জীবনে যে কয়েকটি মানুষের কাছে সত্যিকারের চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকব আমি, সূর্য তাদের মধ্যে অন্যতম। সূর্য। সূর্য দত্ত। কর্মসূত্রে আমার ভীষণ পরিচিত এক ছোকরা। বয়স… বয়স এই কতোই বা হবে আর.. ছাব্বিশ সাতাশ হবে মেরেকেটে। এবং যেইহেতু আমি বরাবরের ঠোঁট কাটা, সূর্যের সাথে আলাপের প্রথম দিনেই জিগ্যেস করেছিলাম তাই আচমকা–” তুমি প্রেম করো। তাই না? ধাক্কা খাওয়া প্রেম?”
প্রশ্নটা বড়ো স্বাভাবিক ছিল। এই শো-ম্যানশিপ আর সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে, ফেলুদা বা শার্লক হতে হয় না কাউকে। সেরেফ সব্যসাচী হলেও দেখতে পাওয়া যায় আশ্চর্য কিছু তথ্য। সূর্যের whatsapp প্রোফাইলে ট্যাগ লাইন –“আমি খুব ভালো আছি।” সূর্যকে ফোন করলে একটা ফোনে কলার টিউন বাজে–“জি ভে সোঁড়িয়া জি, চাহে কিসি কা হো কর্ জি”, আর অন্যটায়–” হোসানা”। এবং ছটফটে সূর্যের চোখেমুখে চিপকে থাকে এক আশ্চর্য মৃতবৎ স্থিরতা।
‘হোসানা’ অবশ্য আমি জানতাম না আগে। এরও এক বিচিত্র ইতিহাস আছে। সেটাই বলে নেওয়া যাক বরং আগে ভাগে।
রেহমান, এই যে এই… এ আর রেহমান, সলিল চৌধুরী আর শচীন দেব বর্মনের পরে আমার তৃতীয় প্রিয় কম্পোজার জেনে আমাকে প্রশ্ন করেছিল আমার এক পূর্বতন কলিগ ভুরু নাচিয়ে ।–” রেহমান প্রিয়? ওকে দেন… ‘ও আই নি’ মানে যে চাইনিজে আই লাভ ইউ এ কথা তুমি জানো? জানো যে জিন্স নামে রেহমানের প্রথম দিকের সিনেমায় অজুবা অজুবা নামে একটা গান ছিল? আর তার প্রি লিউড ছিল– ও আই নি। ও-ও আই নি?”
কলিগটির উচ্চশিক্ষা চীনদেশে। সুতরাং সন্দেহ করার বিন্দুমাত্র কারণ নেই।
আর তাই তখন হঠাৎ খেয়াল করে দেখেছিলাম রেহমানের গানে এরকম থাকে। বার বার।
ও আই নি। ( জিন্স। চাইনিজ। আই লাভ ইউ),
কে সেরা সেরা। ( পুকার। ইতালিয়ান/স্প্যানিশ। যা হওয়ার তা হবেই),
কুন ফায়া কুন। ( রকস্টার। উর্দু। আছে আর থাকবেই)
ফিদাতো। ( ঝুঠা হি সহি। ইতালিয়ান। অর্থ– যাকে বিশ্বাস করা যায় চোখ বুঁজে)
এবং
এই– হোসানা। ( ইক দিওয়ানা থা। হিব্রু বা এরামিক সম্ভবত। অর্থ সম্ভবত…আশ্চর্য আকুতি। বাঁচাও… প্লিজ বাঁচাও হে ঈশ্বর, হে পরমেশ্বর।)
এসব ওই তখনই জেনেছিলাম রেহমান নিয়ে পড়াশুনা করে টরে।
যাক সে কথা। বর্তমান গল্পে ফেরত আসা যাক বরং। মোটামাট কথা এই যে, সূর্যকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম প্রথম আলাপেই অকপটে–“প্রেম করো? ধাক্কা খাওয়া প্রেম?”
আমি এরকমই। আমার ভীষণ প্রিয় এক বান্ধবীকেও আমি আলাপের প্রথম দিনেই নির্লজ্জের মতো শুধিয়েছিলাম থিয়েটারি পজ নিয়ে-” তুই… প্রেম করিস। তাই না? লাস্ট ফোনটা তোর বয়ফ্রেন্ডকে করলি তো? এমন ধমকাচ্ছিলি, ওরম বরকে ছাড়া আর কাউকে ধমকানো যায় না। হেঃ।”
বান্ধবীটি, বলাই বাহুল্য ঘাবড়ে গিছলো।
তো, সেসব কথাও থাক। সে-ই সব কথা। কথা হোক সূর্যকে নিয়েই আপাতত। আর তারপরও, কথা যদি চায়, ডালপালা মেলে ধরবে নাহয় অন্যত্র। ক্ষতি কী?
ডি ট্যুর। আর ঘুর পথ। আর এলোমেলো হাঁটা।
জীবনও কি আদতে এরকমই নয় টলোমলো? গন্তব্য একমুখী পরম শূন্যের দিকে জেনেও রাজপথ ছেড়ে আচমকা ঢুকে পড়া মেঠো পথে? অবিরত চমৎকৃত হয়ে ওঠা ঘাসফুল ফ্যাকাশে দেখে? সমস্তই বকওয়াস আর সবটাই ফক্কা আর সবই বেকার জেনেও আঁকড়ে আঁকড়ে আর আঁ-ক-ড়ে রাখা ছোট্ট ছোট্ট অকিঞ্চিৎকর সব মুহূর্তকে?
গন্তব্য? নিয়তি? শেষদিন?
সে নাহয় নির্দিষ্ট হয়ে থাকতেই পারে। ওই যেমন বলে গুপিযন্তুর বাগানো বাউল-এ–
“একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর গো।
মন রে,
কেন বাঁধো দালানঘর।”
কিন্তু এতদসত্বেও, যাত্রাপথের লুৎফ নিতে তো বাধা থাকতে পারে না কোনো! বরং সেইটাই তো দস্তুর। নয়ত বাউল ব্যাটাই বা এমন তুরীয় হয়ে গান জুড়েছে কোন আনন্দে? কেমনে?
কিংবা সেই যে সেই এক বিশ্ব-বাউল বলে গেছে একদা সকলই বৃথা জেনেও
আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল?
তা হলে?
শাহিবান আউর ঠোঁট টিপে হাসা কদরদান?
নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো। তাহা হইলে?
ধ্যাৎ শালা!
আবারো ডি ট্যুর। আবারো দার্শনিক প্রলাপ। এবার মানে মানে ফেরত আসা যাক সূর্যে ফিরসে।
তো সূর্য। তো… এই সূর্যর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সেই কৃতজ্ঞতার কথা বলতেই এইসব আন সান লেখা মধ্য রাতে কি-প্যাড ট্যাপটেপিয়ে।
বান্ধবীটির মতোই, সূর্যও প্রথম দিন চোখ উল্টে ছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে, রোলিং ওভার দা আইজ। ছিক করে একটা আপাত তাচ্ছিল্যর সাথে নিজের কাছেই নিজে অস্বীকার করেছিল সত্যটা। –“ধ্যাৎ স্যার। প্রেম করার সময় নেই।”
আমি কিছু বলি নি আর। বলাটা… শোভনীয় নয়ও। আমার মতো ঠোঁটকাটার পক্ষেও। এবং সূর্য, ঠিক দু মাসের মাথায় বলেছিল–“আজ পেশেন্ট দেখা শেষ হলে আমায় মিনিট দশ দিতে হবে স্যার। কাউন্সিলিং করতে হবে। আমার।”
তো, পেশেন্ট দেখা শেষ করার পর সূর্য এসেছিল খসখসিয়ে। রাত তখন নয়টা হবে প্রায়। খিদে পাচ্ছে। মন বলছে– শীতের এই বিচ্ছিরি রাতে আরো দেরি হয়ে গেল শালা। আরো দেরি হবে স্নান করতে।
এবং সূর্য বললো। বলেই ফেললো শেষমেশ। আমি নেশায় পড়ে গেছি স্যার। বহুত নেশা। আমি বুঝতে পারছি আমায় ইউজ করছে…। আমি কারো সাথে সামান্য কথা বললেই ঝামেলা করে… এদিকে… এদিকে ওর নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরে বেড়ায় ডাঁটসে! জানেন… জানেন স্যার… ও ওর বয়ফ্রেন্ডের জন্য জামা চয়েজ করতে আমাকেই নিয়ে যায়? আর আমাকে…আমার কাছেই কান্নাকাটি করে, আমাকে… বলে যে… বয়ফ্রেন্ড ওকে টাইম দিছে না! বেরিয়ে আসতে চাই স্যার। পারছি না। কিছু ফিল করতে পারছি না। হাসি না, দুঃখ না… কিচ্ছু না। অথচ বেরোনো দরকার। জানি। পারছি না।
করোনা তখন সদ্য তৃতীয় পিক নেব নেব করছে। সরকার মানুক বা না মানুক… একটু হলেও পরিস্থিতি বিপদ সঙ্কেত দিচ্ছে। দুমদাম ফুটে যাচ্ছে লোকজন। সূর্য… নিজেও হেল্থ কেয়ারে যুক্ত। সূর্যর পিসেমশাই, বছর পঞ্চান্ন, মারা গেছেন দিন সাতেক আগেই। কোভিডে। সূর্যর পিসতুতো ভাই… বয়স সাতাশ… মরে যাবে দৈব কৃপা না ঘটলে। ওই… কোভিডেই। রোগী দুটিই আমার চিকিৎসাধীন ছিল। সত্যটা আমিও যেমন জানি, সূর্যও ঠিক তেমনই জানে। আঙিনা দিয়ে ঘুঙুর নাচিয়ে ঝড় তুলে রেখেছেন মৃত্যু ঠাকরুন। এবং তবুও… তবুও… তবুও… এই অসম্ভবের দিনেও… প্রেম বাঁচে। প্রেম…আছে। বড্ডো, আর বড় বেশি রকমের কাছে।
মৃত্যুর চেয়েও বড় হয়ে। আজারবাইজনের ক্যায়েজ হয়ে। বৌবাজারের দেবদাস মুখোপাধ্যায় হয়ে। “কাম জোসেফিন… অন মাই ফ্লাইং মেশিন”-এর জ্যাক হয়ে।
মৃত্যু, সত্য, নীতি, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি মূল্য, দেশনায়কের জন্মদিন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পেশী আস্ফালন…. সমস্ত কিছুই স্তিমিত হয়ে যায় যে অনুভূতির কাছে। দুনিয়া শালা গোল্লায় যাক। হয় আমি মরে যাই নয়ত প্রেয়সী সমেত তার স্বামী মরে যাক। আমার কিছুতেই কিছু এসে যায় না। আমি শুধু জানি– আমার কষ্ট কমছে না। কমবখত … এই কষ্ট কমছে না। কমছেই যে না। বেড়েই যাচ্ছে আর গিলেই যাচ্ছে লকলকিয়ে।
এটাই সূর্য। কম অবসাদগ্রস্ত রোগী তো আর দেখিনি এই বছর ষোলোর ডাক্তারি জীবনে!
আমি হাই ব্যাক চেয়ারে ক্যাঁচ শব্দ করে হেলান দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়েছিলাম সূর্যকে তাই সরাসরি,– সবসময় মনে হয় ওরা, আই মিন…তোমার ঐ বান্ধবী আর তার বয়ফ্রেন্ড চুমু খাচ্ছে। আদর করছে। তাই না? কণ্ঠলগ্না, জড়াজড়ি? সবসময়? আর মনে হয় তাই যে… খুব আঘাত দিয়ে কলার টিউন সেট করি একটা? যাতে ফোন করলেই বান্ধবী শুনতে পায় তুমি কতটা কষ্টে আছো? তাই না? সূর্য? হ্যাঁ? … এবং ইউ আর রং। শি গিভস আ শিট। তার কিছু এসে যায় না। বরং তোমায় ফোন করে তোমার সাথে কথা বলতে বলতে তোমার কলার টিউনটাই গুনগুনায় আনমনে। ….রাইট? সূর্য? এবং তোমার খেয়ালও রাখে। তুমি টাইম মতো না খেলে বকে? এবং সেই একই মেয়ে ভুলেও যায় তুমি বেঁচে আছ না মরে গেছ, যখন ও বয়ফ্রেন্ডের সাথে থাকে? তাই না?
সূর্য চমকে উঠে বলেছিল–” আ আপনি কী করে…।”
সমস্ত রোগীকে, সর্বপ্রকার মনোকষ্টের মলম লাগাতে লাগাতে যা যা মিথ্যে বলি, সূর্যকেও বলেছিলাম ঠিক তাই তাইই। এতে, চিকিৎসক থেকে বন্ধু হয়ে উঠতে পারি আমি পেসেন্টের দ্রুত। আর এই সূর্যও তো পেশেন্টই। মারত্মক ভালনারেবল পেশেন্ট। ওর চোখে মুখে আশ্চর্য… মৃতবত স্থিরতা। বলেছিলাম তাই চোখ দিয়ে হেসে–“আরে ভাই, আমি নিজেও ভুক্তভোগী। এককাজ করো। আজ… আজকেই সব ফটো ডিলিট করো। নাম্বার। ব্লক করো। সমস্ত স্টেটাস মুছে দাও। কলার টিউন হোসানা থেকে পাতি আর সিম্পল ক্রিং ক্রিং করে দাও। এবং ট্রাস্ট মি, আজ থেকে ঠিক এক বছর পরে তুমি নিজেই হাসবে আজকের কথা ভেবে। টাইম… ইটস আ গ্রেট হিলার সূর্য। তুমি… তুমি ফেসবুক একাউন্ট কবে খুলেছিলে ? সূর্য? তিন? পাঁচ? সাত দশ বছর আগে? একবার ফিরে গিয়ে নিজের প্রোফাইলটা দেখো তো সময় করে। দেখো নিজের সম্পর্কে ডেস্ক্রাইব করার অংশটাতে তুমি কী কী লিখে রেখেছিলে। দেখো… কেমন হাসি পাবে আর নিজেকেই বাচ্চা বাচ্চা লাগবে ওগুলো দেখে। টাইম সূর্য… টাইম। ট্রিক ইজ… ইউ হ্যাভ টু গিভ ইওরসেল্ফ দ্যাট মাচ টাইম। হোল্ড অন… আ লিটল লঙ্গার।
এইসব বক্কা দিয়েছিলাম আর কি! আর তারই সাথে বলেছিলাম একটা কথা। যেটা কখনো কাউকে বলিনি আগে। বলেছিলাম– ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাও সূর্য। আমার ফেসবুক ওয়ালে এসো। যখনই ইচ্ছে হবে ব্যথাওয়ালা দাঁতের মাড়িতে ব্যথা হবে জেনেও আঙুল দিয়ে চাপতে… তখন আমার ওয়ালের লেখাগুলো পড়বে। আমি রোজ জিগ্যেস করব। কদ্দূর পড়লে। ওকে? কিল ইউর স্পেয়ার টাইম। অবসর সময়টা নষ্ট করো আমার লেখা পড়ে। ওকে? গট ইট? সূর্য?
সূর্য হ্যাঁ বলেছিল। সূর্য সে রাতেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। এবং আমি হঠাৎ উপলব্ধি করেছিলাম যে, দীর্ঘদিন কিছু লেখা হয় না ।
তাই লিখি বরং আজ। সূর্যর জন্যই। স্রেফ।
এবং এবং এবং আমি এটাও উপলব্ধি করেছিলাম ওই তখনই যে, আমার মধ্যে কিছু একটা আশ্চর্য বিষয় আছে। মানুষ বারেবার আমার কাছে এসে ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। আজ ব’লে নয়। সেই যবে থেকে ফেসবুকে এসেছি, তখন থেকেই। মেসেঞ্জার আমার ভর্তি বিপজ্জনক সমস্ত কনফেশনে আর কষ্টে। কিন্তু সেসব তো ভুলতে বসেছিলাম আমি। আমার…আমার এক বৎসর জুড়ে চলা অবসাদ, যেটাতে তলিয়ে যাচ্ছিলাম আমি আকণ্ঠ… সেইটা এবার, অবশেষে ঝেড়ে ফেলার কারণ খুঁজে পেলাম আচমকা চটকা ভেঙে।
আরো বহুদিন থাকতে হবে আমায়। আরো বহু মানুষকে কষ্ট থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিকতাতে। আত্মতৃপ্তি? তাই হলো নাহয়। কৌন কমবখত হ্যায়, যে ব্যাটা আত্মতৃপ্তিতে ভোগে না?
তাই এসো সূর্য। তোমায় গল্প বলি বরং। গল্প লিখি। নতুন।
এ গল্পে পারম্পৰ্য্য থাকবে না কিন্তু ভাই! পথ বদলাবে, গলি বদলাবে গল্পের গতিপথ। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে আশ্চর্য কিছু মুহূর্ত হঠাৎ হঠাৎ করে।
এসো। সূর্য। এসো। গল্প বলি তোমায়।
আজ।
এই রাতে।
শোনো।
তুমি তো জানো মাঝে একটা অন্য হাসপাতালে কাজ করেছিলাম আমি। বেসরকারি। কেন করেছিলাম, এখন কী করি, কোথায় চাকরি করি, কোথায় রোগী দেখি, আর কোথায় কী ভাবে রোগী দেখতাম তখন… এসব প্রশ্ন অবান্তর। তুমি… স্রেফ শোনো। এবং তুমি তো জানোও সবটা। বোধহয়। সে যাক…
শোনো সূর্য, হাসপাতালটা, অর্থাৎ ওই মাঝের অন্য হাসপাতালটা ছিল একটু অন্য রকম। একটু… পেশাদারি। ফলত, পরিষ্কার পরিছন্ন ছিল খুব। ছিল আরোগ্য নিকেতনের মাফিক টিপটপ আর আরোগ্য নিকেতনের সাযুজ্য মতোই –থমথমে। গুরুগম্ভীর।
এবং ফলত… রোগী আর আমার মধ্যে দূরত্বও ছিল যোজন যোজন মাইল।
সিস্টার ছিলেন একজন। সর্বদা। যিনি একাধারে সিস্টার এবং এটেন্ডেন্ট। রোগী যদি চেয়ার থেকে উঠে পুরোনো ব্লাড রিপোর্ট দেখাতে চাইতো আমাকে, সিস্টার ধড়ফড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে স্বহস্তে নিয়ে নিতেন সেই দস্তাবেজ। আর বলতেন–“ব্যায়ঠে রহিয়ে। সিট। বউসুন। আমি স্যারকে দিতেছি। আর মাস্কটা নাকে পুল কর লিন।” ( সিস্টাররা সবাই কেরালিয়ান। বাংলাটা ঠিক আসে না…)
তাই…দূরত্ব থাকতো সূর্য। এমন একটা দূরত্ব, যেটা আমার অসহ্য লাগতো বড্ডো। আমার রোগীকে আমি ডাকবো মা, ডাকবো বুনু, ভাই, কাকা… কিংবা সিম্পল– কী হে? আর এই আমিই বলবো চোখ রাঙিয়ে, এই যে নাকটা ঢাইক্যা নাও, নয়ত এমন তাফাল দিব তোমায়, দেইখো…।
রোগী আর আমার মাঝে কেউ থাকবে না সূর্য। কেউ না। নো মিডিয়েটর। নো পুরোহিত ব্রাহ্মণ। কোনো মধ্যস্থতাকারী না। কিন্তু এটা তো, এই হাসপাতালটা ছিল বেসরকারি। তাই … এরমটাই দস্তুর।
এবং আমার দম যখন বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়, এবং যখন আমি আর শুনতে পারছি না–” আজ ভর্তি হতে পারব না। পাইসা নাই। কাইল জমিন বিক্রি কৈরে …দেখি…।”
এবং যখন চাইছি যে নোংরা হোক, হট্টমেলা হোক… আমি আবার সরকারি পরিষেবাতেই ফেরত যেতে চাই, তখন… ঠিক তখন দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল একজন।একটি রোগী।
তার গল্প বলি এসো তোমায় আজ সূর্য। তুমি… রিলেট করতে পারবে হয়তো। অনেকটাই।
সেদিন ছিল শুক্রবার। ওই হাসপাতালটির নিয়ম মাফিক, সেইদিন হলো এম আর (মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভ)-দের মিট করার দিন। ওই বিশেষ বার’টিতে রোগীর টিকিট এন্ট্রি করা হয় কম। বরং এম আর মিট করা হয় বেশি।
বিষয়টা মন্দ নয় সূর্য। সব্বাই যেরকম এম আর এবং চিকিৎসকদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে শুধুই অশুভ আঁতাত ভাবে, তারা ভুল ভাবে। জানো? এরকমটা নয় মোটেই। এম আর মিট না করলে জানা যায় না কাঙ্খিত ওষুধটি সবচাইতে কম দামে এবং কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ না করে পাওয়া যাবে কোন কোম্পানির কাছ থেকে। সেইটা … সেই টাও জানা খুব জরুরি, তাই না সূর্য? সুতরাং, সেটা বিষয় নয়। সেটা… বিষয়ই নয়। আপত্তিকর বিষয় বরং এইটা হতে পারে যে এম আর মিট করার জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে পেশেন্ট এন্ট্রি কমিয়ে দেওয়া। কিন্তু তাইতে আমি কী বা আর করতে পারতাম সূর্য? আমি তখন বাধ্য হয়েই স্রেফ ক্ষুন্নিবৃত্তির নিমিত্ত চাকরি নিয়েছিলাম ওখানে। তখন… আমার আর অন্য কোনো উপায় ছিল না বিশ্বাস করো। চেনো তো তুমি আমায়। চেনো না? সূর্য?
তো ওই। শুক্রবার সেইদিন। এম আর মিট হচ্ছে চুটিয়ে। আমি যেহেতু সরকারি হাসপাতালে ছিলাম প্রায় বছর চোদ্দ এই শহরেই, এম আর বেশিরভাগই আমার মুখ চেনা। গল্প হচ্ছিল টুকটাক এবং কখনো জমিয়ে। ” স্যার আপনি এখানে?”, ” স্যার চাকরি ছেড়ে দিলেন?” , ” স্যার, আপনাকে দেখে চমকে গেছি আমি এখানে…” এইসব।
আর এইসবের মাঝেই রুদ্ধদ্বারটিকে একটু খানি ফাঁক করে পরিশীলিত ভঙ্গিতে সিস্টার বললেন–“এক পেশেন্ট হ্যায়। দেখেঙ্গে?”
তখন বাজে দুপুর সাড়ে তিনটে। এ সময়, শুক্রবারে, ডাঁট-সে এটাই বলা দস্তুর ওই হাসপাতালে যে, –” কাল আনে কো বোলিয়ে। “
কিন্তু আমি তো ছাগল। আমি, জানো তো সূর্য এডিক্টেড হয়ে যাচ্ছি রোগীর এবং রোগের প্রতি ক্রমশ। রোগী না দেখলে ছটফট লাগে কিরকম একটা। মনে হয়, অর্থহীন জীবনের একটি মাত্র অর্থবহ কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে কেউ আমায়। হুড়মুড়িয়ে তাই বলেছিলম চাতকের মতো–“ভেজ দিজিয়ে প্লিজ। অভ ভি। রাইট নাও।” আর সামনে দন্ডায়মান এম আর দাদাকে বলেছিলম উচ্ছসিত স্বরে–” আপনি প্লিজ একটু ওয়েট করুন। পেশেন্ট দেখে নি।”
এবং এসেছিল দরজা ঠেলে আমার সেই রোগী। যে রোগীর গল্প আজ তোমায় বলতে বসেছি সূর্য। আমার ষোল বছরের ডাক্তারি জীবনের সবচাইতে আশ্চর্য রোগী।
দোহারা চেহারা। ফর্সা। ভীষণ ফর্সা। চোখে মুখে তেলতেলে ভাব প্রকট। প্রকট সেই তেলতেলে ভাব লোকটির ব্যবহারেও। যদিও পরে সেসব পাল্টে গিছল। কিন্তু সে তো পরের কথা। আগের কথা আগে। গল্প তো শুরু থেকেই বলতে হয়। তাই না? সবাই কি আর ‘অজয় কর’?। সবই কি আর উত্তম সুচিত্রার সপ্তপদী?
রোগীর কমপ্লেইন খুব সাধারণ। পেচ্ছাপ করতে গেলে জ্বালা করে। বারে বারে পেচ্ছাপ পায়। এসব হচ্ছে গত চারদিন ধরে। আপাত চোখে, ইটস আ সিম্পল কেস অফ ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন। পেচ্ছাপ পরীক্ষা করাও। পেচ্ছাপের স্যাম্পেল দেওয়ার পর এন্টিবায়োটিক শুরু করতে বলো। পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে আবার দেখাতে বলো দিন তিনেক পরে। আর জল খেতে বলো, বেশি। আর সম্ভব হলে ক্রানবেরি জ্যুস। এই তো! সিম্পল। তাই না? সূর্য? তুমি তো ভাই মেডিক্যাল লাইনের ছেলেই। তুমিও তো জানবেই এসব কথা অল্পবিস্তর।
কিন্তু খটকা’টা অন্যত্র। ডাক্তারি পাশ করলেই ডাক্তার হওয়া যায় না সূর্য। ভারতবর্ষের মতো একটা দেশে, যেখানে হাজারো বিধিনিষেধ আর লাজ লজ্জা, সেখানে ডাক্তার হয়ে উঠতে হলে সবার আগে রোগী যেটা বলতে পারছে না সঙ্কোচের কারণে, সেইটা ধরতে পারাটা জরুরি। দরকার।
এবং সেইটা আমি পেরেছিলাম। সেইটা… আমি পারি।
প্রেসক্রিপশন প্যাডে খসখসিয়ে ওষুধ লিখেও তাই নাম-সই করিনি নীচে তখনো। বরং মুখ তুলে বলেছিলাম চোখ চেয়ে সরাসরি–” আর? আর কিছু বলবেন?”
জানতাম বলবে। বলবে লোকটা। এটা… এইটা মোটেও ওর ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার মূল কারণ নয়। হতে পরেই না। হয়ওনি।
অনুমান মাফিক চেয়ারটা একটু সামনের দিকে টেনে এনে এবং সিস্টারের “নজদিক মৎ যাইয়ে” শাসন শুনে, একটা ছোট্ট ঢোঁক গিলে বলেছিল লোকটা— ” এই… মানে… এই আর কি! মানে… ডক্টর সাব… আমার ইয়ে হয়। ওই ইয়ে। মানে সিমেন বের হয়ে যায়। মেয়ে দেখলেই। বের হয়ে যায় সিমেন।”
এটা যথেষ্ট। এই তথ্যটা। ঘাড় নেড়ে ইশারা করেছিলাম সিস্টেরকে–” থোড়া বাহার যাইয়ে। গিভ আস সাম প্রাইভেসি।”
এবং সিস্টার বেরিয়ে যাওয়ার পরমুহূর্তেই বলেছিলাম শান্ত ভঙ্গীতে–” বলুন। এবার। “
লোকটা, তেলতেলে মুখটাকে আরো তেলতেলে করে বলেছিল–” থ্যাংক ইউ স্যার। আমারই প্রব্লেম হচ্ছিল। এই যে… যিনি ছিলেন… এঁকে দেখেও আমার… বীর্য…।”
রাগ করবো নাকি খিস্তি দেব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়লো, আমি ডাক্তার। আমি… পেশায় চিকিৎসক। রোগী পারভার্ট হলে তাকে পারভার্সন বলে দেগে দেওয়া আমার কাজ নয়। বরং এটিকে মানসিক ব্যাধি ভেবে নিয়ে চিকিৎসা করাটা বেশি জরুরি। বিশেষত, রোগী যখন অকপটে নিজের রোগ স্বীকার করছে। অর্থাৎ, হিতাহিত বোধ আছে। অর্থাৎ… ঠিক ভুলের জ্ঞানটুকু এখনো বেঁচে আছে লোকটার।
টেবিলে কনুইয়ের ভর দিয়ে তাই জিগ্যেস করেছিলাম–“কতদিন ধরে? এই যে এই মেয়ে দেখলেই… সিমেন বেরিয়ে যাচ্ছে?”
আর ঠিক তখনই সবটা পাল্টে গেল আচমকা। তেলতেলে ভাব উধাও মুহূর্তে। বরং বড় কষ্টে , আর বড় যাতনায় কুঁকড়ে গিয়ে লোকটা বলে উঠলো– ” এরকম… এরকম না স্যার। আমি এরকম না। প্রেম করি তো স্যার। প্রেম … করি। কিন্তু বাড়িতে মানলো না। আমি স্যার মায়ের কথা… মায়ের সাথে পেরে উঠি না। তাছাড়া ততদিনে ওর-ও বিয়ে হয়ে গেছে। আমি বিয়ে করতাম না তবুও স্যার। বিশ্বাস করুন। কিন্তু … মা। বিয়ে দিয়ে দিলো। বউকে ছুঁতে পারিনি স্যার। পারিইনি। পারা যায়? স্যার? বলুন তো? আমি তো ভালোবাসি। একজনকে। “
লোকটা থামলো।
আমিও চুপ। ফ্যান ঘুরছে শুধু ঘ্যাচ ঘ্যাচ। এবং তারপর আমিই শুরু করলাম বাধ্য হয়ে—” বিয়ে হয়ে গিছল? আপনার প্রেমিকার? বাচ্চা? সেটাও তো হয়ে গিছল? নাকি না? “
–” হ্যাঁ স্যার। একটা মেয়ে। কি যে সুন্দর। ও… তনুশ্রী… আমার ওই ওর নাম স্যার … তনুশ্রী… কী যে খুশি। আমি আংটি দিয়েছিলাম অন্নপ্রাশনে স্যার। রূপোর। কত ধুমধাম। কত লোকজন! কিন্তু আমি…আমি কী করে পারি স্যার? কী করে? বউ ছেড়ে চলে গেল। আমি ছুঁই না বউকে। বললো সব্বাইকে যে আমি… ধ্বজভঙ্গ। আমি… দাঁড়ায় না আমার স্যার। এখন.. কী করে দাঁড়াবে স্যার? উচিত কি? দাঁড়ানো? আমি তো ভালোবাসি? তাই না?”
ডাক্তার হিসাবে ঠিক এই মুহূর্তটা আমার লুফে নেওয়া উচিত। নিলামও। কনুইয়ে ভর থেকে ফিরসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম সপাটে–
” পলাশবাবু… পলাশ দাশগুপ্ত… তাই তো? আপনার নাম? পলাশ বাবু… আপনার প্রেমিকার বাচ্চাও হয়ে গেল। এমনি এমনি যে হয় না বাচ্চা সে তো আপনি বোঝেনই আশা করি। আর তাছাড়া… তাছাড়া… আপনিই তো বললেন– সে খুশি। ধুমধাম…সেও আপনি নিজেই বলছেন। আর তারপরেও বলছেন আপনি ওকে ভালোবাসতেন বলে আপনার নিজের বউয়ের সামনে দাঁড়ালো না? হ্যাঁ?”
লোকটা, যার নাম পলাশ… সূর্য তুমি এতক্ষণে জেনে গেছ লোকটার নাম… তো সেই পলাশ বলে উঠলো ছটফটিয়ে–” না না.. নাঃ। নাহঃ। বাসি স্যার। বাসি। বসতাম না। বাসি এখনো। ভালোবাসি। আর তাছাড়া… আপনি বুঝবেন না। মেয়েদের স্যার… মেয়েদের অনেক ঝামেলা থাকে। আমাদের ব্যাটাছেলের মতো ওরা পারে না। ওদের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়। বরের দাবি থাকে। শ্বশুর শাশুড়ির। বিয়ে করলে যখন, বাচ্চা নেবে না কেন? ওদের হাসতে হয় স্যার। ওদের… তনুশ্রীকে হাসতে হয়েছে। কিন্তু ও ভালোবাসে স্যার আমায়। এখনো। অন্নপ্রাশনের দিন নিজে থেকে আমায় চারাপোনা দিয়েছে দুটো। আমি… খেতে ভালোবাসি। জানে ও। খেয়াল রেখেছিল… বাচ্চা সামলেও। বলেছিল, এনাকে আরেকটা চারাপোনা দাও। নীল শাড়ি। সোনালী পাড়। লাল ব্লাউজ। আমার … মনে আছে এখনো। না না স্যার… ওরম না। আপনি হয়ত ভুল বুঝছেন। ওর বরেরটাও মনে আছে। ঘিয়া পাঞ্জাবি পায়জামা। কালো জ্যাকেট তার ওপরে। শুধু তনুশ্রীরই মনে রাখি না স্যার… হ্যাঁ! “
ততক্ষণে আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেছি ক্ষণিকের জন্য সূর্য। মনে পড়ে গেছে সেকেন্ড ওয়েভ এলো যখন করোনার, সেই ফেলে আসা দুঃ/ সু সময়ের কথা। হাঁটতে বেরতোম তখন সূর্য। ইভিনিং ওয়াক যাকে বলে আর কি! তো ততদিনে করোনা জমিয়ে থাবা গাড়লেও, করোনার ভয়টা ফার্স্ট ওয়েভের তুলনায় কমে গেছে অনেকটাই জনমানসে। সরকারও অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন বিয়ে বা অন্নপ্রাশন বা শ্রাদ্ধে সীমিত সংখ্যক নিমন্ত্রিত করার।
এরকমই এক সন্ধ্যায় সূর্য। হাঁটছি আমি হনহনিয়ে পথে। একটু আগেই ফোন করেছে সঞ্জিতদা। আমার সুহৃদ। বলেছে– হাঁফাচ্ছ কেন? বলেছি উত্তরে আমি– হাঁটছি সঞ্জিতদা। তাই। স্বাস্থ্য উদ্ধার আর কি! হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা।
এবং ফোনটা জাস্ট রেখেছি। আর ভাগ্যিস রেখেছি। যে রাস্তা ধরে আমি হাঁটছি তখন, তাকে সমকৌণিকে কেটেছে যে গলিপথ, সেই গলিপথ থেকে ত্রস্ত পদে বেরিয়ে এলো এক যুবতী। নাকি … নারী? সমস্ত অঙ্গ জুড়ে তখন তার বধূর সাজ। কাঁচুলি, বেনারসি,টিকলি, ঝাপটা… নড়তে চড়তে নিক্কন আর শিঞ্জিনি। এবং তার ডান গালে ঠেসে রাখা একটা মোবাইল।
— হ্যালোহ
এরকম হ্যালো আমি জীবনে কখনো শুনিনি সূর্য। এরকম চাতক কন্ঠস্বর। এইরকম একটা হ্যালো দিয়েও যে এরকম পাগলাটে আকুতি বেরোতে পারে…
হ্যালোহ… তুই কোথায়? তুই? এবং এটুকু বলার পরেই সেই নারী ফোনটা রেখে দিল হাতের মুঠোতে গুটিয়ে। এবং তখনই নজরে এলো স্ট্রিট লাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা একটা হেঠমুন্ডু, বকওয়াস এবং ফালতু ছেলের দিকে। নারী এগিয়ে যাচ্ছেন তারই দিকে।
— তুই … তুই এলি?
— হ্যাঁহ! তোকে দেখবো না? কেমন লাগছে?
— হ্যাঁ। হ্যাঁ । হয়েছে। চল। খাবি চল। আর মাস্ক পরেছিস কেন ছাগল? নামা? দেখি। দাড়ি রেখেছিস? এই শোন… একদম না …দেবদাস হয়ে থাকবি না। নামা। মাস্ক নামা।
— না না এইই। এইই… কোভিড হয়ে যাবে তোর।
— হোয়াট? তোর… তোর কোভিড? আর আমিই জানি না শালা…। আমি তোর খোঁজখবর আর রাখতে পারি না…
— আরে নাহঃ। কোভিড মোভিড না। কিছুই হয়নি আমার। কিন্তু যদি হয়ে থাকে? তোরও যদি হয়?
— হবে হলে। খোল।
— কিন্তু তারপর তো তোর বরেরও হবে ! তাই না?
— হুঁ। খুব হয়েছে। খাবি চল।
হাত ধরে চরম উন্নাসিকতা আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর বধূ নিয়ে চলে গেল অকিঞ্চিৎকর সেই যুবককে অতঃপর গলিতে। যুবকও মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেঁটে গেল বিনা বাক্যব্যয়ে পিছু পিছু। আর আমি…যে আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে ইচ্ছে করে নিভিয়ে দিচ্ছিলাম একটার পর একটা দেশলাই কাঠি… যাতে সাক্ষী থাকতে পারি এই নতমস্তক পরাজয়ের… সিগারেটটা পকেটে গুঁজে আর মাস্ক ফিরসে নাকে টেনে রওনা দিয়েছিলাম বাড়ির পথে।
চারাপোনা… হাত ধরে নিয়ে যাওয়া বিবাহ ভোজে… আর আশ্চর্য একটা কর্তৃত্ব… একথা যদিও কর্তার সাথেই আপাত অর্থে ব্যবহৃত হয়… এই যে এই কর্তৃত্ব শব্দটা… সেটা সত্যিকারের বাস্তব হতে দেখেছিলাম সেদিন সেই সন্ধ্যায়। আর আজ এই… চারাপোনা ভোজের চেম্বারে।
এসব কথা লিখতে যতখানি লাগলো সূর্য, বিশ্বাস করো, তার অর্বুদ ভাগও লাগেনি ভাবতে।
সবচাইতে দ্রুতগামী কে?
মন।
তাই না?
কিন্তু লিখে প্রকাশ করতে শব্দ আর সময় ব্যয় হলো অনেকখানি। আর তাই বলে তুমি বোর হয়ে যেও না যেন সূর্য। বলেই তো ছিলাম আগে ভাগেই… কাহিনী কন্দরে প্রবেশ করবে আচমকাই রাজপথ ছেড়ে। তাই না? সূর্য? ভাইটি?
সে যাক। পলাশে ফেরত আসা যাক আবার। ফোকাস। মন দাও। পলাশ কথা বলছে। আবার। এক্ষণে। — তারপর স্যার…তারপর সবটা গণ্ডগোল হয়ে গেল। বউ চলে গেল। আমার …আমি মুদি দোকানে চাকরি করতাম স্যার… আমি তো মাথা-পাগল… চাকরিটাও গেল। ভালো করে খেতে পাই না স্যার আর। দুবেলাই রুটি। ভাত খেতে ধরুন মিনিমাম একটা ডাল তরকারি লাগে। রুটি…তা আপনার ধরুন স্যার… সে মরিচ পেঁয়াজ দিয়েও খাওয়া যায়। তা-ই খাই। কি আসে যায় আর! খেলেই তো হলো। বাঁচলেই…। নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি তো স্যার। মা বের করে দিল। সত্তর হাজার টাকা নিয়েছিল যৌতুকে। আর ডিভোর্সের কম্পেনসেশন দিতে হলো এক লাখ বিশ। মা, বের করে দিল আমায়। একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম এই ভক্তিনগরের কাছে। সেখান থেকেও বের করে দিল। ভাড়া বাকি। এখন… এই তিন চার মাস ধরে… এই কাছেই…মোহিতনগরে… একটা রুমে থাকি। ওই তখন থেকেই আমার প্রথম রোগ শুরু হলো স্যার। এই যে… সিমেন বেরিয়ে যায়। মেয়ে দেখলেই। কিন্তু… কিন্তু স্যার…. এটা তো ঠিক না তাই না? আমি তো নিজের বউয়ের সাথেও পারিনি স্যার! পারিনি তো? পারিনি। কেন পারিনি? স্যার…? কেন পারিনি? কাউকে ভালোবাসলে কি আর অন্য কাউকে ছোঁয়া যায়? সেইটাই তো নরমাল, তাই না স্যার? নিজের বউয়ের সাথেই পারিনি আমি। আর সেখানে আমি এখন যে মেয়েকেই দেখি… আমার … আমার সিমেন বের হয়ে যায় স্যার। আমি বিট্রে করছি স্যার। আমি তনুশ্রীকে ঠকাচ্ছি। আমার তো ও ছাড়া অন্য কারো প্রতি…। আমাকে বাঁচান স্যার। আমি তনুশ্রীকে নিয়েই থাকতে চাই।… কম বয়সের তনুশ্রী। আমি আর নিজের দিকে তাকাতে পারি না। আপনি স্যার লাস্ট চান্স আমার। লাস্ট…।
তনুশ্রী নামক নারীর বিষয়টা যে পলাশের মানসিক স্থিতিকে সম্পূর্ণরকম ঘেঁটে দিয়েছিল অনেকদিন আগেই, আর তারই ফলাফল ধীরে ধীরে এই এখনের অবস্থা, এটা বুঝতে পারছিলাম সুস্পষ্ট। এবং এটাও বুঝতে পারছিলাম যে, এ রোগীটির অবিলম্বে মানসিক বিশেষজ্ঞকে দেখানো প্রয়োজন। কিন্তু সূর্য… সেদিন এবং আগামী চারদিন ওই হাসপাতালে সাইকিয়াট্রিস্ট বসবেন না। হয় আমাকে ততদিন অপেক্ষা করতে হয়, নয় ওষুধ দিয়ে ফলো আপ করাতে বলতে হয় দিন চারেক পরে।
এরমধ্যে…দ্বিতীয়টা করতেই আমি বাধ্য। ওই হাসপাতালে। ওখানে শ দুয়েক টাকা দিয়ে আউটডোর টিকিট কাটে রোগী। তাকে এক্কেবারে চিকিৎসা না করে রেফার করা যায় না অন্যত্র। আর তাই দিয়েছিলাম আমি। ওষুধ। যতটুকু মানসিক রোগের ওষুধ আমার জ্ঞানে ছিল। আর তার চাইতেও বক্কা টক্কা মেরে মগজ ধোলাই করেছিলাম ঠিক তোমার মতোই। ঠিক… তোমার মতোই বলেছিলাম– আরে এ জিনিস আমার সাথেও হয়েছে। আর মন দিয়ে, যত্ন করে শুনেছিলাম ওর… অর্থাৎ পলাশের সমস্ত কথা।
পলাশ চলে গিছল প্রেসক্রিপশন নিয়ে। চারদিন পরে ফেরত এলো না আর যদিও। এমনকি, পাঁচ আর ছয়দিনেও না। এবং সপ্তম দিনে যখন আমি ধরেই নিয়েছি, এ ব্যাটা হয় অন্য কোথাও দেখাচ্ছে, নয় ঝুলে পড়েছে সিলিং থেকে সব শান্ত করে, তখনই, আচমকা আরেক এম আর মিট এর সময় মুন্ডু গলালো পলাশ। দরজা ফাঁক করে, – ওহঃ আপনি ব্যস্ত স্যার! কথা বলে নিন। আমি আছি। বাইরে…।
এই এম আর দাদাকেও তৎক্ষণাৎ অপেক্ষা করতে বলে আমি ডেকে নিয়েছিলাম পলাশকে তক্ষুনি। নাঃ। না সূর্য। না। রোগী দেখার মহানুভবতার নিমিত্ত নয়। বরং… আমার নিজেরই বড় উদগ্র লাগছিল পলাশের হাল হকিকত জানতে।
“আজ দেখাবো না”, পলাশ হাসলো। তেলতেলে হাসি না। অনেকটা… অনেকটা ত্যাগীর মতো, সুফির মতো হাসি। বললো,”আজ টিকিট এন্ট্রি করিনি তাই। আজ শুধু এইটা দিতে এলাম। এই যে…।”
হাত বাড়িয়ে, ডান হাত সিধা আর বাম হাতের করতল ছুঁয়ে আছে ডান হাতের কনুইকে আলতো… যেন অর্ঘ্য দিচ্ছে ঈশ্বরের কাছে… যেন আরতি করছে পঞ্চপ্রদীপে… ঠিক সেইভাবে পলাশ এগিয়ে দিল এক গোছা কাগজ।
এ-ফোর সাইজ। বামদিকের উপরের কোনায় ছোট্ট কাগজের টুকরো চিপকে তার উপর দিয়ে স্টেপল করা সযত্নে। যাতে, মূল এ ফোর পাতাগুলো আহত না হয় আচমকা পিনের আঘাতে। এবং প্রতিটি পাতাতে যার, বাক্য সংস্থান দেখেই বোঝা যায় প্রিন্ট করা আছে– কবিতা।
“কবিতা লিখি স্যার। ওই… আর কি। পড়বেন। আমি এখন ভালো আছি স্যার। আর হয় না। ওরম। আমি তনুশ্রীরই আবার। কম বয়সের তনুশ্রীর। থ্যাংক ইউ স্যার। আপনি… আমায় বাঁচিয়ে দিলেন। আমি পরের হপ্তায় আসবো। আজ টাকা নেই দেখানোর… পরের বার হয়ে যাব। আসি।”
কোনো দ্বিতীয় কথা বলার আগেই পলাশ উধাও হয়ে গিছল সেদিন। আর মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিটিভ দাদা এসেছিলেন ফিরসে দরজা ঠেলে–” আসি? স্যার? ফ্রি ? আপনি?”
ফিরতি যে ডাক দেব পলাশকে, সে উপায় ছিল না। জানো? সূর্য? পয়সা না থাকলে এখানে চ্যারিটি করার অধিকার নেই আমার। এই… এই হাসপাতালে।
আর তাই এম আর দাদার কথা আমার কানে ঢুকছিল সেসময় ভাসা ভাসা হয়ে। আর তাই ভাসছিল আমার চোখে একটা আশ্চর্য দৃশ্য। একটা লোক, যার তেলতেলে ভাব উধাও হয়ে পড়ে রয়েছে স্রেফ ‘হোসানা’ মাফিক পাগলামি, সে… তার রুটি আর মরিচ পড়ে আছে সানকিতে অভুক্ত… তার ঘরে আরশোলা উড়ছে গোটা চারেক ফড়ফড়। আর ঘরটার সাইজ সাত ফুট বাই তিনফুট… আর তার কবিতা ছাপা হবে না কোথাও সাড়ম্বরে… আর তার লেখা কেউ পড়বেও না ফেসবুকে… বলবে না বাহ বাঃ… অথচ তাও লিখে চলেছে সে স্রেফ লেখারই তাগিদে। মোচনেরই তাগিদে। মোক্ষণেরই তাগিদে। কালো অক্ষরের পিছনে নিজেকে আশ্রয় দেওয়ার তাগিদে।
সেই তো শুদ্ধতম লেখা সূর্য। সেই তো শুদ্ধতম নিবেদন। তার অক্ষরবৃত্তের গাফিলতি ধরবে, বা শুধরে দেবে বানান… এ অধিকার স্ময়ং যে বাগদেবীরও নেই এতটুকু। সে লেখা আপন-ই শুদ্ধতম। আপন-ই স্বার্থক। আপন-ই মোক্ষণ। স্বতঃস্ফূর্ত।
তাই না? সূর্য?
সেটাই শেষ দেখা হতে পারতো পলাশের সাথে আমার…জানো! কারণ তার ঠিক তিনদিন বাদে ওই হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। আচমকা। এবং “ব্রিচ অফ কন্ট্রাক্ট” এর কারণে মাইনেও পাইনি এই এক মাসের পরিশ্রমের।
কষ্ট? সে কি আর হয়নি? কিন্তু সে কথা থাক। কথা হোক পলাশের আপাতত। এসো, গল্প এগোই। আমি। আমরা।
তো এরও মাস দুয়েক পর, আমি যখন ফিরসে সরকারি আউটডোরে আবার, পলাশ এসেছিল দেখাতে। এসেছিল… আমায় চমকে দিয়ে।
-“কেউ বলে না স্যার আপনি কোথায়। কত জিগ্যেস করি। কেউ বলে না। সবাই বলে, উনি ভালো ডাক্তার না। উনাকে দেখবেন কেন? আরো ভালো ডাক্তার এনেছি আমরা এখন… দেখান। কিন্তু আমি তো…। লাস্টে গেট কিপার বললো– উনাকে ওই খানে পাবেন। তাই… চলে এলাম। “
কতখানি তৃপ্তি জানো কি? সূর্য? মরে যেদিন যাবো, এইগুলোই নিয়ে যাবো তো হে বুকপকেটে ভরে। সদর্পে। চিন আপ। তৃপ্ত আর দৃপ্ত হয়ে। রোজ কায়ামতের দিন খুদার নূরের দিকে চোখ চাইব নিঃসঙ্কোচে।
পলাশ ভালো হয়ে গেছে সূর্য। পলাশকে আমি নিয়ম ভেঙে আমার ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারও দিয়েছি। এবং সেই নাম্বারে ফোন আসেনি আজ সতেরো দিন হলো।
পলাশ, কম বয়সের তনুশ্রীকে নিয়ে ভালো আছে এখন তার মানে।
এটা জয়।
আমার না।
পলাশের না।
চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও নয়।
এটা স্রেফ…ফুটফুটে কন্যার মা হওয়া আর খুশি থাকা আর উদ্ধত চিবুকের তনুশ্রীর জয়।
তুমি কি জানো সূর্য, লায়লা শব্দটা উচ্চারণ ভেদে লাইলা হতে পারে কখনো কখনো? হতে পারে লা ইলা লা ইল্লাহ লা। থাকতে পারে প্রিয়ার মুখ প্রতিটা ধূলি কণায়? যে ধূলি কনা কপালে মেখে ফনাহ্ হতেও কষ্ট নেই এতটুকু?
কিন্তু সে তো সুফির জীবন সূর্য। কিংবা ক্যায়েজ, যার আসল নাম ভুলে গিয়ে সবাই তাকে চেনে পাগল নামে, চেনে… মজনুন সম্বোধনে। মজনুন মানে যে আদতে উন্মাদ… পাগলেরও যে একটা নাম থাকতে পারে পিতৃদত্ত… সেটাও ভুলে গেছে সবাই। ক্যায়েজ-এর এটাই পরম প্রাপ্তি। তার প্রেয়সীর নাম দুনিয়া জানে। লায়লা। আর তার নাম জেনে এসেছে– মজনুন। পাগল। উন্মাদ। ক্যায়েজ নামটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ জগত থেকে।
সেই তাদের মতো ফনাহ্-র জন্যই এই দগ্ধানোর জীবন উপযুক্ত সূর্য। কিংবা… পলাশের জন্যও।
কিন্তু, তোমার মামুলি জীবনের জন্য এই গেরুয়া বড় বেমানান ভাই।
আর তাই…
শিফট এবং ডেল অল।
কেমন?
সূর্য?
আর কেউ না থাক, আমি তো আছি।
আর আছে, বাস্তব। রূঢ়। প্রচন্ড। তীব্র ।
আর থাক আমার বকওয়াস কলমের দুটি লাইন।
ছাড়লাম তোকে, ছাড়লাম আমি, ছাড়লাম… এইবার।
তোকেই ভালোবাসতে গেলে, তোকেও লাগে না আর।
এ লাইন দুটো পূর্ণাঙ্গ কবিতা হয়ে সস্তা হাততালি কুড়াতে পারতো একদিন হয়তো ফেসবুকে। কিন্তু কথা দিলাম, কখনো সম্পূর্ণ করব না এ লেখা। এ লেখা তোমার জন্য।
শুধু তোমারই জন্য সূর্য।
শুধু…তোমার জন্য।
(নীচের তিনটে কবিতা, পলাশের সেই কবিতার খাতা থেকে। পায়ে পড়ছি
বানান ভুল ধরবেন না।)