হাসপাতালে আবার রোগী বাড়তে শুরু করেছে। সর্দি-জ্বর আর শ্বাসকষ্টগুলো কয়েকমাস বেশ কম ছিল। এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। ওয়ার্ড উপচে পড়ছে। প্রায় প্রতিটি বেডেই একাধিক বাচ্চা। বাচ্চার কান্না, চিৎকার, মায়েদের অভাব-অভিযোগ, পাশের রাস্তার গাড়ির হর্ন… সব মিলিয়ে বেশ হইহই রইরই ব্যাপার। চিৎকার করে কথা বলতে বলতে গলা ধরে গেছে। একজনের সাথে কথা বলতে গেলে আর পাঁচজন ঘাড়ের ওপর চড়ে আসে। তার মধ্যেই পাশের কোনও খাবারের দোকান বা বস্ত্রবিপণীর বিজ্ঞাপন দিতে চলমান টোটো থেকে গান ভেসে আসছে। এই ধরনের টোটো থেকে সাধারণত হাড়জ্বালানো মিউজিকসহ রবীন্দ্রসংগীত কিংবা ‘তুমি আমার আশা, আমি তোমার ভালোবাসা’ জাতীয় গান শোনা যায়। গানের ঠিক মোক্ষম সময়ে ‘আশা, আশা, আশা…’ করে টান দেওয়ার মুহূর্তেই কেউ ঠিক বলে বসবে, “তিনদিন পায়খানা হয়নি ডাক্তারবাবু। কিচ্ছু খেতে চাইছে না।” এতগুলো বছর এই পরিস্থিতিতে কাটানোর পর লোকজনের কথার মানে বোঝার ব্যাপারে পিএইচডি করে ফেলেছি। সব ছেড়ে পায়খানা পরিষ্কার আর বাচ্চার না খাওয়ার প্রসঙ্গ এসে গেছে মানে বাচ্চা আগের থেকে অনেক ভালো আছে। ততক্ষণে ‘আশা, আশা, আশা’র পর গানের পরবর্তী অংশ চলে এসেছে ‘ভালোবাসা, ভালোবাসা, ভালোবাসা’। মনে হচ্ছে, তিনদিনের জমা পায়খানায় মাখামাখি হয়ে ভালোবাসা বেরোচ্ছে। ঠিক জানি, এরপরই সেই বিখ্যাত গ্যাস আর হজমের ওষুধ লিখে দেওয়ার বায়না আসবে। মাঝে মাঝে বায়না আসার আগে মুখস্থের মতো বলে দিই, “হজমের ওষুধ খাওয়ানো আর বাড়ির পাশের জলের কল থেকে এক গ্লাস জল খাওয়ানো একই ব্যাপার।” কখনো সখনো অবশ্য ‘গোল’ খেয়েও যাই। লোকজন ধুম জ্বর কিংবা শ্বাসকষ্ট থাকা অবস্থাতেও ‘গ্যাস’ নিয়েই বেশি চিন্তিত। কেননা পাড়ার ডাক্তার হরেন কিংবা মদনবাবু বলে পাঠিয়েছেন, জ্বর-টর সবই মারাত্মক গ্যাসের ফল! মনে মনে রোগের শ্রেণীবিভাগও করে ফেলেছি। জুনিয়রদেরও শিখিয়ে দিয়েছি। রোগ আসলে তিন প্রকার: নো গ্যাস, অল্প গ্যাস, মারাত্মক গ্যাস! অতয়েব, দশদিন জ্বর না ছাড়লেও ক্ষতি নেই। আগে গ্যাসটা কমানো দরকার। দিন দিন বেশ ভালো ওঝা হয়ে উঠছি। কতবার যে খিঁচুনি রোগীর মাথায় উঠে যাওয়া ‘গ্যাস’ হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের করেছি তার ইয়ত্তা নেই। মনকে বুঝিয়েছি, গ্যাসময় এ বিশ্বে গ্যাস-ই পরম সত্য। বাকি সব আপেক্ষিক।
এর মধ্যে অল্প করে জেনারেল ইমার্জেন্সি ডিউটিও দিতে হচ্ছে। কত কতদিন বাদে বড়দের দেখছি। বেশিরভাগ জিনিসই ভুলে গেছি। কোনোমতে সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সবাইকেই দেখতে গিয়ে মুখে ‘বাচ্চা’ কথাটা চলে আসছে। ৭২ বছরের দাদুকে দেখতে গিয়ে বাড়ির লোককে জিজ্ঞেস করে ফেলছি, “হ্যাঁ বলুন, বাচ্চার কী অসুবিধে?” বাড়ির লোকজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাচ্ছেন। আমিও ঢোঁক গিলে প্রশ্ন বদলাচ্ছি। নার্সদিদি আর সিকিউরিটি দাদারা বুঝতে পেরে মুচকি মুচকি হাসছেন। শেষমেশ যখন ভুল করে গর্ভবতী মা’কেও দেখতে গিয়ে ‘বাচ্চা’ বলে ফেলেছি তখন বাড়ির লোকজন চমকে গিয়ে জানাচ্ছেন, “বাচ্চা এখানে কোথায়? বাচ্চা তো পেটে!” ইস! কেলেঙ্কারির একশেষ।
এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে জন্মাষ্টমীর প্রসাদ হিসেবে এক পাহাড় নাড়ু এসেছে। একসাথে সাজিয়ে রাখলে নাড়ুর পাহাড়ের ওপর অব্দি পৌঁছোতে প্রফেশনাল পর্বতারোহী লাগবে। সাথে লুচি, পিঠে, খই মিলিয়ে আরও একটা পাহাড়। এত একসাথে খাওয়া মুশকিল। অনেক জায়গায় বিলিয়ে দেওয়া গেল। আজ ব্যায়াম করার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু খানদশেক নাড়ু উদরস্থ করার শাস্তি হিসেবে কম করে হলেও ব্যায়াম করতেই হ’ল।
এর মাঝেই এক বিশেষ উপহারপ্রাপ্তির ঘটনা ঘটেছে। কিছুদিন আগে এক বছর তিনেকের বাচ্চা ধুম জ্বর আর গোটা মুখে সংক্রমণ নিয়ে খুব ভুগছিল। পুরো ঠোঁট, জিভ থেকে গলা অব্দি ঘা হয়েছিল। সপ্তাহখানেক খেতে অব্দি পারছিল না। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর বাচ্চা সুস্থ হয়। আজ বাচ্চার বাবা খুশি হয়ে জোড়া ইলিশ এনেছেন। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। একে ইলিশ, তায় উপহার! দ্বিগুণ আনন্দ। যদিও আমি এসবের যোগ্য কিনা সে প্রশ্ন আজকের মতো মুলতুবি রাখছি। ও হ্যাঁ, ইলিশের ভাগ চেয়ে কাজ নেই। সে আপাতত উদরের কোনও এক গহন গহ্বরে তলিয়েছে।