গজেনদা চিরকুটটা নিয়ে এসেছিল। ক্লাসে তখন ইংরেজি পড়াচ্ছেন ঋষিবাবু। ছোটোখাটো চেহারার মানুষটির দৈহিক খর্বতা উসুল করে দিয়েছে তাঁর গলার আওয়াজ। ক্লাসরুমে পেছনের বেঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে পড়াতে শুরু করেন আর পরের চল্লিশ মিনিট সারা ক্লাসরুমে সবাক পদচারণা। ইংরেজি গ্রামারে ‘ভয়েস চেঞ্জ’ ন্যারেশান অবিরাম বলে চলেছেন সহজ থেকে শক্ত, শক্ত থেকে শক্ততর — আমরাও অবলীলায় করে চলেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতন। ওঁর নজরে কিন্তু ক্লাসের পেছনের সারির ছেলেরা। ওনার ক্লাসে তথাকথিত পেছনের সারি বলে কিছু ছিল না সবাই সমান তালে এগোত। ঋষিবাবুর সাফল্য এখানেই।
কিন্তু আমার তো ডাক এসেছে গজেনদার চিরকুটে–হেডস্যারের ঘরে।
সবুজ পর্দা সরিয়ে,—‘আসতে পারি স্যার’ বলার সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন হেডস্যার সুধাংশু বাবু।—স্কুলটা কার কথায় চলবে? আমার না তোমার?
কিছু বলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু হঠাৎই চোখ অন্ধকার।ওই চওড়া বলিষ্ঠ হাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ আমার গালে।
ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে স্যার ধরে ফেলেছেন।–
—নে এবার নাকখত দে।
স্যারের ঘরের মেঝেয় আমার গড়াগড়ি খাওয়া। ভাগ্যিস ক্লাস এইটে হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছি। বেশ বুঝতে পারছি ঈষদুষ্ণ তরল পদার্থ পা গড়িয়ে নামছে।ক্লাস এইটের স্নায়ুতন্র এই অতর্কিত আক্রমণ সামলাতে পারে নি।
‘নে জল খা’–নিজের জন্যে রাখা জলের গ্লাস বাড়িয়ে দিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া হেডস্যার।
কারণ—সে এক বড় কাহিনী।ছোট করে বললে সে বছরেই ছোটবাড়ি পুরনো জায়গা ছেড়ে স্কুলের ক্যাম্পাসে নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে। শনিবারের সাহিত্যসভা এতোদিন দু- বাড়িতে আলাদা হতো, কিন্তু এবার প্রস্তাব এলো একসাথে বড় বাড়িতেই হবে। আমি মৃদু প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম, আলাদা থাকাই ভালো।ধোপে টিকলো না আমার মৃদু প্রতিবাদ। বড় বাড়ির সাহিত্য সম্পাদক তখন আমারই অগ্রজ, স্যারের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র।
সুতরাং—–
এরই মধ্যে আমি করে ফেললাম এক দুঃসাহসিক কাজ, ছোটবাড়িতে গিয়ে বলে এলাম, কেউ সাহিত্য-সভায় যাবি না।
ব্যাস প্রথম সাহিত্যসভা সুপার ফ্লপ। অনুপ মুখুজ্জের মুখ কালো।হেডস্যার থমথমে। আর আমার কপালে গজেনদার চিরকুট।
চিকিৎসার যেমন অ্যাক্যুট আর ক্রনিক ফেজ থাকে হেডস্যারেরও শাস্তির এটা হলো তাৎক্ষণিক প্রয়োগ। এরপর শুরু হলো শাস্তির ক্রনিক অত্যাচার।
ফতোয়া জারি হলো প্রতিটি সাহিত্য সভায় উপস্থিত থাকতে হবে ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। সে এক অদ্ভুত অত্যাচার। স্কুলে অনুপস্থিত হলে সবাইকে গার্জেনের চিঠি নিয়ে গেলেই হতো, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে নিদান হলো গার্জেনের চিঠি তো বটেই তার সাথে আমি স্কুলে না এসে কি করেছি তা লিখে জমা দিতে হবে। সে বিয়ে বাড়িতে যাওয়া বা মামার বাড়ি আদর খাওয়া হোক।অত্যাচার চরম সীমায় পৌঁছল যখন নারাণবাবু স্যার এসে বললেন সামনের দুটো রবিবার আমার সাথে বেড়াতে যাবি। আমার অবাক চোখের তাকানো দেখে বললেন, হেডস্যার বলেছেন তোকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় মঠ আর সিমলেয় বিবেকানন্দের বাড়ি ঘুরিয়ে আনতে।
চক্রান্তটা তখনও ধরতে পারিনি স্যার। রহস্যটা ফাঁস হলো রবিবার সকালে বেড়াতে যাবার মুহূর্তে। হেডস্যার–আপনি নাকি একটা খাতা পাঠিয়ে দিয়েছেন তার প্রথম পাতায় লেখা,”রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ স্মৃতি তীর্থে”। অর্থাৎ নিখাদ বেড়ানো নয়, একটি তথ্য মূলক ভ্রমণকাহিনী লেখার পরীক্ষা।
ক্রমশই এই শাস্তি আমার লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে উঠছিল, আর তখনই এক চমক।
স্যার তখন অকাল অবসরে (সে এক অন্য গল্প)। আমিও সেই বছরেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছি। বাহাত্তরের স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে স্যারের কাছে নারাণবাবু গিয়েছিলেন ওনার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার বিষয়ে লেখার জন্য।
উনি নাকি বলেছেন,– অভিজিৎকে পাঠিয়ে দাও।
শাস্তির পর এ তো প্রাপ্তির খবর।
ছুটলাম কাসুন্দিয়া রোডের সেই সাধারণ অথচ বিখ্যাত বাড়ির দিকে। যে বাড়ির পাশ দিয়ে চিরকাল ভয়ে ভয়ে আমি আর ভক্তিভরে বাবাকে যেতে দেখেছি।
হিমাংশুবাবু ডাকলেন,– এসো অভিজিৎ।
আমি যেন এক রূপকথার রাজ্যে ঢুকে পড়ছি। কাঠের চেয়ারে ফতুয়া পরে হেডস্যার, — কাছে আয়।
হিমাংশুবাবু বিস্কুট আর চা আমার জন্য নিয়ে আসছেন। বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ অকৃতদার দুই ভাই নিজেরাই নিজেদের কাজ করতেন।হেডস্যার বন্ধুর মতো তাঁর জীবনের নানা গল্পকথা শোনাচ্ছেন। হিমাংশুবাবুর মাঝে মাঝে সংযোজন ওঁর মধ্যের রসিক মানুষটিকে বার করে আনছে।যে ঘটনা বা গল্প ঘন্টা দুয়েকে মিটে যাবার কথা, সেটাই তিন দিনের এক সুখ সাগরে কাটল। এ তিন দিন দুপুরে স্যারের কাছে যেতাম আর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামার মুখে বলতেন, এবার আয়।
আসার সময় মনে হতো স্যারের শাস্তিটা গুরুপাপে লঘুদণ্ড হয়ে গেছে।
পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আজ আবার স্কুলের বড়বাড়িতে হেডস্যারের ঘরে আমি। মুখোমুখি বর্তমান হেডস্যার শতদল বাবু।
সেই ঘর সেই টেবিল ছুঁয়ে দেখছি।
‘অভিমুখ’ কে ভয়ে ভয়ে টেবিলে রাখলাম। আপনার প্রতিনিধি শতদল বাবুর হাতে তুলে দিলাম। এ তো আপনারই বোনা ফসল।
আপনার ছবি টাঙানো আছে দেখলাম। কিন্তু গোটা ঘর জুড়েই তো অনুভবে আপনার উপস্থিতি। তাই ইচ্ছে থাকলেও ঘরের ছবি তুলতে পারলাম না।
আপনার সাথে আমার কোনো ছবি নেই। তখন ছবি এতো সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু মন-ক্যামেরায় যে ছবি আজও অমলিন আর উজ্জ্বল সেগুলো তো নট ডিলিটেবল।