আমাদের তপ্পন বৈদ্য স্থানীয় ডাক্তার। একটা সময় জমজমাটি পশার ছিলো। এখন ভাগ্যের দুর্বিপাকে খালের ধারে একটা দেড় তলা দেড়কামরার ভাড়া বাড়িতে একা একা থাকেন। রোগীপত্রও বিশেষ নেই। দ্বিপ্রহর দীপ্ত হলে – খালপাড়ে চায়ের দোকানে ছাউনিতে বসে থাকেন। সন্ধ্যায় দু চারজন রোগী হলে বাজারের ভেতরে ওনার পুরোনো শ্যাঁতলা পড়া চেম্বার বন্ধ করে মানদাসুন্দরীর দেশী আসবের দোকানে পেঁয়াজকুচি সহ মদ্যপান করেন। মানদাসুন্দরী অত্যন্ত জাঁহাবাজ মহিলা। তার দাপটে চোরে পুলিশে এক গেলাসে বাংলু খায়। তাছাড়া ঠাঁটঠমকও আছে। কুলোকে বলে ডাক্তার নাকি মানদাসুন্দরীর আকর্ষণেই …. যাগগে ওসব বাজে গুজবে কান না দেওয়াই ভালো। মদের ঘোরে বদ্যিবুড়ো বাকি মাতালদের সঙ্গে ছোটবেলার গল্প করেন – বাঁকুড়া জেলার সেই কোন্ গ্রামে নিজের দেশের বাড়ির পুজোর গল্প করেন – তারপর নেশা যখন ঝিমঝিম করে – পৃথিবীর সমস্ত কাদা যখন মিলিয়ে যায় ডাক্তার তখন মনোজের দোকান থেকে তিনটি রুটি আর ডিমের কষা কিনে নিয়ে ফিরতে থাকেন। কলেজ জীবনে ভারী মিষ্টি গলা ছিলো তাঁর। নেশার ঘোরে কখনও কখনও দুকলি গানও ওনার গলায় নাকি শোনা যায়। তবে ডাক্তার বদ্যিকে সবাই বড়ো ভালবাসে। ঈষৎ মাতাল আর নিরীহ মাতালের ওপর বাঙালির সহানুভূতি আছে।
সেদিনকেও তখন সন্ধ্যা ঘনঘোর। মাথার ওপর দিয়ে শেষ মেট্রো চলে গেছে। ডাক্তার পথের মাঝে পথ হারিয়ে টলমল করছিলেন। একটি সদ্য দাড়ি গজানো পাড়ার ছেলে বদ্যিবুড়োকে হাতে ধরে পৌঁছে দিলো তাঁর নিজের পাড়ায় – নিজের ভাড়া বাড়ির সামনে।
বদ্যিবুড়ো আধো অন্ধকারে কোনোক্রমে চাবিটা খুলে ওপরে ওঠার সময় বাড়িওয়ালী বৌদি নাকে আঁচল চাপা দিয়ে একটা খাম ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দিলেন।
তপ্পন ঘর খুলে এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি গাইতে গাইতে সুইচ টিপে আলোটা জ্বাললেন। পকেট থেকে সিগারেট আর শখের নীল লাইটার বার করে সিগারেট ধরালেন – একবুক ধোঁয়া টেনে চশমা তুলে খাম থেকে চিঠিটা বার করে পড়তে লাগলেন।
আজকে কি বেশী পান করেছেন? উনি কি ইংরেজি ভুলে গেছেন? হাতের সিগারেট হাতেই পুড়তে লাগলো। ওনার মা বাবা দীর্ঘদিন নানা লড়াইয়ের মাঝখান দিয়ে প্রথম আর মধ্য জীবন কাটিয়েছেন। দন্ডকারণ্যের বাস্তুচ্যুত মানুষদের সঙ্গে – সিকিমের পাহাড়ি পথে তাঁরা তাঁদের ছোট্ট তপ্পনকে নিয়ে পথ করে চলেছিলেন। সত্তর সাল থেকে বাঁকুড়ার নিজেদের গ্রামের কাছে বাসা বাঁধেন। তারপর তাঁদের বাড়িতে জনগনণার লোকজন এসেছিলো। মনে আছে – আজও মনে আছে। মা বাবা নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের প্রাণের তপ্পনের নাম তুলেছিলেন সেনসাসের খাতায়। সে তো নাকি ছেষট্টি সালের পরে তাই ডাক্তার তপ্পন বৈদ্য আজ আর এই ভারতের নাগরিক নন। বাঁকুড়ার সার্কিট হাউস, কাঁসাই প্রকল্প -যে দেশে জন্ম কর্ম সব মিথ্যা হয়ে গেলো , বেলিয়াতোড়ের তিনশো ঊনিশে বছরের বাড়ির পুজো, ষষ্ঠী তলা গাজনের মেলা। বিশুকাকা অমিকাকা সানাইওয়ালা মুরুলি সব সব মিথ্যা । এইদেশ তপ্পনের দেশ নয়। আর তো কিছু চেনেন না আমাদের বদ্যিবুড়ো। আনমনে সিগারেট টানতে টানতে চলে গেলেন হ্যালোজেনের থেকে অন্য হ্যালোজেনের দিকে। ন্যাশানাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন বলছে ডাক্তার তপ্পন বৈদ্য এদেশের মানুষ নন যেহেতু ছেষট্টি সালের আগে জনগনণায় ওনার নাম ছিলো না তাই উনি বিদেশী । উনি এখন নতুন দেশের সন্ধানে এলোমেলো পায়ে হাতে সিগারেট নিয়ে এগিয়ে চলছেন। পেছনে থেকে গেলো দন্ডকারণ্যের রুক্ষতা সিকিমের নম্র শীতল পাহাড় আর বাঁকুড়ার ভৈরবথান – রেললাইন – তামলিবাঁধের বাস স্ট্যান্ড — সব ছেড়ে বুড়োটা চলেছে নতুন দেশের খোঁজে।