কোভিড পরবর্তী সময়ে ভাইরাসের জগত পরিবর্তিত হয়েছে লক্ষ্যনীয় ভাবে। প্রতিদিনের রোগীর ভিড়ে সে সত্য অনুভব করে চলেছি নিয়মিত। তবে এ বছরে মাম্পস ভাইরাসের দৌরাত্ম্য যেন অন্য সব বছরের তুলনায় মাত্রাতিরিক্তভাবে বেশি। নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে প্রতিনিয়ত ভিড় বাড়ছে মাম্পস রোগীদের। একান্ত আলাপচারিতায় কারন হাতড়ে অবাক হওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু লক্ষ্যভেদ হয়নি। আমার চেম্বারও তার ব্যতিক্রম নয়। গত কয়েকমাসে যে পরিমান মাম্পসের রোগী দেখেছি, গত এক দশকের চিকিৎসক জীবনে তার সিকি শতাংশও দেখিনি। প্রধানত কিশোর ও সদ্যযুবকেরাই আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।
তেমনই এক সদ্যযুবার গপ্পো বলবো আজ। গত মাসে হালকা জ্বর,গা হাত পা ব্যথা নিয়ে এসেছিলো চেম্বারে।প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করার সময় দেখলাম কানের নিচে থাকা প্যারোটিড গ্ল্যান্ডের জায়গায় ফোলা। গলার ভেতর লাল হয়ে থাকা ছাড়া বিশেষ কিছু নেই।রোগের প্রকৃতি দেখে বুঝলাম ভাইরাল প্যারোটাইটিস হয়েছে। অর্থাৎ কিনা প্রাথমিক ভাবে যাকে আমরা মাম্পস বলি। যদিও এই রোগ সময়ের সাথে সাথে নিজে থেকেই সেরে যায় তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামুলি কিছু অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ দিয়েই এতদিন ক্ষান্ত হতাম। কিন্তু এবছরের অভিজ্ঞতায় ভাইরাল মাম্পস থেকে জটিলতা তৈরি হতে দেখেছি অনেকক্ষেত্রেই।তাই আর কালবিলম্ব না করে প্রয়োজনমত ওষুধ দিয়ে রাখলাম। যুবকের সাথে আসা সদ্যযুবতী কপালের ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো “ কিছু অসুবিধা হবে না তো স্যার?” সত্যি বলতে কি, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ইদানীং খুব বিব্রতবোধ করি। আসলে, মাম্পস থেকে খুব সাধারনভাবে মাম্পস অর্কাইটিসের মতো সহজ জটিলতা যেমন তৈরী হয় তেমনি আবার মাম্পস থেকে এনসেফালাইটিসের মতো প্রানঘাতী জটিলতাও তৈরী হতে পারে। এসবের কথা বলে রোগীকে ঘাবড়ে দিতে চাই না বলে উত্তর দিলাম, “ কিচ্ছু ভয় নেই।তবে অন্ডকোষে ব্যথা হলে জানিও”।
আমার এই শেষ কথাটিতে এখনকার ইংলিশমিডিয়ামে পড়া সদ্যযুবা বিশেষকিছু বুঝতে না পারলেও বাংলামাধ্যমে পড়া যুবতী চোখ গুলো গোল গোল করে ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো “গলা ব্যথা জ্বরের সাথে ওখানের কি সম্পর্ক?”
আমি ওদের ভয় না বাড়িয়ে অভয় দেবার ভঙ্গিতে হাত তুলে আস্বস্ত করে বললাম “ এখনই ভয় পাবার কিছু নেই। অসুবিধা হলে জানিও”
চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাবার পথে স্পষ্ট শুনতে পেলাম ইংলিশ মিডিয়ামের যুবককে বোঝানোর চেষ্টা চলছে, “অন্ডকোষ মানে টেষ্টিস”..
যুবক ফিরে এলো ঠিক পাঁচ দিনের মাথায়। উদ্ভ্রান্তের মত চেম্বারে ঢুকেই গদগদ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো- আপনার কথা মতই টেষ্টিসে ব্যথা শুরু হয়েছে স্যার। বিশেষ করে ডানদিকের টেষ্টিস বেশ ব্যথা। হালকা ফুলেও আছে।
পরীক্ষা করে দেখলাম ডানদিকের অন্ডকোষ বেশ ব্যথা। সাথে এপিডিডাইমিসের প্রদাহ হয়ে ফুলে আছে। টর্চের আলো দিয়ে দেখলাম ফুলে যাওয়া অন্ডকোষকে ঘিরে সংক্রমনজনিত তরল জমে হাইড্রোসিলও হয়েছে।এক্ষেত্রে সাসপেনসরি ব্যান্ডেজ বেঁধে রাখা জরুরী। তাই সেটি বাঁধতে বলে সঠিক ভাবে রোগনির্ণয়ের জন্য ঐ জায়গার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে আনতে বললাম চটজলদি।
ঘন্টা চারেকের মধ্যেই আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট হাতে নিয়ে এলো যুবক। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। অর্কাইটিস হয়েছে। সাথে সংক্রমণজনিত তরল জমে হাইড্রোসিলও আছে। টেষ্টিকুলার টরসান নেই।অর্থাৎ কিনা শল্যবিভাগের শরনাপন্ন হবার প্রয়োজনীয়তা আপাতত নেই।
যুবককে প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে আশ্বাস দিয়ে বললাম, হপ্তা দুয়েকের ভোগান্তি। দিন তিনেকের মধ্যে ব্যথা কমে গেলেও ফোলাভাব কমতে বারো- চোদ্দো দিন লাগবে। এই কয়েকদিন সাসপেনসারি ব্যান্ডেজ বেঁধে রাখতে হবে। ওই জায়গায় চাপ যাতে কম লাগে, সে ব্যাপারে নজর রাখা জরুরী।
মাথা নেড়ে ভয়ার্তমুখে সেদিনের মত চেম্বার থেকে বিদায় নিলেন যুবক। দিন পনেরো বাদে হাসিমুখে চেম্বারে এলেন। পরীক্ষা করে দেখলাম গলা ও অন্ডকোষের ফোলা দুইই কমেছে। ব্যথা প্রায় নেই বললেই চলে। এপিডিডাইমিসের ফোলা ভাবটাও মিলিয়ে গেছে।জমে থাকা তরলের পরিমান অনেক কমে গেলেও কিছুটা তখনও আছে।
“ভয়ের কিছু নেই। সামান্য এই ফোলাটুকুও চলে যাবে।সময় দিন। ওষুধ আর লাগবে না”।
আমার কথাশুনে আস্বস্ত হলেন যুবক। কিন্তু যুবতীর কপাল তখনও ঈষৎ চিন্তাকুঞ্চিত।মনের ভাব বুঝতে পেরে দুজনের দিকেই তাকিয়ে বললাম- চিন্তা নেই। এই রোগে পুরুষত্বহীনতা হতে আজ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি। এবার আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে দুজনেই বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে যুবতীর কুঞ্চনমুক্ত কপাল আমার চোখ এড়ায়নি।