প্রেগন্যান্সির সময়ে মা ও শিশুর নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার দরকার হয়ে পড়ে। কখনো অসুস্থতার কারণে, কখনো নর্মাল প্রোটোকল মেনে। যেটা নিয়ে অনেকেরই সঠিক ধারণা থাকে না।
ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শুরু করি এই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
কথিত আছে, অভিমন্যু মাতৃজঠরে থাকাকালীন চক্রব্যুহে ঢোকার উপায় শুনেছিল। কিন্তু বেরোনোর উপায় শুনতে পায়নি। এ গল্পে যাবো না।
তবে সাত মাসের পর থেকে গর্ভের সন্তানের কানের ভেতরের সবকিছু তৈরি হয়ে যায়। অতএব, গর্ভাবস্থায় কোন কারণে যদি কানের ক্ষতি হয়, সেক্ষেত্রে জন্মের পর শিশুর শোনার ক্ষমতা নাও থাকতে পারে।
শুধু কান নয়, এরকম অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রেই, গর্ভাবস্থার বিভিন্ন বয়সে একই কথা প্রযোজ্য। এবার এইরকম ক্ষতি হবার নানান কারণের মধ্যে একটি কি গর্ভাবস্থায় রেডিওলজিকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা?? আরো সহজ করে বললে বিভিন্ন রশ্মির বিকিরণের প্রভাব?
বলে রাখি, জাপানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরই পৃথিবীতে এই বিকিরণ ও সেই সংক্রান্ত ক্ষতিকর দিক নিয়ে আমরা ভাবতে শুরু করেছি।
গবেষণা চলছে এখনো – যেমন চলতে থাকে বিজ্ঞানের সব বিষয় নিয়েই।
বলে রাখা ভালো – আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও প্রতিদিন কোন না কোন রশ্মি বিকিরিত হয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। সেটাও নেহাত কম নয়।অতএব, শুধুমাত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর ফলেই যে বিকিরণ দ্বারা ক্ষতি হয়, এই ভ্রান্ত ধারণা প্রথমেই ছুঁড়ে ফেলা দরকার।
তবে এক্ষেত্রে, একমাত্র রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ এবং স্ত্রীরোগ বা অন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনেই এইসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হবে।
প্রাথমিক যে বিষয়টিতে নজর দিতে হবে – সেটি হলো- রোগীর নির্দিষ্ট শারীরিক অবস্থায় পরীক্ষাটি লাভজনক কিনা।
তারপর, পরীক্ষায় রেডিয়েশন বা বিকিরণ ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, কারণ এক্ষেত্রে বিকিরণই প্রাথমিক কালপ্রিট, যে গর্ভাবস্থায় শিশুর ক্ষতি করতে পারে (যেমন সিটি স্ক্যান, এক্স-রে, বেরিয়াম পরীক্ষা, ফ্লুওরোস্কোপি ইত্যাদি)!
কোন কোন গুলোতে বিকিরণের ব্যবহার নেই (ইউএসজি, এমআরআই)।
তারপর আসবে গর্ভাবস্থায় কোন সময়ে পরীক্ষাটি করা যাবে, কোনগুলো, কোন প্রয়োজনে গাইডলাইন অনুযায়ী করা যাবে।
কোনরকম কন্ট্রাস্ট ম্যাটেরিয়াল (আয়োডিন, গ্যাডোলিনিয়াম) ব্যবহার করা যাবে কি যাবে না, এই রকম আরো কিছু বিষয়।
যেহেতু বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই এক্ষেত্রে, এই আলোচনায় যা যা বলবো, সেগুলো আমি পরপর লিখে যাব পয়েন্ট করে। কোনরকম সংখ্যাতত্ত্ব কিংবা রেফারেন্সের কচকচিতে যাব না। সকলের সুবিধার্থে,
প্রচলিত নিয়ম কানুনগুলো যেমন আছে, সেগুলো লিখে যাব। শুধু বলে রাখি – এই সব বিষয় নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী। তার ফলাফল বলতে গেলে দিন রাত কাবার হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের সেগুলো নিয়ে মাথা খারাপ না করলেও চলবে।
*** ***** *******
১. বিকিরণ ব্যবহার ও তার ক্ষয়ক্ষতি: দুই ধরনের ক্ষতি হয় বিকিরণ থেকে।
অল্প অল্প করে বহু বার বা একবারে অনেকটা বিকিরণ – আলাদা আলাদা ধরনের ক্ষতি করবে। এক্ষেত্রে বলা যায় – মদ এর ক্ষতিকর প্রভাবও এভাবেই হয়।
রোগী তথা মা, চিকিৎসককে আগের সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার তথ্য জানালে খুব ভালো হয়।
- সাধারণতঃ গর্ভাবস্থায় যে কোন সময় 50 mGy-এর কম বিকিরণ পুরোপুরি নিরাপদ।
- 50-100 mGy বিকিরণে ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে।
- 100 mGy-এর বেশি হলে নানারকম ক্ষতি হতে পারে যেমন – আইকিউ কম হওয়া, বিকলাঙ্গ হওয়া, মানসিক বৈকল্য ইত্যাদি।
আবার ক্যান্সার বা জিন এর মিউটেশন হবার মতো ক্ষতিও হতে পারে। সেটাও নির্ভর করবে বিকিরণের পরিমাণ ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর।
২. বিকিরণের ক্ষতি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ভাবার সময় হলো – গর্ভাবস্থায় তিন থেকে সতেরো সপ্তাহ অব্দি। অবশ্য বলা হয় – আটাশ সপ্তাহ অব্দি 100 mGy-এর বেশি বিকিরণ যেন না হয়।
( mGy এক্ষেত্রে বিকিরণ মাপার একটি একক)
বাকি সময়েও ভাবতে হবে, তবে সেই সময়ে বিকিরণ শিশু ও মায়ের কতটা ক্ষতি করতে পারে, আদৌ পারে কিনা – সেই নিয়ে প্রামাণ্য তথ্য নেই। সাধারণ জ্ঞান আছে। তাই, সেটাও একমাত্র ডাক্তারই বিবেচনা করবেন।
৩. সিটি স্ক্যান নামক পরীক্ষা নিয়ে গাইডলাইন হলো – নিতান্ত দরকার না হলে গর্ভাবস্থায় পরীক্ষাটি করা যাবে না। অন্য পরীক্ষা (যেমন ইউএসজি বা এমআরআই) করে যদি প্রয়োজন মিটে যায়, তাহলে সেটাই করতে হবে ।
করলে বিকিরণের পরিমাণ যতটা সম্ভব কম করা যায়, মেশিনে নানারকম পরিবর্তন করে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশুর শরীরে বিকিরণ যাতে বেশি না যায়, তার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৪. এখনো অব্দি পাওয়া গবেষণার তথ্য বলে – সিটি স্ক্যান পরীক্ষায় ব্যবহৃত আয়োডিন জাতীয় কন্ট্রাস্ট ম্যাটেরিয়াল গর্ভের শিশুর ওপর কোন খারাপ প্রভাব ফেলে না। একটি মত আছে – শিশুর থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা হতে পারে। সেই অর্থে, রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহারের পর তার ক্ষতি নিয়ে প্রামাণ্য তথ্য নেই।
৫. চিকিৎসকরা সমস্ত গর্ভবতী মা ও তার বাড়ির লোকজনদেরকে অবশ্যই এই বিষয়ে সমস্ত তথ্য আগে ভাগেই জানিয়ে রাখবেন। আরো বড় কথা – চিকিৎসক, এক্ষেত্রে বিশদে জানানোর পর মা অথবা তার অভিভাবককে দিয়ে অনুমতিপত্রে সাক্ষর করিয়ে রাখবেন ।
৬. এমআরআই নিয়ে বিশদে বলার উপায় নেই। সংক্ষেপে বলি – এতে কোন বিকিরণের ব্যবহার নেই। (কিন্তু কিছু ইনহেরেন্ট সমস্যা আছে যখন এটা করানো যাবে না – যেমন – পেসমেকার বা কোন ধাতব পদার্থ শরীরে থাকলে বা রোগীর ক্লস্ট্রোফোবিয়া থাকলে।) সেদিক থেকে এটি ভালো।
ইদানিং শিশুর শরীরে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং মেশিনের অতিরিক্ত শব্দ শিশুর শ্রবণশক্তির ক্ষতি করছে কিনা, সেটি নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে, ১.৫ টেসলা অব্দি ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করা হয়, এমন মেশিনে সাধারণতঃ কোন ক্ষতি হয় না।
৭. গ্যাডোলিনিয়াম নামক যে কন্ট্রাস্ট ম্যাটেরিয়াল এমআরআই-তে ব্যবহার করা হয়, সেটি পশুর শরীরে গর্ভাবস্থায় ক্ষতি করে বলে প্রমাণ পাওয়া গেলেও, মানব শরীরে তেমন কোন ক্ষতি করে বলে জানা নেই। এই পদার্থটি অ্যামনিওটিক ফ্লুইডে জমা হয়। বিষাক্ততা নিয়ে প্রমাণিত তথ্য নেই।
আর গ্যাডোলিনিয়াম যেহেতু ,C class এর ড্রাগ , মানুষের শরীরে এর ক্ষতিকর প্রভাব এখনো অজানা। অতএব, চিকিৎসকই ঠিক করবেন – এটা ব্যবহার করবেন কিনা।
৮. ফ্লুওরোস্কোপি বা এক্স-রে – দু’টোই বিকিরণ ব্যবহার করে করা হয়।
অতএব , সেই বিকিরণের পরিমাণ কতটা হতে পারে, সেটির ব্যবহার রোগীর ক্ষতির চেয়ে উপকার বেশি করবে কিনা, সেটি কতটা কম করা যায়, এসব নিয়ে রেডিওলজিস্ট এবং অন্যান্য চিকিৎসকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নেবেন। তবে সহজে বলা যায় – তিন থেকে সতেরো সপ্তাহ – এই সময়ে জরুরি না হলে বারবার এক্স-রে না করাই ভালো।
কোন রকম ভাঙাচোরা বা টিউমার বা জরুরি অপারেশন জাতীয় সমস্যা থাকলে – অল্প বিকিরণ ব্যবহার করে এক্স-রে করা যায়। বুকের বা কোমরে একটি এক্স-রে সাধারণতঃ কোন ক্ষতি করে না ।
৯. কোন পরীক্ষায় বিকিরণ ব্যবহার করা হলে – সেটি শিশুর শরীরে কতটা পৌঁছেছে , সম্ভব হলে সেটির একটি হিসেব রাখা ভালো। আমরা তাকে বলি – ফিটাল ডোসিমেট্রি।
১০. এবার আসি বহুল ব্যবহৃত পরীক্ষা – আল্ট্রাসাউন্ড বা ইউএসজি নিয়ে।
এটি যেহেতু শব্দ নিয়ে কারবার, এক্ষেত্রে বিকিরণের কোন প্রশ্নই ওঠে না।
প্রেগন্যান্সির যে কোন সময়ে, মা ও শিশুর যে কোন দরকারে ইউএসজি করা যেতে পারে। তবে, অবশ্যই সেটা স্বীকৃত কোন বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্টকে দিয়েই করানো উচিত। না হলে বিনা প্রয়োজনে বারবার করাতে হতে পারে বা অন্য পরীক্ষা, যাতে বিকিরণ ব্যবহার করা হয়, সেটি করাতে হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে যেটা বলা হচ্ছে – প্রথম আট সপ্তাহ অব্দি বেশি সময় ধরে ইউএসজি করা উচিত নয়। শব্দ শক্তি এক্ষেত্রে তাপ শক্তিতে পরিণত হয় এবং গর্ভের সন্তানের ক্ষতি করতে পারে। কালার ডপলার এবং পাওয়ার ডপলার বলে দু’টি প্রযুক্তি ইউএসজি তে ব্যবহার করা হয়। সেটি দরকার না হলে ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ ওতে অনেক বেশি শব্দ শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে – ক্ষতি হোক আর নাই হোক, কোন কারণ ছাড়া বারবার ইউএসজি করা উচিত নয়।
অনেকে পেটের শিশু ছেলে না মেয়ে – সেটি জানার জন্য বারবার পরীক্ষা করান। এই জঘন্য মানসিকতা পরিবর্তন করা উচিত।
১১. একটি বিষয় বলা জরুরি – আজকাল অনেকেই আইভিএফ পদ্ধতিতে গর্ভধারণ করেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসক সব সময় অতিরিক্ত বিশ্রাম ও অন্যান্য সাবধানতা নিতে বলেন। মাকে বারবার ইউএসজি করার ধকল এক্ষেত্রে না দেয়াই বাঞ্ছনীয়।
১২. গর্ভাবস্থায় সাধারণতঃ তিনবার ইউএসজি করার প্রোটোকল আছে।
কিন্তু চিকিৎসকরা দরকারে আরো বেশি বার ইউএসজি করাতে পারেন।
১৩. বিদেশে সাধারণতঃ প্রথম তিন মাসে (এমনকি তার পরেও) টিভিএস পদ্ধতিতেই ইউএসজি করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেরকম বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্টের যথেষ্ট অভাব এবং রোগীরা ও এই পরীক্ষায় সায় দিতে চান না বলে, পেটের উপর দিয়েই পরীক্ষা করা হয়। রোগী ও চিকিৎসকরা মিলেই এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
১৪. ফোকাসড স্ক্যান বলে একটি কথা আছে ইউএসজি-তে। একমাত্র বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্টই রোগীর প্রয়োজন বুঝে নিয়ে অল্প সময়ে সেটি করতে পারেন।
১৫. আনোম্যালি স্ক্যান বলে একটি পরীক্ষা হয় ইউএসজি-তে। সাধারণতঃ গর্ভাবস্থায় তৃতীয় ও পঞ্চম মাসে এটি করা হয় সন্তানের শরীরের সব কিছু খুঁটিয়ে দেখার জন্য ।এটিও যাকে তাকে দিয়ে করানো উচিত নয়। কারণ, একটি মাত্র ভুল হয়ে গেলে বা না হলেও সন্দেহ নিরসনে ফের পরীক্ষা করাতে হতে পারে। এমনকি সিটি স্ক্যান বা এমআরআই ও করাতে হতে পারে।
১৬. মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যদি দেখা যায় সন্তানের কোন রকম সমস্যা আছে এবং ইউএসজি-তে পুরোটা বোঝা যাচ্ছে না, সেক্ষেত্রে এমআরআই করা যাবে। সিটি স্ক্যানও করা যেতে পারে – তবে আবারও, লাভ ক্ষতির হিসেব মিলিয়ে, কম বিকিরণ ব্যবহার করে! ALARA (As Low As Reasonably Achievable) প্রিন্সিপ্যাল মেনে।
১৭. গর্ভাবস্থায় মায়েদের কিছু অসুখ বেশি হয় যেমন – pulmonary embolism, venous thrombosis, appendicitis , kidney stone, bowel obstruction, hernia, accidental injury, ইত্যাদি ইত্যাদি।
একমাত্র প্রথম দু’টি বাদ দিলে বাকিগুলোর ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্ট যদি ইউএসজি করেন, তাতেই সবকিছু ধরা পড়ার কথা।
প্রথমটির ক্ষেত্রে প্রথমে এক্স-রে, না হলে পরে লো-ডোজ সিটি অ্যান্জিওগ্রাফি বা পারফিউশন স্ক্যান করতে হয়।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে – ইউএসজি বা এমআরআই-ই যথেষ্ট।
বাকিগুলোর ক্ষেত্রে ইউএসজি-তে না হলে এমআরআই। এবং যদি একান্তই এমআরআই না থাকে – তাহলে সিটি স্ক্যান – সেও সব প্রোটোকল মেনে।
চিকিৎসককে কিছু ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই নিতে হয় রোগীর শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে। বিশদে প্রতিটি অসুখ ধরে ধরে লেখা সম্ভব নয়।
আশা করি, উপরোক্ত কথাগুলো মাথায় রাখলে, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, রেডিওলজিস্ট এবং অবশ্যই গর্ভবতী মা/বাড়ির লোকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলে, গর্ভাবস্থায় এইসব পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে কোনরকম অসুবিধায় পড়তে হবে না।
সকল মা সুস্থ থাকুক। সকল সন্তান সুস্থ থাকুক।