ডাক্তারবাবুদের একটা বড় অংশ বড্ডো আহত হয়েছেন। অনেকে তো বেজায় চটেছেন। পাব্লিকের গালিগালাজ শোনার অভ্যেস তাঁদের অনেক বছরের, সে প্রায় সয়েই গিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাল্কা ধাক্কাধাক্কি টুকটাক গায়ে হাত পড়া ইত্যাদির সঙ্গেও মানিয়ে নেওয়া বাদে উপায় নেই। কিন্তু সান্ধ্য টিভির পর্দায় তাবড় ‘বিশেষজ্ঞ’-কুল প্রশ্ন তুলছেন, এই সব ডাক্তাররা আয়নায় মুখ দেখেন কী করে, বাড়ির লোকেদের ‘ফেস করেন’ কী করে ইত্যাদি প্রভৃতি – এমন পরিস্থিতি নতুন।
ঘটনাটি নিয়ে বলার কিছু নেই, সকলেই জানেন। রাজ্যের ‘শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল’-এর ‘শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক’-রা গোলটেবিল বৈঠক করে জানালেন, মন্ত্রীমশাইয়ের অসুস্থতা অতি জটিল গোত্রের, দিনকয়েক আইসিইউতে না রেখে কিচ্ছুটি বলার উপায় নেই – আর পরদিনই আদালতের নির্দেশে পরীক্ষানিরীক্ষা করে ভিনরাজ্যের হাসপাতাল সটান জানিয়ে দিল, অসুস্থতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভর্তি করার মতো নয় – ‘শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল’ ও সেখানকার ডাক্তারবাবুদের নিয়ে একেবারে ছিছিকার পড়ে গেছে!!
রাজ্যের ‘শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল’ অবশ্য শ্রেষ্ঠত্বের বিশেষ একটি মাপকাঠিতে অনন্য। এমনই সে অনন্যতা, যে ক্ষমতাসীন নেতা-মন্ত্রীদের পুলিশ-ইডি-সিবিআই তাড়া না করলে তাঁরা কেউ সেখানে ভর্তি হন না – সত্যিকারের চিকিৎসা করানোর জন্য অনিবার্যভাবে শহরেরই অন্যান্য কর্পোরেট হাসপাতালের দ্বারস্থ হন – স্মরণকালের মধ্যে মাত্র একজনই মন্ত্রী সেখানে সত্যিসত্যি চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন, এবং দুর্জনে বলে তিনি যখন আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন (এবং মারাও যান), তখন হাসপাতালে ভর্তি থাকা সত্ত্বেও তাঁকে দেখার জন্য চটজলদি ডাক্তার মেলেনি (ডাক্তারবাবুদের অবশ্য দোষ নেই, সম্ভবত দীর্ঘ অনভ্যাসে তাঁরা ভুলেই গিয়েছিলেন যে নেতা-মন্ত্রীরা এমনকি চিকিৎসার জন্যও কেবিনে ভর্তি হন)। এমনই ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ যে প্রবাদপ্রতিম গায়িকা সেখানে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হলেও রাজ্যের মাথা তড়িঘড়ি তাঁকে ‘বেটার ট্রিটমেন্ট’-এর জন্য শহরের অন্য হাসপাতালে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরা অবশ্যই ‘শ্রেষ্ঠ’। নইলে কি এঁদের অনেকেই একটি বদলিযোগ্য চাকুরিতে বিগত দেড়-দুই-আড়াই দশক একটি জায়গায় সুস্থিত হয়ে থাকতে পারতেন? কেউ কেউ তো অবসর গ্রহণের পরেও বহাল তবিয়তে হোমরাচোমরা হয়ে আছেন। গেঁড়ে-বসে-থাকার এই সংস্কৃতি বাম আমলেও ছিল, কিন্তু তারপর সরকার বদলেছে, এঁদের হত্যে দেবার আধার বদলেছে, ‘পোস্টিং’ বদলায়নি। তার জন্য অল্পবিস্তর মূল্য চোকাতে হলেও ‘শ্রেষ্ঠত্ব’-র শিরোপা অবিচল থেকেছে। মূল্য বলতে সামান্যই। বিবিধপ্রকার ‘ম-কার’-এর সাধনায় নিবিষ্ট বিশিষ্টজনেরা বিপাকে পড়লে ‘চিকিৎসার জন্য ভর্তি থাকা জরুরি’ বলে দাগিয়ে দিতে পারা, এবং চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি সাজাতে পারা। এবং এমন তর্কাতীত ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ অর্জনের জন্য সেই হাসপাতালের প্রশাসনিক প্রধান সরকারের তরফে রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পেলেন, এও কি কম চমকপ্রদ!!
এসএসকেএম-এইমস-এর এমন চিকিৎসা-সিদ্ধান্তের ফারাক দেখে অনেক ডাক্তারবাবু বলছেন, চিকিৎসা-বিজ্ঞানে ‘ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন’ তো নতুন কথা নয়, তাতে এমন করে দোষারোপ করার কী আছে! ঠিকই! শুনলেও মনটা ঠান্ডা হয়!! পুলিশ যখন শাসকদলের অপরাধীদের আড়াল করেন আর বিরোধী দলের মিটিং-মিছিলে প্ররোচনাহীন লাঠি চালায় – সেও তো একরকম ‘ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন’! শাসকের তাণ্ডবে টেবিলের তলায় লুকিয়ে থাক পুলিশ যখন রাস্তায় ভ্যানওয়ালার উপর জোর চোটপাট করেন – হতদরিদ্রের মামলা আদালতে উঠতেই বছরের পর বছর গড়িয়ে গেলেও প্রভাবশালী খুনী তিনদিনেই জামিন পেয়ে যান – ধর্ষক প্রভাবশালী হলে থানায় ধর্ষিতা দ্বিতীয়বার মানসিক ধর্ষণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরেন – হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের রায়ের উপর কোনও এক অলৌকিক উপায়ে ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ামাত্র বারবার স্থগিতাদেশ পড়ে যায় – এসব নিশ্চয়ই ‘ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন’-এর আওতায় পড়বে। ‘ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন’-এর তেজ এমনই যে বিরোধী দলের বিধায়ক ‘শ্রেষ্ঠ’ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলে তাঁকে পত্রপাঠ বিদায় করে দেওয়া হয়, যদিও অন্যত্র পরীক্ষায় তাঁর হাড়ে চিড় ধরা পড়ে। অতএব, ‘ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন’ আজকাল হরবখত দেখা যাচ্ছে৷ তবে দেখুন, যথেষ্ট মজবুত আইন থাকা সত্ত্বেও পুলিশ যখন স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ভাঙচুর চিকিৎসক-নিগ্রহের ঘটনায় সহজ জামিনযোগ্য ধারা রুজু করে – অপরাধীরা যাতে সহজেই ছাড়া পেয়ে যেতে পারে – সেও কিন্তু ‘ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন’ বই অন্য কিছু নয়, অথচ সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক বন্ধুরা কেমন একটা অকারণে অভিমানী হয়ে বসেন।
আরেক দল চিকিৎসক বলছেন, টিভিতে বসে বড় বড় বোলচাল সবাই মারতে পারেন। ডাক্তারদের আজকাল যে কী অপরিসীম রাজনৈতিক চাপ সহ্য করে কাজ করতে হয়, সেটা মনে না রাখলে ইত্যাদি প্রভৃতি! তা সেই যুক্তি তো পুলিশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা সাংবাদিক, সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অপর পেশার মানুষজনের নির্লজ্জ চাটুকারিতা দেখে গালি দেবার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা যে নিতান্ত পিছপা, এমন তো দেখিনি। তাহলে?
ভাবের ঘরে চুরি করতে যাঁরা এখনও তেমন পোক্ত হয়ে ওঠেননি, তেমন সত্যভাষী ডাক্তারবাবুরা বলছেন, ওই হাসপাতালের ডাক্তারদের দোষ দিয়ে লাভ কী! যা অবস্থা, তাতে সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল, হাসপাতাল বা প্রাইভেট চেম্বার – সর্বত্রই ডাক্তাররা রাজনৈতিক নেতাদের তোয়াজ করে চলেন। মন্ত্রী তো অনেক দূরের কথা, পঞ্চায়েত-সদস্য থেকে স্থানীয় নেতা, সবারই ‘চাহিদা মেনে’ চলেন। চলতেই হয়। তাহলে? ঠিক কথা। একেবারে একশ শতাংশ সহমত। কিন্তু এই অবস্থার সৃষ্টি হলো কী করে? লাই দিলে, শুনেছি, নিতান্ত প্রভুভক্ত প্রাণীও মাথায় চড়ে বসে, রাজনীতির কারবারিরা ব্যতিক্রম হতে যাবেন কোন দুঃখে! অতএব, দোষটা রাজনীতিকদের যতখানি, ডাক্তারদেরও কিছু কম নয়। সরকারি চাকরি যাঁরা করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে সুবিধেজনক জায়গায় পোস্টিং, বদলির হ্যাপা পোয়াতে না হওয়া, ঠিকঠাক সময়ে পদোন্নতি – আর বেসরকারি ডাক্তারবাবুদের ‘প্র্যাক্টিস’-এর সুবিধে – এটুকুর জন্য এত কিছু মেনে নেবেন!
এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকদের পক্ষে অবশ্যই যুক্তি সাজানো যায়। ‘ডিফারেন্স অফ ওপিনিয়ন’ এক্ষেত্রে রোগনির্ণয়ে নয়, সিদ্ধান্তের ফারাক সেই রোগ কতখানি গুরুতর সে নিয়েই। এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকরা অবশ্যই যোগ্য – অনেকে তো নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশের সেরাদের অন্যতম – ভুল ডায়াগনোসিস তাঁরা করেননি। এও সত্য যে, মন্ত্রীমশাইয়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ভুবনেশ্বর এইমস-এর ডাক্তারবাবুরা অনায়াসে হাত ধুয়ে ফেলতে পারেন, বলতেই পারেন যে তাঁদের মতামত ছিল সেদিনকার পরিস্থিতি অনুসারে এবং তাঁরা জ্যোতিষী বা ভবিষ্যতদ্রষ্টা নন ইত্যাদি প্রভৃতি – সেই একই কথা বলে এসএসকেএম-এর ডাক্তারদের পক্ষে পার পাওয়া মুশকিল। কিন্তু এই যুক্তি মেনে নিলেও জেরা শেষ হতে না হতেই মন্ত্রীমহোদয়ের জন্য আইসিইউ রেডি করে ফেলার পক্ষে যুক্তি পাওয়া কঠিন। বা যুক্তিটা এতখানিই স্পষ্ট যে তাকে সমর্থন করতে পারা কঠিন।
গালিগালাজে অংশগ্রহণ না করলেও কিছু কথা সরকারি চিকিৎসকদের, বিশেষ করে এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকদের, উদ্দেশ্যে বলা জরুরি। কথাগুলো সামগ্রিকভাবেই চিকিৎসক-সমাজের ভেবে দেখা প্রয়োজন। সিবিআই-ইডি-র তাড়া খাওয়া নেতার হাইড্রোসিলের চিকিৎসার জন্য যাঁরা মেডিকেল বোর্ড বসান, তাঁরা প্রত্যেকে চিকিৎসক হিসেবে উজ্জ্বল ও সুপ্রতিষ্ঠিত। যদিও কবিগুরু অনেক আগেই বলে গিয়েছেন, ‘এ জগতে হায়, সে-ই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি’ – তবু বলি, শুধুমাত্র বদলি ঠেকানো আর সরকারি মহলে অল্পবিস্তর ‘সমাদর’, এটুকুর জন্য পেশাগত দায়বদ্ধতা আর সম্মান এমন করে ভেসে যেতে দেবেন! চিকিৎসক হিসেবে আপনার সম্মান তো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গেও জড়িয়ে – সেই দিকটা ভেবে দেখবেন না!
তদুপরি আপনারা শিক্ষক। ক্লাসরুম টিচিং, বেডসাইড ক্লিনিকাল টিচিং, এসবের থেকে ছাত্রছাত্রীর চোখে শিক্ষকের রোলমডেল হয়ে ওঠাটা কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ছাত্রের মনে শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের স্মৃতি অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী, পড়ানোর চাইতে অনেক বেশি। একটি আস্ত প্রজন্ম কি তাহলে ডাক্তারির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের ‘তেলিয়ে চলা’-কে সর্বময় সত্য হিসেবে জানবে? ক্ষমতাসীনের পক্ষে সে খুবই সুবিধেজনক, কিন্তু বৃহত্তর সমাজের পক্ষে? সমাজের চোখে চিকিৎসকের সম্মান ক্রমহ্রাসমান, তার কারণ বহুবিধ। কিন্তু আপনারা কি সেই অধোগতিতে সক্রিয় সাহায্য জোগাচ্ছেন না?
মেডিকেল শিক্ষার নতুন পাঠ্যক্রমে, শুনছি, মেডিকেল এথিকস-এর উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হবে। কিন্তু ওসবের ঢের আগে তো একজন মানুষের ব্যক্তিগত নীতিবোধ – তার কথা কে বলবে! চিকিৎসকের সরকারি চাকুরি কিন্তু রেজিমেন্টেড বাহিনীর চাকুরি নয় – মেডিকেল এথিকস ও ব্যক্তিগত নীতিবোধ অগ্রাহ্য করে হুকুম তামিল করার দায় তাঁর নেই। যিনি নীতি বিসর্জন দিচ্ছেন, তিনি চাকরির দায়বদ্ধতার কারণে দিচ্ছেন না, দায়বদ্ধতার নামে অজুহাত খাড়া করছেন মাত্র। হ্যাঁ, জানি, পুরো সমাজের নীতিবোধ যখন অধোগামী, তখন আলাদা করে একটি পেশার মানুষজনের ইত্যাদি প্রভৃতি – কথাগুলো অনেকবার শোনা, অনেকবার নিজেও বলেছি। তবু আজ বলতে হচ্ছে, বাস্তবতাকে ভবিতব্য হিসেবে মেনে নেওয়াটা বড় ভুল। কোনও এক জায়গা থেকে বাস্তবতাকে বদলানোর কাজটা শুরু করতে হয়। সেই নীতিবোধ ফিরিয়ে আনার কাজটা সক্রিয়ভাবে শুরু করতে না পারুন, অন্তত নীতি-বিসর্জনের সপক্ষে সাফাই দেওয়াটা বন্ধ করুন, প্লিজ।
কথাগুলো চিকিৎসক সংগঠনগুলিরও ভেবে দেখা জরুরি। যেমন কাজে সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা পেশার সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়, তেমন কাজে জড়িত চিকিৎসকদেরও কি ‘আমাদেরই একজন’ ভেবে চলা হবে? এরপরও??