বাজি ফেলে বলা যায় যে সাইদুল বা স্বপনরা কেউ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অকুপেশোনাল সেফটি এন্ড হেলথ এর নাম শোনে নি। স্রেফ ওরা কেন, পাথর খাদানে কাজ করা বা নির্মাণ কাজে যুক্ত ওদের মতো অন্য শ্রমিকরাতো বটেই, আমরাও অনেকে শুনিনি NIOSH এর নাম। তারা ঠিক করে দেয় মুখোশের স্ট্যান্ডার্ড। সেই স্ট্যান্ডার্ড গুলোর সাথে করোনার দৌলতে আমরা ইদানিং কিছুটা পরিচিত, N95, N99, N100 ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মুখোশ বা রেসপিরেটর গুলির কোনোটাই কিন্তু করোনার মোকাবিলার জন্য তৈরি হয় নি, হয়েছিল সিলিকসিস জাতীয় অসুখ থেকে সুরক্ষা দিতে।
সিলিকা বা SiO2 হল একধনের ক্রিস্টালের মতো মিনারেল যা বলি পাথর কোয়ার্টজ এর মধ্যে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। পাথর খাদানে যারা কাজ করে, যারা নির্মাণ কাজে যুক্ত শ্রমিক তাদের মধ্যে এই সিলিকসিস বেশি দেখা যায়।
১৯৯৯ সালের এক সমীক্ষায় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ দেখেছিল যে আমাদের দেশে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ এর হাই এক্সপোজার হয়, এদের মধ্যে ১.৭ মিলিয়ন খনি বা খাদানে কাজ করা শ্রমিক, ০.৬ মিলিয়ন কাজ করে নন-মেটালিক পণ্য উৎপাদনে যেমন কাচ ও মাইকা, ০.৭ মিলিয়ন হল মেটাল ইন্ডাস্ট্রি। এছাড়াও নির্মাণ কাজে যুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে ৫.৩ মিলিয়ন হাই রিস্ক এক্সপোজারের শিকার।
গোটা দেশেই এই সিলিকসিস রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে আছে কমবেশি। বেশি হল গুজরাট রাজস্থান, পন্ডিচেরি, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও বাংলা। রোগের প্রাদুর্ভাব বিভিন্ন শিল্পে বিভিন্ন হার, অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি তে ৩.৫% থেকে স্লেট-পেনসিল শিল্পে প্রায় ৫৫% অবধি।
ইট পাথর সুরকি কংক্রিট এ থাকা সিলিকা গুঁড়ো গ্রাইন্ডিং, ক্রাসিং, ড্রিলিং এর সময়ে শ্রমিকদের ফুসফুসে ঢোকে। ১০ মাইক্রন বা তার চেয়ে ছোট সাইজের এই কণাগুলি ফুসফুসের একেবারে গভীরে গিয়ে বাসা বাঁধে।
প্রথম চোটে শুরু হয় নিঃশ্বাসের কষ্ট, শুকনো কাশি, জ্বর। এর পরে কনজেস্টিভ হার্ট ফেলিওর, নখের রং নীলচে। রাতে ঘুমাতে কষ্ট, বুকে ব্যাথ্যা। এদের মধ্যে প্রচুর পরিমানে যক্ষা রোগও হয়। ক্রনিক সিলিকসিস হলে গোটা ফুসফুসের বারোটা বেজে যায়।
এই লেখাটা যখন লেখা হচ্ছে সেই মুহূর্তে কোনো এক হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে আছে স্বপন বা সাইদুল। অল্প বয়েস। বাইশ চব্বিশ। মাথার কাছে তার অল্প বয়সী বউ বা বেশি বয়সী মা হয়তো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট। অক্সিজেন চলছে।
স্বপন বা সাইদুল বাঁচবে না। কোনই চিকিৎসা নেই। একমাত্র রাস্তা হল প্রিভেনশন, অসুখ হওয়ার আগে আটকানো। এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত সুরক্ষাবিধি, ব্যক্তিগত ও পরিবেশগত। ইন্ডিয়ান ফ্যাক্টরি আইন, ওয়ারকমেন কম্পেনসেসন আইন এসব থাকলেও তাদের নাগাল খুবই সীমিত এমনকি সংগঠিত ক্ষেত্রেও। আর অসংগঠিত শিল্প শ্রমিকের কথা তো ছেড়েই দেয়া যায়।
এই রোগ নিয়ে গবেষণা, শ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থাকরা এসব নিয়ে ভাববে কে ? রাজনীতির নেতা, পেশাদার, মধ্যবিত্ত ইন্টেলেকচুয়ালদের করোনা হতে পারে, সিলিকসিস নয়। তাই স্বপন বা সাইদুলদের ধুঁকে ধুঁকে মরা ছাড়া গতি নেই। একটা সাইদুল মারা গেলে কাল শাবল হাতে খাদানে আরেকটা স্বপন পাওয়া যাবে, পেটের দায়ে।
একটা স্বপন মারা গেলে আরেকটা সাইদুল পাওয়া যাবে যে মন্দির ভেঙে মসজিদ বা মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরি করবে, তার সাদা মার্বেলের সিঁড়ি গুলো ঘষে ঘষে চকচকে করবে। সেই সিঁড়ি ভেঙে দেশের অগণিত ধর্মপ্রাণ মানুষ উঠবে, নামবে আরাধ্য ঈশ্বরের উপাসনায়।
কেবল ওই সিঁড়ির কোনে লাল ছিটে দাগ দেখলে ওটাকে পানের পিক এর দাগ বলে ভুল করবেন না কেউ। ওটা স্বপন অথবা সাইদুল এর বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা কাশির সাথে মেশানো রক্ত এর দাগ। মন্দির মসজিদ নিয়ে মেতে থাকি করোনা নিয়ে মেতে থাকি চলুন।
দাগ অচ্ছে হ্যায়।
ছবি ঋণ; বর্ণব
সত্যি পড়ি আর ভাবি আমরা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারি। এ লেখাগুলো ভারতের অধিকাংশ মানুষের দিনলিপি।
ক্রমাগত লজ্জায় ডুবে যাচ্ছি।