(এটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক, যে এই অধ্যায়ে অন্য কোনো ঘটনার স্থান সংকুলান হবেনা।)
৪৬.পটভূমিকা
এটা আলোচনা খুব জরুরি, প্রথমে ভাবিনি- পাবলিক ওপিনিয়ন দেখে এখন মনে হচ্ছে আন্দোলন কোন পথে চলছে এটা বুঝিয়ে বলা জরুরি। কমিউনিটি মেডিসিনে একটা কনসেপ্ট ছিল- target, objective আর goal, যাদের মনে আছে তাদের ভালো, যাদের নেই এই উদাহরণ থেকেই বোঝা যাবে।
এই আন্দোলনের goal একটাই- অভয়ার ন্যায়বিচার- এর চেয়ে বড় কিছু পাওয়ার থাকতে পারেনা আমাদের কাছে এই মুহূর্তে। সেই goal পাওয়ার জন্য আমাদের objective হলো আমাদের পাঁচ দফা দাবি- ১. অপরাধীদের চিহ্নিতকরণ, তাদের মোটিভ জানা, ২. সন্দীপ ঘোষের সাসপেনশন, ৩. কলকাতা পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগ/অপসারণ, ৪. স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা, ৫. কলেজে কলেজে ভয়ের রাজনীতি বন্ধ করা। এখন এই objective-গুলো পূরণ করতে আমাদের ছোট ছোট target থাকে, আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচী হলো সেই target- যেমন সন্দীপ ঘোষের সাসপেনশনের দাবিতে স্বাস্থ্য ভবন অভিযান হয়েছিল, সেরকমই কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে লালবাজার অভিযানের অবতারণা। কেন পদত্যাগের দাবি, পুলিশের কী কী গাফিলতি ইত্যাদি নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই!
আমাদের ছাত্রদল স্বাস্থ্য ভবন গেছে শান্তিপূর্ণ মিছিল করে- প্রতিনিধিরা ডেপুটেশন জমা দিয়েছে, বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করছে। ভেতরে মিটিং ফলপ্রসূ হয়নি স্বাভাবিকভাবেই- আমরা ফিরে এসেছি, কর্মবিরতি চালিয়ে গেছি। শান্তিপূর্ণ মিছিলে এর বেশি কিছু আশা করা অন্যায়।
এখানেও সেরকমই আমাদের কর্মসূচি ছিল, আমরা ডেপুটেশন জমা দেবো এবং তার সঙ্গে একটা শিরদাঁড়ার প্রতিকৃতি কমিশনারকে দেওয়া হবে, মেরুদণ্ডহীন ভাবে শাসকদলের স্তাবকতা করার জন্য।
৪৭. এক্ষেত্রে অসুবিধা কী হলো!!
এক্ষেত্রে আমাদের মিছিল শুরুর আগেই ব্যারিকেড পড়লো বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। আমরা গিয়ে দেখলাম দ্বিস্তরীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী। যে কলকাতা পুলিশ ১৪ আগস্টের রাতে সেমিনার রুম ভাঙতে আসা গুন্ডাবাহিনীকে দেখে শৌচালয়ে লোকায়, তারা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ মিছিলে ব্যারিকেড লাগায় এবং আমাদের সামনে যেতে বাধা দেয়। এখানেই গোল বাঁধে।
আমাদের দাবি খুব সাধারণ ছিল। ব্যারিকেড সরিয়ে আমাদের এগোতে দিতে হবে, আধ কিলোমিটার দূরে মিছিল আটকে ১০জনকে ডেকে পাঠানোর কোনো মানে নেই। বন্ধ ঘরে ফিশফ্রাই ধরিয়ে কথাবার্তা চেপে দেওয়ার পরিকল্পনা প্রতিবার সফল হওয়ার নয়। আর যদি আমাদের মিছিল না এগোয়, তাহলে কমিশনার সেখানে এসেই দেখা করুক- সর্বসমক্ষে। বীরবিক্রম কমিশনারের তাতে বিশেষ অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়!! কিন্তু বাস্তবে তা হয়না- সুতরাং বিকল্প থাকে একটাই অবস্থান বিক্ষোভ।
৪৮. পুলিশের পরীক্ষায় প্রশ্ন আউট অফ সিলেবাস
মিছিল ঘিরে অবস্থান বিক্ষোভ আগে অনেক সামলেছে পুলিশ। ক’দিন আগেই ছত্রভঙ্গ করেছে নবান্ন অভিযান। ব্যারিকেড ভাঙলেই জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট- এসব জানা। কিন্তু কেউ ব্যারিকেড না ছুঁয়ে বসে থাকলে কী করা যায়, সেটা অজানা। তাও আবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ- শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর কোনো অনাচার নয়!!
সুতরাং তাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন কোমর ধরে গেল তারা চেয়ার আনলো- তাদেরও অবস্থান শুরু। স্লোগান, কটাক্ষ ধেয়ে আসছে- তাদের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। শ্লেষের সুর ক্রমে তির্যক হচ্ছে- প্রত্যুত্তর দেওয়ার কোনো উপায় নেই।
বড় মহলের লোকজন মাঝেমধ্যে আসছে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিনীত গোয়েলের শ্রীমুখ না দেখে আমরা কীভাবে ফিরে যাই!!
৪৯. এই রাত তোমার আমার
অবশেষে জুনিয়র পুলিশদের জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আই. পি.এস. অফিসার পলায়ন করলেন। মিথ্যাবাদী ডি.সি. সেন্ট্রালের হাসিও তখন ফুরিয়ে এসেছে- কারণ নাছোড়বান্দা জুনিয়র ডাক্তারেরা রাজপথেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে!! মাঝে লোকজন একটু কমেছিলো, রাত্রিযাপনের পরিকল্পনা শুনে আরো লোক জুটেছে এবং তারা তীব্র আক্রমণ শানাচ্ছে স্লোগানে স্লোগানে। চেয়ারে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও ব্যারিকেডের এদিকে ঘুমের লেশমাত্র নেই, শ্লেষ আছে যদিও- প্রমাণ লোপাট নিয়ে, ক্রাইম সীন ঘেঁটে দেওয়া নিয়ে, ১৪তারিখ দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে, আরো কত কী!!
এই ব্যাপারে যদিও এই শ্রমিক পুলিশদের কোনো দোষ আমি দেখিনা। আমরা যখন স্যারদের কথায় হাসপাতালের চাপে দাগী আসামিগুলোকে ‘অসুস্থ’ বলে উডবার্ন ওয়ার্ডে পদসেবা করি, এই ব্যাপারটাও অনেকটা তাই- ওদের হাত-পা বাঁধা। কিন্তু ‘অসৎসঙ্গে নরকবাস’ তো হবেই। তাই যখন ওরা চেয়ারে সুখনিদ্রা গেছে, তখনই মাইকে বেজেছে জাতীয় সংগীত- উঠে দাঁড়াতে হয়েছে বেচারাদের!! ব্যারিকেডের এদিকের রাত যেমন ছিল প্রত্যয়ের, ওদিকের রাতটা বুঝি ছিল অপেক্ষার, কখন এই স্লোগান শেষ হবে। ওদের দুর্ভাগ্য স্লোগান বন্ধই হয়নি কখনো…
৫০. নতুন সকালে নতুন জাগরণ
আগের দিনের রাত যেমন ছিল ডাক্তারদের, পরদিন সকালটা ছিল সবার। দেশের কোন প্রান্ত থেকে ঠিক কী কী এসেছে আন্দোলনকারীদের জন্যে, তার হিসেব করতে বসলে দিস্তা খাতা ফুরিয়ে যাবে। খাবার, জল, ওআরএস, ত্রিপল, বসার জন্য প্লাস্টিক, বায়োটয়লেট- যত বেলা বাড়ছে, আয়োজনের বহরও ততই বাড়ছে।
ততই কপালের ভাঁজ চওড়া হয়েছে লালবাজারের মাথাদের। প্রায় ২৪ ঘন্টা পর অবশেষে এই অধ্যবসায়ের কাছে হার মেনেছে ঔদ্ধত্য- ব্যারিকেড সরেছে, বাস্তিল দুর্গের পতনের মতো উল্লসিত জনতা। এবং এটুকু বলতে পারি, সেই মুহূর্তে ওখানে সব ধর্ম, সব রং, সব পেশা- সব মানুষের সব সত্তা যেন মিলেমিশে একাকার, এমনকি বিধাতার অশ্রুও যেন বৃষ্টিরূপে নেমে এসেছে। কখনো তারা “আর কবে” গাইছে, কখনো গাইছে “কারার ওই লৌহকপাট”, কখনো বা “পথে এবার নাম সাথী”, আরো আরো কত কী!! অভয়া আজ উপর থেকে এই মুহূর্তটুকু যদি দেখে থাকিস, আশা করি গর্বে তোর বুকটাও ফুলে উঠবে। সেই মুহূর্তের উন্মাদনা উদ্দীপনা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা।
একটা দাম্ভিক প্রশাসনকে ব্যারিকেড খুলতে বাধ্য করা সেই ব্যারিকেড একবারও না ছুঁয়ে, স্বাধীনতার পর সম্ভবত প্রথমবার কোনো মিছিল ফিয়ার্স লেন পেরিয়ে লাল বাজারের দিকে যাচ্ছে- এই দৃশ্য আমি জীবনে দ্বিতীয়বার দেখতে পাবো কিনা জানিনা।
৫১. শেষের কবিতা
অবশেষে ২২জনের প্রতিনিধিদল লালবাজার যায়। তারা ডেপুটেশন জমা দেয়। দু’ঘন্টা মতো আলোচনা চলে। তারা পুলিশের ব্যর্থতার খতিয়ান ধরায় পুলিশকে, কিন্তু বিনীতবাবু নিজের পারফরম্যান্সে নাকি বেজায় খুশি! সে তিনি পুলিশমন্ত্রীর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, গর্ব অনুভব করারই কথা অবশ্য! যাইহোক, তিনি ডেপুটেশন নিয়েছেন এবং গোলাপফুলসহ শিরদাঁড়ার সাথে ছবিও তুলেছেন। বিনীতবাবু হয়তো বুঝতে পারেননি, মোটা চামড়া ভেদ করে এখনো ঢোকেনি ব্যাপারটা, কিন্তু ছবিটা বেশ উঠেছে!!
আমাদের কর্মসূচী মিটেছে বলেই অবস্থানও উঠেছে। কিন্তু তাতেই আমরা ছেড়ে আসিনি। ২৪ ঘন্টা অবস্থানে ওই জায়গায় যত আবর্জনা জমেছে, আমরা দায়িত্ব নিয়ে ঝাড়ু দিয়ে রাস্তার ধারে জমা করেছি, যাতে রাস্তা ব্যবহারযোগ্য থাকে। আর সকলের জ্ঞাতার্থে জানাই, এই কাজে সর্বাগ্রে ছিলেন কার্ডিওথোরাসিক সার্জারির বর্ষীয়ান অধ্যাপক- শিরদাঁড়াটা আমাদের এমনি এমনি হয়নি ভাই, এদের দেখেই শিখেছি 

৫২. এবার আসি কাজের কথায়…
অনেকে ভাবছে কী উদ্ধার হলো ভাই এসব করে, সিপি তো পদত্যাগ করলো না! যার জন্য এই অভিযান সেটাই তো হলোনা!! প্রথম কথা, সিপি-র পদত্যাগ করানোর আমরা কেউ নই, ওনার পদত্যাগ কেন করা উচিত, সেটা বলতে আমরা গেছিলাম। শুধু ওনাকে বলতে নয়, সমগ্র সমাজকে বলতে গেছিলাম। মিছিলের উদ্দেশ্যই তাই, পেশির আস্ফালন নয়, গণজাগরণ। আর ২৪ঘন্টা রাজপথে কাটিয়ে ডাক্তারেরা সেটা যথেষ্ট করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।
সিপি কার হাতের পুতুল, সেটা আমরা ভালোই জানি। একটা মিছিলে তার ঘটি উল্টে যাবে! ব্যাপারটা ওরকম নয় ভাই, এত সোজা নয় সব কিছু। আন্দোলনলগ্নে জন্মে অনেক লাঠিসোঁটা খেয়ে আজ এই জায়গায় এসেছে, এই যথেচ্ছাচার করবে বলেই, একদিনে হয়নি। সেই পাথরও একদিনে ভাঙবে না। সর্বোপরি তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই লড়া ডাক্তারদের কাজ নয়। আমাদের কাজ সমাজকে সঠিক বার্তা দেওয়া, সেটা আমরা দিয়েছি। বাকি কাজ সমাজ ঠিক বুঝে নেবে। মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে- এই আন্দোলন যত এগোচ্ছে, এই বিশ্বাস আমার তত দৃঢ় হচ্ছে।।
চমৎকার 🌹তোমরা এগোও, আমরা সঙ্গী হিসেবে আছি।