সে অনেক কাল আগের কথা। তখনও একমাথা চুল ছকপাল বন্ধু ছিলো। হস্টেলে ঋতু বদলাতো। সন্ধের আগেই বাবুরবাগে উনুনের ধোঁয়া ওঠা পাড়ায় শীত তার কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দিতো। তখনও বাড়ির বৌ-ঝিরা রংওঠা শায়া পরে’ হস্টেলের পেছনে পুকুরে, বাসন মেজে ঝপাঝপ করে ডুব দিয়ে, গামছা জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরতো। ধানমাড়াইয়ের জায়গা থেকে তুষ উড়তো। তখন শ্যামসায়রের পুকুরপাড়ে মন্দিরে ঘন্টা বাজতো, বাবুরবাগের মসজিদে আজানের ডাক উঠতো।
ওমনি এক শীত বিকেলে, এক ঝাঁকড়া চুলের ছেলে হস্টেলের টানা বারান্দায় বসে আছে। পেছনে তার কয়েকজন বন্ধু। একজন একটা সরু দাঁতের দুমাথা চিরুনি দিয়ে তার চুল আঁচড়াচ্ছে।বাকিরা ওঁৎ পেতে বসে আছে। চিরুনির ফাঁদে উকুন আটকালেই দু আঙুলের নখের মধ্যে চেপে ব্যাটার পেট ফাটিয়ে দিচ্ছে। বহু প্রয়াসে গোটা দশেক উকুন পোকা হত্যার পর সবাই ক্লান্ত হয়ে চা বিড়ি ইত্যাদি খাওয়ার পরিকল্পনা করছে। অর্থাৎ হস্টেল ক্যান্টিন না অতুলদার দোকানে চপ মুড়ি সহ, সেটাই আলোচনার উপপাদ্য। ছেলেটা দশ আঙুলে ঘশঘশ করে মাথা চুলকোচ্ছে।
সিঁড়িতে গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে মানেই জয়দীপদা আসছে। কুংফু বিশারদ। বলা যায় ব্রুস লির ভক্ত। গানের গলাটা ভারী মিষ্টি। নীলে নীলে অম্বর পর চাঁদ যব আয়ে গানটা শুনেই বোঝা গেল, এই সঞ্ঝাকালে, ডিউটি সেরে, ভাত খেয়ে সে ঘরে আসছে, এবার পশ্চাৎ উল্টে পড়তে বসবে। এটা আমাদের জীবন। পড়া কাজ, পড়া। রেকারিং ডেসিমেল। আমাদের তখনও ওয়ার্ড শুরু হয়নি, কখনও বা সঞ্ঝাকালে নন্দিতায় (ভলিবল কোর্টের উল্টো দিকে, মনোহারী স্টোর্স, বিশকুট ওজন করা খুব ঝামেলার কাজ, অনেক বার চেষ্টা করে’ দেখেছি) বসে’ মেজদা (বিদ্যুৎ সঙ্কট দাস)-র সঙ্গে অরুণদার পয়সায় চা সিগারেট খাই।চোখ পরিষ্কার করি। চোখ পরিষ্কার করাই সার, প্রেম করার অবসর কোনোকালেই ছিলো না।
সেই বিশেষ শৈতসন্ধ্যায় জয়দীপদা বললো “মহারাজেরা সব কী করছেন?”
“দীপঙ্করের মাথার উকুন বাছছি”
“এভাবে হবে না। উকুন একটা পোকা, সন্ধিপদ প্রাণী। ষটপদী মানে ছটা পা। দুই থেকে সাড়ে তিন মিলিমিটার লম্বা। মাথায় হলে বলে পেডিকিউলোসিস ক্যাপিটিস। ক্যাপিটিস মানে মাথা, আর পেডিকিউলোসিস মানে পোকাক্রান্ত। সহজ ভাষায় মাথায় পোকা। আগে গামাবেঞ্জিন হেক্সাক্লোরাইড, গ্যামাক্সিন….এখন বলে লিন্ডেন লোশন। গায়ে খোশ হলেও বুঝবি উকুন। সেখানেও একই ওষুধ।”বোঝা গেল জয়দীপদা স্কিন ডিপার্টমেন্টে ডিউটি করছে।
আমাদের একজন খসখস করে কুঁচকি চুলকোচ্ছিল। ঐ যে বলে না? বিকৃত করিয়া মুখ….।
জয়দীপদা জ্ঞান ফলালো “তোর টিনিয়া ক্রুরিস হয়েছে।”
“সেটা?????”
“রিং ওয়ার্ম। দাদ। ফাঙ্গাস।”
“ঐ দোকান থেকে…”
“না না, ঐসব স্টেরয়েড একদম ব্যবহার করবি না। প্রথম আরাম পাবি, তারপর হু হু করে বাড়বে। ওষুধে সারবে না। তার্চে বরং ভালো অ্যান্টিফাঙ্গাল ব্যবহার কর, সেরে যাবে। পার্সোনাল হাইজিন ঠিক কর। জামা কাপড় নিয়মিত ফোটাতে হবে। অন্যের জাঙ্গিয়া, গামছা ব্যবহার করবি না”
“জয়দীপদা একটা ওষুধ বলে দাও, প্লিজ ….”
বোধহয় আজকে ওষুধটা ওয়ার্ডে পড়ানো হয় নি। জয়দীপদা পাত্তা না দিয়ে, টাটা করে নিজের টেবিল বাতি জ্বেলে বই মুখে বসে পড়লো। যেন মহাঋষি ঋষ্যকুম্ভ একশো আট মহালোহিতকুক্কুট সাধনায় বসেছেন (সেদিন আবার গ্র্যান্ড ফিস্টি ছিলো)।