক, ইতালিতে লিবিয়ানদের আগমন এবং অভিবাসন। আর ভারতীয়, পাকিস্থানী ও বাংলাদেশী তো সর্বত্র। সেই কবে মুজতবা আলির ‘নোনাজল’ ইত্যাদি রম্য সাহিত্য পড়ে আমরা জেনেছি যে সিলেটের দক্ষ সারেং ও নাবিকদের বিলেতে অভিবাসনের কথা। একদিকে দারিদ্র, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং জন বিস্ফোরণের কারণে ব্যাঙ্কক থেকে দুবাই – ভ্যাটিকান – লন্ডন হয়ে নিউ ইয়র্ক অবধি ফুটপাথের দোকান, ঘিঞ্জি বাজার ও সস্তা হোটেলগুলি বাংলাদেশীদের; পরিবহন ও শ্রমিকের কাজ ভারতীয়, পাকিস্তানী, আরব, আফ্রিকান ইত্যাদিদের দখলে। আফগানিস্তান, ইরাক, কুর্দ অঞ্চল, সিরিয়া, লেবানন, ইরান, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেন, সোমালিয়া, সুদান প্রভৃতি মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে অনবরত যুদ্ধ, গৃহ যুদ্ধ, বিদেশি আক্রমণ, জেহাদি সন্ত্রাস, অস্থিরতা ইত্যাদি চলায় সেখানকার শরণার্থীদের (Refugees) অনেকেই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে পরিব্রাজন করেন।
উত্তর আমেরিকা মহাদেশে যেমন ব্রিটিশ, ডাচ ও ফ্রেঞ্চ ঔপনিবেশিকরা পরিব্রাজন করে পৌঁছে স্থানীয় জনজাতিদের মেরে অথবা কৌশলে সব কিছু দখল করে নেয়, সেরকম একই ঘটনা ঘটায় স্প্যনিয়ারডস ও পর্তুগিজ ঔপনিবেশিকরা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় সেখানকার উন্নত মায়া, অ্যাজটেক, ইনকা প্রভৃতি উন্নত সভ্যতাগুলিকে ধ্বংস করে, নারীদের ধর্ষণ করে, যাবতীয় সম্পদ লুঠ করে। আধুনিক যুগে বিত্তশালী উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে শুধু তৃতীয় বিশ্বের হতদরিদ্র এশিয় আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকান দেশগুলি থেকেই শুধু নয় অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক কারণে কমিউনিস্ট শাসিত অর্থনৈতিক সমস্যাসংকুল, গণতান্ত্রিক অধিকার সংহারক ও প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক দমনপীড়নের জন্য কুখ্যাত সোভিয়েত রাশিয়া (USSR), পূর্ব জার্মানি (GDR), পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া – পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি; যুগোস্লাভিয়া, আলবেনিয়া বলকান দেশগুলি; চীন প্রভৃতি থেকেও পালিয়ে দেশান্তর এবং রাজনৈতিক আশ্রয় ও অভিবাসনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ১৯৯১ তে পূর্ব ইউরোপীয় উপগ্রহ রাষ্ট্রগুলি নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং বিভিন্ন পুঁজিবাদী জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরেও এই ধারা অব্যাহত। আবার পুঁজিবাদী সমৃদ্ধ দুনিয়ার শীর্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকায় পশ্চিম ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইজরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি সমৃদ্ধ দেশগুলি থেকেও সেখানে পরিব্রাজন ও অভিবাসন ঘটে চলে। অন্যদিকে দারিদ্র, নিয়ত রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তার অভাবের কারণে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং কিউবা সহ ক্যারিবিয়ান দেশগুলির ল্যাটিনো, হিস্প্যানিক, ব্ল্যাক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সমস্ত বাধা অতিক্রম করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিব্রাজন করেন। ঐতিহাসিকভাবে পাঞ্জাব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া প্রভৃতি রাজ্যে, ব্রিটিশ কলম্বিয়া সহ কানাডার কিছু প্রদেশে, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরে পাঞ্জাবীদের; পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকায় পরে অন্যত্র গুজরাতিদের; পাশ্চাত্যে মারাঠিদের; মধ্য প্রাচ্যে কেরালিয়ান্ দের; শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ায় তামিলদের; যুক্তরাজ্যে বাঙ্গালিদের; মরিশাস ও সুরিনামে বিহারিদের পরিব্রাজন এবং অভিবাসন অধিক। অন্যদিকে অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশ, নেপাল এবং আফগানিস্তানের বহু মানুষের ভারতে আইনি ও বেআইনি পথে পরিব্রাজন এবং অভিবাসন করে চলেছেন।
দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে তো বটেই স্বাধীনতার পর গত শতাব্দীর সত্তর দশকের শুরু অবধি শিক্ষা এবং শিল্পে এগিয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গে সারা দেশ থেকে মানুষ উচ্চ শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের জন্যে আসতেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হিংসা, পুঁজির পশ্চিম ভারতে পাড়ি দেওয়া, কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ মনোভাব, কেন্দ্রের মাশুল সমীকরণ নীতি, সরকার ও প্রশাসনের অব্যবস্থা প্রভৃতি কারণে পশ্চিমবঙ্গ পেছিয়ে পড়ায়; অন্যদিকে মুম্বাই – পুনে, নয়ডা – দিল্লি – গুরুগ্রাম, আমদাবাদ – ভাদোদরা, চেন্নাই – ব্যাঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল শিল্প ও অর্থনীতিতে এগিয়ে যাওয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি, কর্মসংস্থান সব দিক থেকে পেছিয়ে থাকা পূর্ব, উত্তর – পূর্ব, মধ্য ভারতের রাজ্যগুলি, তথাকথিত ‘বোমারু’ এবং গো বলয়ের রাজ্যগুলি থেকে, পশ্চিমবঙ্গ সহ, কাতারে কাতারে কর্মক্ষম মানুষ প্রধানত রোজগারের কারণে, এছাড়াও উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসার কারণে পরিব্রাজন করে চলেন। পরিযায়ী শ্রমিক শব্দ দুটি এখন বহুল পরিচিত। রাস্তাঘাটে হাঁটাচলা থেকে বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাবে অর্থনৈতিক কারণে আভ্যন্তরীণ শ্রমের পরিব্রাজন কি পরিমাণে ঘটছে। মালদা জংশনে দিল্লিগামী ফারাক্কা এক্সপ্রেসে যদি একবার উঁকি মারেন দেখতে পাবেন দুই দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং বাংলাদেশ থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের উপচে পড়া ভিড়। একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতগামী প্রতিটি ট্রেনে। ছটের সময় নিউ দিল্লি বা মুম্বাইয়ের কুরলা (লোকমান্য তিলক) স্টেশনে গেলে মালুম হবে বিপুল পরিমাণ বিহারী শ্রমিক এবং একইভাবে ঈদের সময় পশ্চিমবঙ্গগামী ট্রেনে উঠলে দেখা যাবে বিপুল পরিমাণ পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক। এরা বেশিরভাগই গ্রামের ভুমিহীন দরিদ্র কৃষক পরিবারের। নয়ডাতে কিছুদিন থাকার সময়ে দেখেছি যে হতদরিদ্র কিশোরগুলি বাড়ি বাড়ি এসে আবর্জনা নিয়ে যায় তাঁরা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার হয়ে স্থল বা জলপথে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে সেখান থেকে দিল্লি – দীর্ঘ পরিব্রাজন। আজকাল দেশের আভ্যন্তরীণ বিমানগুলি ছাড়াও ব্যাঙ্কক, মাসকট, দোহা, আবু ধাবি, দুবাই ইত্যাদি রুটের বিমানেও দেখা যাবে বিপুল পরিমাণে শ্রমের পরিব্রাজন।
অভিবাসন ও জনবিন্যাস (Demographic) পরিবর্তনঃ প্রায় দুশো বছর ধরে ভারতবর্ষকে শাসন শোষণ করে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিপ্লবীদের নিরন্তর সশস্ত্র সংগ্রাম, আজাদ হিন্দ ফৌজের আগমন, নৌ বিদ্রোহ, বিশেষ করে ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো গণ অভ্যুত্থানের অভিঘাতে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা ভারতে ব্রিটিশ পুঁজি ও বাণিজ্যের স্বার্থ এবং রাজনৈতিক আনুগত্য সুনিশ্চিত করে বশংবদ নেহরু এবং জিন্নার নেতৃত্বাধীন যথাক্রমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে ১৯৪৭ এ ক্ষমতা হস্তান্তর করে। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গার মধ্যে দেশভাগ করে দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুটি বৈরী দেশের সৃষ্টি করা হয়। বিদ্রোহী পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করে দেওয়া হয়। পাঞ্জাবে ব্যাপক হিংসা ও রক্তপাতের মধ্যে পাঞ্জাবী শিখ ও হিন্দুরা ভারতে চলে আসেন। পাঞ্জাবী মুসলমানরা পাকিস্তানে চলে যান। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে অনুরূপ ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা হলেও পারস্পরিক স্থান পাল্টাপাল্টি হয়না। ওদিক থেকে প্রধানত উচ্চবর্ণের স্বচ্ছল বাঙালি হিন্দুরা এদিকে চলে এলেও এবং অল্প সংখ্যক বাঙ্গালি মুসলমান এদিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলেও হিন্দু জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ নমঃশূদ্র, রাজবংশী, মাহিষ্য, কৈবর্ত প্রমুখ তপশিলি ও পশ্চাদপদ কৃষক ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায় পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। এবং সেই থেকে আজ অবধি তারা হিন্দু ও বাঙালি বিদ্বেষী সরকার, প্রশাসন এবং ইসলামী মৌলবাদী সমাজবিরোধীদের দ্বারা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত। কেবলমাত্র ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লক্ষ বাঙালি হিন্দুকে হত্যা এবং চার লক্ষ বাঙালি হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করে পাক সেনা এবং জামাত – ই – ইসলাম, আল – বদর, রাজাকার ঘাতকরা। আক্রান্তদের অনেকেই প্রাণ হাতে করে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে চলে এসে আভিবাসী হন। বনগাঁ প্রভৃতি ক্যাম্প তখন লক্ষ লক্ষ দুর্দশাগ্রস্ত উদ্বাস্তুর ভিড়ে উপচে পড়েছে। ১৯৪৭ এ পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি হিন্দুর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২৮% যেটি বর্তমান বাংলাদেশের জনবিন্যাসে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭% এর কম। ভারত থেকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খ্রিস্টান অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের, চীন যুদ্ধের পর ভারতীয় চীনাদের এবং শিখ বিরোধী দাঙ্গার পর পাঞ্জাবী শিখদের পরিব্রাজন ঘটেছে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।
যেরকম লোয়ার ককেশীয় অঞ্চলে আর্মেনিয়া সংলগ্ন আজেরবাইজানের মধ্যে অবস্থিত ৪৪০০ বর্গ কিমি আয়তনের দেড় লাখ জনসংখ্যার আর্মেনীয়দের প্রাচীন জনপদ নাগরনো – কারাবাখ। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এটি Nagorno – Karabakh Autonomous Oblast হিসেবে দীর্ঘদিন ছিল। সোভিয়েতের পতনের পর আজেরবাইজান এটি দখল নিতে চাইলে বিবাদ এবং সংঘর্ষের সূচনা। আজেরী বা আজেরবাইজানীরা মুসলমান, মুলত শিয়া। অন্যদিকে আরমেনীয়রা অ্যাপস্টলিক খ্রিস্টান। ১৯৯৪ এর আজেরবাইজান – আর্মেনিয়া সংঘর্ষের পর OSCE Minsk Group এর মধ্যস্থতায় যুদ্ধ থামে। নাগরনো – কারাবাখে সৃষ্টি হয় Republic of Artsakh অথবা Nagorno – Karabakh Republic (NKR)। ২০২০ তে আবার আজেরবাইজান আক্রমণ করে এবং ইসলামি মিলিশিয়াদের দিয়ে কয়েকটি এলাকা দখল করে নেয়। এবার রাশিয়ার হস্তক্ষেপে আজেরবাইজান – আর্মেনিয়া যুদ্ধ থামে এবং রাশিয়ার তত্বাবধানে আর্মেনিয়ার সঙ্গে NKR এর একটি করিডোর তৈরি হয়। ২০২২ এ আজেরবাইজান অবরোধ শুরু করার পর ২০২৩ এ তুরস্কের সামরিক সাহায্যে বলীয়ান হয়ে আবার আক্রমণ করে। খনিজ তেলের উৎপাদক হিসাবে ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী আজেরবাইজানকে ইজরায়েলও সামরিক দিক থেকে সাহায্য করে। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় রাশিয়া সেভাবে আর্মেনিয়াকে সাহায্য করতে পারেনা। আজেরবাইজান নাগরনো – কারাবাখ দখল করে নেয় এবং সেখানকার সমস্ত আর্মেনীয় উদ্বাস্তু আর্মেনিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পরিব্রাজন করেন। আর্মেনিয়া ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং আধিপত্যবাদী সামরিক শক্তিধর তুরস্ক ও আজেরবাইজান এর ভয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঝোঁকে এবং ন্যাটোর আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে।
১৯৯১ তে সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়া ভাঙ্গার পর স্লোভানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া – হার্জেগোভিনা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যায়। এরপর বসনিয়া – হার্জেগোভিনার মুসলমান বসনিয়াক ও ক্যাথলিক খ্রিস্টান ক্রোটদের সঙ্গে অর্থোডক্স খ্রিস্টান সার্বদের ভয়ানক সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৯৯২ – ১৯৯৫ অবধি বহু গণহত্যা, গণধর্ষণ ও জাতি বিতাড়নের (Ethnic Cleansing) সাক্ষী এই বলকান যুদ্ধের পর মুসলিম অধ্যুষিত বসনিয়া – হার্জেগোভিনার মধ্যে সার্বদের Republica Srpska রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ইউরোপ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েন। একই ঘটনা ঘটে চলেছে দুর্ভিক্ষ পীড়িত, গৃহ যুদ্ধ ও জেহাদি আক্রমণে জর্জরিত আফ্রিকার দেশগুলিতে এবং অন্যত্র। প্রতিবেশী বাংলাদেশে জামাতীরা ক্ষমতায় ফিরে আসায় বেড়ে গেছে সংখ্যালঘুদের উপর পীড়ন এবং বিতাড়ন ও দেশান্তর। অর্থনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সোভিয়েত পরবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি থেকেও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিব্রাজন ও অভিবাসন ঘটে চলেছে। আবার দারিদ্র ও রাষ্ট্রীয় পীড়নের পাশাপাশি একের পর এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের কারণে নেপাল, মায়ানমার, আফগানিস্তান, পূর্ব তুরস্ক, জাভা ইত্যাদি দেশ ও অঞ্চল থেকে পরিব্রাজন ঘটে চলেছে।
দমন করে পরিব্রাজন এবং অভিবাসন পুরোপুরি বন্ধ করা যায় নাঃ এর বড় প্রমাণ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর জার্মানি এবং বর্তমান ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বার্লিন প্রাচীর তুলে এবং কড়া পাহারা বসিয়ে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত বার্লিন ও পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিমী নিয়ন্ত্রিত বার্লিনে ও পশ্চিম জার্মানিতে (FRG) যাওয়া আটকানো যায়নি। বহু মৃত্যু ঘটেছে তবুও মানুষ দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে সেখানে পৌঁছে গেছেন। অবশেষে ১৯৮৯ তে বার্লিন প্রাচীরকেই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এবং দ্বিখণ্ডিত করে রাখা দুই জার্মানি আবার একীকৃত হয়েছে। উন্নত জীবনযাত্রা এবং মুক্ত পরিবেশের যাচঞায় পূর্ব ইউরোপ থেকে মানুষ যাবতীয় ঝুঁকি নিয়ে কাঁটাতার পেরিয়ে পশ্চিমে চলে গেছেন। যেমন ধরুন বিশ্ববন্দিত রোমানিয়ান জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানেচি ও তাঁর পরিবারের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ভিসা, অভিবাসন ও নাগরিকত্ব নিয়ে প্রচুর কড়াকড়ি করেছে। তথাপি দেখা যাচ্ছে সারা পৃথিবী থেকে বিশেষ করে সমস্যাদীর্ণ উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া এবং মধ্য প্রাচ্য থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে পলকা ভেলায় কিংবা জাহাজের খোলে বা কনটেইনারে ঢুকে মানুষ ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছেন। কড়াকড়ি সত্ত্বেও সারা পৃথিবীর মানুষ প্রাচুর্যের হাতছানিতে জল – স্থল – আকাশপথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ছুটছে। মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে পাঁচিল, কাঁটার বেড়ার নিচ থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে; মরুভূমি, জলাভূমি ডিঙিয়ে নিউ মেক্সিকো, টেক্সাস, অ্যারিজোনা ও ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে ঢুকে পড়ছে।
পরিব্রাজন এবং অভিবাসনের সমস্যা যেমন বহু বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তেমনই জটিল। তাই সমাধানও শক্ত। দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ মানুষ বাধ্য হয়েই নিজেদের জন্মস্থান, ভিটেমাটি, পরিবেশ, পরিবার, সমাজ, রাজ্য, দেশ ছেড়ে চলে যান। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ – মার্কিন প্রবর্তিত আর্থিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, এরসঙ্গে মৌলবাদী ইসলামি ইত্যাদি ধর্মীয় উন্মাদনা ও যুদ্ধ – সংঘর্ষ এর তীব্রতা এবং পরিমাণ বাড়িয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ, বিভিন্ন মানবতাবাদী সংগঠন যখন শরণার্থীদের পুনর্বাসন, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিষেবার উপর কাজ করছেন; পশ্চিম ইউরোপ ও কানাডা যখন ধীরেধীরে অভিবাসন নীতি পরিবর্তন করছে, তখন জার্মান ও স্কটিশ অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যার প্রথম স্ত্রী ইভানা চেক অভিবাসী ও তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়া যুগোস্লাভ অভিবাসী, যেভাবে সব কিছু দোষ মার্কিন অভিবাসীদের ঘাড়ে চাপিয়ে তাঁদের একাংশকে শেকল বেঁধে ভারতে কিংবা এল সাল্ ভাদর এর কুখ্যাত জেলে পাঠাচ্ছেন সেটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভারত সরকারের জোরালো প্রতিবাদ করা উচিত ছিল।
মনে রাখতে হবে ২০০৯ এর বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্টে শ্রমের পরিব্রাজনকে স্বীকৃতি দিয়ে এটিকে উন্নয়নের একটি সূচক হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। নিশ্চিতভাবে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত পরিব্রাজন ও অভিবাসন প্রতিরোধ করতে সুষ্ঠ ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু কেবলমাত্র দমন করে পরিব্রাজন এবং অভিবাসন বন্ধ করা যাবে না।
২২.০৬.২০২৫