কিছু কিছু মানুষ সারাজীবনের জন্য বুকের বাঁদিকে রয়ে যায়। শুভ্রদা সেরকম একজন মানুষ। আটষট্টি বছরের তরুণ তুর্কী। অ্যানাস্থেসিয়ায় স্পেশালাইজেশন করা। দারুণ হুল্লোড়ে, রসিক, পরোপকারী, সংগঠক, লেখক এবং নির্ভরযোগ্য চিকিৎসক। আইএমএর সেক্রেটারি, রেডক্রস এবং বিভিন্ন ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মানুষটি একটি নার্সিংহোমের কড়া মালিক। মাঝেমধ্যেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়তেন। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ছাব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকতেন। বেড়াতে যাওয়া নিয়ে কোনও বাছবিচার ছিলনা। এই শুনলাম বর্ধমান ঘুরতে যাচ্ছেন তো কিছুদিন পরেই শুনি “অরোরা বোরিয়ালিস” দেখতে যাবেন। আমার ভূগোলের জ্ঞান অসাধারণ। এখনও আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হলো ভূগোল পরীক্ষায় বসেছি। আমি পর্যন্ত চোখ দুটো ব্রহ্মতালুতে উঠিয়ে বললাম – “সে তো নর্থ পোলে।” যাই, দেখে আসি। শুভ্রদার সংক্ষিপ্ত উত্তর। যেন সুকুমার রায়ের হযবরল। ‘ কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট, তিব্বত,- ব্যাস্ ! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হল ।’ শুভ্রদার লেখা দুই পর্বে একটা বইও আছে- ‘আট ভুবনের পারে।’
ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী শুভ্রদা সবার বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যে শহরে আমি প্র্যাকটিস করি সেটি খুব ছোট শহর। চেনা মুখের সংখ্যা বেশি। কিছু কিছু মানুষ আবার হাড়েহাড়ে চেনা। তাদেরকে সবাই মোটামুটি এড়িয়ে চলে। এরকম একজন মানুষের হার্নিয়া আটকালো। অসম্ভব ব্যথা। বেশিক্ষণ থাকলে নাড়িভুড়ি পচে মরবে। হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি। অপারেশনের আগের ইসিজিতে গোলযোগ ধরা পড়লো। স্বাভাবিক কারণেই অনডিউটি সার্জন তাঁকে রেফার করেন। ভদ্রলোক শহরের বাইরে যাবেননা। ( অচেনা পরিবেশে নৃত্যনাট্য দেখালে কেউ পাত্তা দেবেনা যে।) রাতদুপুরে এসে আমাকে তুললেন। তাঁকে শুভ্রদার নার্সিংহোমে নিয়ে গেলাম। শুভ্রদা রোগী দেখে মুচকি হেসে বললেন যে ওই ভদ্রলোকের সাথে ওনার কথা নেই। আমি জানালাম “ফেলে রাখলে মরে যাবে যে।”
“বেঁচে উঠলে হয় তোমার নিন্দা করবে নয়তো তোমার নামে কেস ঠুকবে।”
শুভ্রদা অ্যানাস্থেসিয়া দিলেন। রোগী ভদ্রলোক বেঁচে গিয়েছিলেন। সবাইকে বলে বেড়ান যে অপারেশনটা ঠিক হয়নি।
শুভ্রদা বলতেন তাঁর প্রথম পরিচয় যে তিনি একজন মানুষ আর দ্বিতীয় পরিচয় একজন ডাক্তার। তারপর তিনি কারো স্বামী, কারো পিতা, ভারতীয় নাগরিক, ধর্মে হিন্দু ইত্যাদি ইত্যাদি। ডাক্তারের কাছে শত্রু নেই, মিত্র নেই।
শুভ্রদার এমন ব্যক্তিত্ব ছিল যে সহজে তাঁর কথা অমান্য করা যেত না। আমি একবার বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে আঙুল ভাঙলাম। তার আগে অন্য একটা অ্যাক্সিডেন্টে কোমরের স্যাক্রাম বলে একটা হাড়ে চিড় ধরিয়েছিলাম। তার আগে চারচাকা চালাতে গিয়ে আইসক্রিমের গাড়িতে ধাক্কা দিয়েছি। মোটকথা, আমি ক্রনিক অ্যাক্সিডেন্ট রোগে ভুগি। চারচাকার জন্য ড্রাইভার আছে। শুভ্রদা গম্ভীর মুখে আদেশ দিলেন যে এবার বাইকের ড্রাইভার রাখো। বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে প্রতিটি অ্যাক্সিডেন্টই অন্যের দোষে হয়েছে। বাইকের ড্রাইভার রাখলে আমার আর প্রেস্টিজ থাকবেনা। ভবি ভুলবার নয়। গরুর গাড়ির হেডলাইট লাগাতে বাধ্য হলাম।
আমি ইষত ভুলো মনের মানুষ। নার্সিংহোমের অপারেশনগুলো সাধারণত বিকেলের দিকে রাখি। মোটামুটি খান তিনেক নার্সিংহোমে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেস করি। অপারেশনের সময় সমস্ত পোশাক বদলে স্টেরিলাইজড পোশাক পরে ওটিতে নামতে হয়। শেষ নার্সিংহোমে যখন অপারেশনের পরে পোশাক বদলাচ্ছি তখন দেখি পকেটে দুটো ঘড়ি। কিছুতেই মনে করতে পারলাম না দুটো ঘড়ি পরে বেরিয়েছিলাম কিনা। এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয় যে নার্স এবং ওটি স্টাফদের জিজ্ঞেস করা যায়না যে তারা ঢোকার সময় আমার দু’হাতে ঘড়ি দেখেছিল কিনা। দুটো ঘড়ির মধ্যে একটা একটু অচেনা লাগলো। আমি সেই নার্সিংহোমের ম্যানেজার নবদা-র হাতে ঘড়িটা দিয়ে বললাম ডক্টরস রুমের টেবিলে এটা কোনো ডাক্তার ভুল করে ফেলে গেছে।
তিন-চার দিন পরে শুভ্রদার নার্সিংহোমে অপারেশন করছি। শুভ্রদা খুব সিরিয়াস গলায় আমার কানেকানে বললেন – “ডক্টরস রুমে ঘড়ি, আঙটি, মানিব্যাগ খুলে রেখোনা। আমার লকারে ঢুকিয়ে রাখবে। চারদিন আগে ডাক্তার মুখার্জির ঘড়ি চুরি গেছে। আমরা পুলিশে জানিয়েছি।”
আমার হাতপা ঠান্ডা। যেন রবিন কুকের কোমা উপন্যাসের শেষ দৃশ্য চলছে। অপারেশন শেষ হলেই একপাল পুলিশ এসে আমাকে ঘিরে ধরবে। আমি ঘামতে ঘামতে শুভ্রদাকে আমার অ্যাঙ্গেল থেকে ঘড়ি – কাহিনী বললাম। হা হা হাসি শুভ্রদার। প্রথমে সেই নার্সিংহোমের নবদাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন ঘড়িটার দাবিদার জুটেছে কিনা। তারপর ডক্টর মুখার্জিকে ফোন। তোমার ঘড়িটা পুলিশ উদ্ধার করেছে। কিন্তু ওদের ইনফর্মারকে কিছু টাকা দিতে হবে। ডাক্তার মুখার্জি এককথায় রাজি। বিবাহবার্ষিকীতে তাঁর স্ত্রী ঘড়িটি গিফট করেছেন। বাড়িতে উঠতে-বসতে খোঁটা খাচ্ছেন।
রাতে জমাটি ফিস্ট হলো মুখার্জির দেওয়া টাকায়। ফিস্টের সময় শুভ্রদা গল্পটা সবাইকে বললেন। মুখার্জি সেইসময় খুব হাসলেও তারপর থেকে একসাথে অপারেশন থাকলে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঘড়িটা লকারে ঢুকিয়ে রাখেন।
আমি মাঝেমধ্যে শুভ্রদাকে জিজ্ঞেস করতাম যে এতো প্রাণবন্ত থাকেন কিকরে? অদ্ভুত একটা কথা বলতেন তিনি। এক্সটেনশনের জীবন কাটাচ্ছি। কোভিডের সময় লোকে কঠিন রোগের জন্য বাইরে যেতে পারছিল না। খুব বড়ো এবং এমারজেন্সি বেশ কয়েকটা অপারেশন করেছি সেইসময়। অ্যানাস্থেসিয়া দিতেন শুভ্রদা। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা তো যখন-তখন সীজারে ডাকতেন শুভ্রদাকে। শুভ্রদা না করতেন না। যেকোনো রোগীর কাছ থেকে ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা ছিল তখন। বেশিরভাগ অপারেশনই তখন এমারজেন্সি। কোভিড টেস্টের রিপোর্টের অপেক্ষা করা যেতনা। আর অপারেশনের সময় অ্যানাস্থেটিস্টদের রোগীর নাকমুখের বেশি কাছাকাছি থাকতে হয়। শুভ্রদা সাবধানে থাকলেও কাজ কমাতেন না। অপারেশন বাদ দিয়ে বাকি সময় কোথাও অক্সিজেন পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন তো কোথাও গুচ্ছ গুচ্ছ মাস্ক পাঠাচ্ছেন। বেশ কিছু পরিবারকে রেশন পাঠিয়ে সাহায্যও করছেন। শুভ্রদার হালকা কাশি হলো। প্রতিবছর এই সময়ে হয়। শুভ্রদা পাত্তা দিলেন না। আমাদের চাপে টেস্ট করালেন। নেগেটিভ এলো। চারতলায় সিঁড়ি ভেঙে উঠে একদিন হাঁফাচ্ছিলেন। প্রায় জোর করেই শুভ্রদার নার্সিংহোম পার্টনার ডাঃ তাপস চক্রবর্তী কলকাতার এক নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে ওনাকে ভর্তি করালেন।
এবার কোভিড পজিটিভ এলো। ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। লাংসের অবস্থা বেশ খারাপ। ভেন্টিলেটরে দিতে হলো। একমাস লড়াই চললো।
শুভ্রদার নিথর দেহ একমাস পরে নিজের শহরে ফিরলো। কোভিডের আবহাওয়াতেও শুভ্রদার বনবীথি পাড়ার বাড়িতে থিকথিকে ভিড় মানুষটাকে শেষ প্রণাম জানাবে বলে।
বাবা-মা তার কয়েকদিন আগে মারা গেছে। মনে হলো একেবারে অভিভাবক শূন্য হলাম আমি।
প্রত্যক্ষভাবে জানি, খুব বড় মনের মানুষ।
🙏🙏🙏
বাহ্। কি ভাল লিখেছ। ভারী প্রাণবন্ত।