ফুন্টসোলিং হয়ে জয়গাঁ থেকে বাসে উঠে ফেরার সময় পাভেল কর্চাগিনের হোটেল জীবনে বুঁদ হয়ে কষ্ট পেতে পেতে ফেরা বালকটির কখনো মনে হয় নি যে বাসে ওঠার ঠিক আগে বাসস্ট্যান্ডের যে হোটেলটায় পেট পুরে খেয়ে এলো সেই দোকানের টেবিল মোছা ছেলেটির বয়েসও ঠিক পাভেলের মতো, রাশিয়ার মতো আমাদের দেশেও কিছু একটা হয়ে গেলে হয়তো সেই ছেলেটির হাতে ভিজে টেবিল মোছার ন্যাকড়ার বদলে হয়তো একটা বই থাকতো, হয়তো বইটার নাম হতে পারতো ইস্পাত। করলা ব্রিজ ছাড়িয়ে নেতাজির স্ট্যাচুর সামনের ফাঁকা জায়গায় বসে আড্ডা দেওয়া কিশোরের সামনে ইস্কুল ফেরত, বুকের কাছে সযত্নে আঁকড়ে ধরা বইখাতা সহ একঝাঁক লাল পাড় সাদা শাড়ির মধ্যে চোখ যখন খুঁজে বেড়াতো কে হতে পারে তার সেই ইস্পাতের তানিয়া, তখন নতমুখে জঞ্জাল কাচড়া হাঁটকে বেড়ানো, কাগজ কুড়ানো সেই ছেঁড়া ফ্রকে সেফটিপিন আটকানো কিশোরী তার চোখে ধরা পড়েনি, রাশিয়ার মতো আমাদের দেশেও কিছু একটা হয়ে গেলে হয়তো সেই মেয়েটির কাঁধে মলিন চটের বস্তার বদলে হয়তো বইয়ের ব্যাগ থাকতো যার মধ্যে হয়তো লুকিয়ে থাকতো একখণ্ড ইস্পাত।
গভীর রাতে পার্টির মিটিং সেরে বেনিয়াপুকুর স্ট্রিটের হোস্টেলে ফিরে টকটক করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে উঠতে যে যুবকের মনে হত সব ঠিকই তো আছে, দারুণ আলোচনা হল আজ, কেবল কয়েকটা বন্দুক পেলেই, সেই ইস্পাতের কোন চাষীর চালাঘরে বন্দুকের পাঁজা ছিল না, তেমনটা যদি পাওয়া যেত, দুহাতের মুঠোয় একটা বন্দুক। সেই যুবকের খেয়াল হয় নি যে হোস্টেলের গেটের কাছেই বস্তির ঘরে এখনও আলো জ্বেলে যে যুবকটি একমনে জুতো সেলাই করে যাচ্ছে তার হাতে সেলাইকলের বদলে বন্দুক উঠে আসার কথা ছিল যদি রাশিয়ার মতো আমাদের দেশেও কিছু একটা হয়ে গিয়ে থাকতো।
সেই বালক, সেই কিশোর, সেই যুবক এখন প্রৌঢ় হয়ে গেছে। সে জেনে গেছে রাশিয়ার মতো আমাদের দেশেও কিছু একটা আর বোধহয় হবে না। তবুও কেন কে জানে, তার যখনই মন খারাপ হয় সেই ন্যাতা হাতে বালক, সেই কাগজ কুড়ানো কিশোরী, সেই সেলাই কলে ঝুঁকে পড়া যুবকের কথা ভেবে, অজান্তে তার হাত চলে যায় বইয়ের আলমারির দিকে। এটা ওটা সরিয়ে তাক থেকে নামিয়ে আনে দুখন্ড ইস্পাত। সযত্নে ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝেড়ে বালিশের পাশে রেখে দেয়। বইটা খুলে পড়তে শুরু করে না, বরঞ্চ প্রেসারের ওষুধটা খায়, তারপরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পরে। স্বপ্নে চুঁইয়ে যদি দেখা দেয় আরেকবার, শেষবারের মতো পাভেল কর্চাগীন।
আজ নিজের জন্মদিনে নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি এসে উপহার দিয়ে যাবেন সেই স্বপ্ন, যেমনটা দিয়েছিলেন সেই অনেক দিন আগে। দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে না পেলে মানুষ বাঁচবে কি করে?
২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২২।