গ্রামে চাকরি করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি। ভোর বেলা একজন মাঝবয়সী লোককে ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন চারজন মিলে। রোগীর বাড়ির লোকের বক্তব্য স্ট্রোক হয়েছে। রাতে রোগী দিব্যি খাওয়াদাওয়া করে শুয়েছিলেন। ভোরবেলায় আর উঠে বসতে পারছেন না। চোখের পাতা খুলে ভালোভাবে তাকাতে পারছেন না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তার সাথে পেটে ব্যথা আর পাতলা পায়খানা হচ্ছে।
রোগীকে পরীক্ষা করে দেখছি, এর মধ্যে একজন বাড়ির লোক বললেন, ‘মাঝ রাতে একবার রোগী বলেছিল ওকে পায়ে কিছু কামড়েছে।‘
পাশেই এক গ্রুপ ডি দাদা দাঁড়িয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এই হাসপাতালে আছেন। বললেন, ‘এ ডাক্তারবাবু শিওর সাপে কেটেছে?’
সাপে কামড়েছে??? আমি কামড়ের দাগ খুঁজি। সাপ সম্পর্কে তখনও পর্যন্ত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত অল্প। সাহেবদের লেখা বই পড়ে ডাক্তারি দিব্যি পাশ করা যায়। কিন্তু সে সব বইয়ে গ্রামে গঞ্জের অনেক অসুখ বিসুখ উপেক্ষিত।
আমাকে কামড়ের দাগ খুঁজতে দেখে গ্রুপ ডি দাদা বলেন, ‘দাগ নাও পেতে পারেন। কালাচের কামড়ে অনেক সময় কামড়ের ক্ষত বোঝা যায় না। এরকম কেস আমি আগেও দেখেছি।‘
সে রোগীকে তো সাথে সাথে ১০ ভায়াল এ ভি এস (সাপের বিষের প্রতিষেধক), এট্রোপিন, নিওস্টিগমিন চালানো হল। তারপর মহকুমা হাসপাতালে রেফার করা হলো। এবং তিনদিন বাদে রোগী একেবারে সুস্থ হয়ে দেখা করে গেলেন। মুশকিল হলো সে সময় ওই দাদার মতো অভিজ্ঞ কেউ যদি উপস্থিত না থাকতেন, তাহলে নিশ্চিত ভাবে রোগীর মৃত্যু হতো।
যে কোনো গ্রামীণ হাসপাতালে গরমকালে এবং বর্ষাকালে একাধিক সাপে কাটা রোগী প্রতিদিনই ভর্তি হন। তার মধ্যে বেশিরভাগই বিষধর সাপ নয়। এমনকি বিষধর সাপ কামড়ালেও তারা সব সময় বিষ ঢালে না। এবং এসব ক্ষেত্রে এ ভি এস চালানোর দরকার হয় না। মুশকিল হয় সাপ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ একজন সদ্য পাশ করা চিকিৎসক হঠাৎ করে গ্রামে গিয়ে পড়লে।
চন্দ্রবোড়ার মতো হিমাটোটক্সিক সাপের ক্ষেত্রে তাও ২০ মিনিট হোল ব্লাড ক্লটিং টেস্ট করে বিষের উপস্থিতি বোঝা সম্ভব; কিন্তু কালাচ, গোখরো বা কেউটের মতো নিউরোটক্সিক সাপের ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা বা শারীরিক পরীক্ষার উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।
এ ছাড়াও সাপে কামড়ের চিকিৎসার আরেকটি বড় বাধা মানুষের অন্ধবিশ্বাস। প্রথমে ওঝার কাছে বা গুণিনের কাছে গিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট করে তাঁরা রোগীকে হাসপাতালে আনেন। তখন এ ভি এস চালিয়েও রোগীকে বাঁচানো যায় না। সাধারণত বিষাক্ত সাপে কামড়ের প্রথম ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০ ভায়াল এ ভি এস দিতে পারলে সেই রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা খুবই কম।
দীপকদার সাথে পরিচয় বারাসত সিটিজেন ফোরামের দাতব্য চিকিৎসালয়ে। সেখানে আমি মাসে দুবার রোগী দেখতে যাই। মানুষটির সাথে আগেই ফেসবুকে পরিচয় ছিল। উনি ফেসবুকে মাঝে মাঝেই সাপে কামড়ের বিভিন্ন কেস হিষ্ট্রি লিখতেন। আমি পড়ে সমৃদ্ধ ও রোমাঞ্চিত হতাম। সামনা সামনি পরিচয়ের পরে সেই মুগ্ধতা আরও বেড়ে গেল। দীপকদা অসাধারণ সুন্দর গান করেন। অত্যন্ত সাহসী মানুষ। রাজ্যের যেখানেই সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচারের খবর পান দৌড়ে যান। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতা বাড়ানোর জন্য অক্লান্ত ভাবে কাজ করে চলেছেন।
দীপকদাকে ধরেছিলাম সাপের কামড় ও তার প্রতিকার নিয়ে একটা বই লিখতে। আমি তাঁর মতো গুণী মানুষ নই, কিন্তু আমি অক্লান্ত ভাবে প্রায় প্রতিদিনই তাকে তাগাদা দিয়ে গেছি লেখার জন্য। এই বই তাই আমারও বই।
বইটি যাতে সকলের হাতে পৌঁছায় তাঁর জন্য চার ফর্মার বইটির দাম যথাসম্ভব কম করা হয়েছে। বইয়ের দাম মাত্র ৫০ টাকা। আপাতত পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪০ টাকাতেই। একসাথে ১০ এর বেশি কপি নিলে আরও কম দামে দেওয়া সম্ভব। মধ্যমগ্রাম, সোদপুর, বারাসত ও আশপাশের অঞ্চলে কেউ যদি আমাকে ইনবক্স করেন তাহলে বইটি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব কোনো ডেলিভারি খরচ ছাড়াই। হাবড়া অশোকনগর ও আশপাশের অঞ্চলের জন্য দীপকদার সাথে যোগাযোগ করুন। বাকি জায়গায় কিভাবে পাওয়া যাবে পরে জানানো হবে।
প্রত্যেক তরুণ চিকিৎসকের এই বইটি অবশ্যপাঠ্য। বইটিতে অনেক সাপে কাটা রোগীর কেস হিষ্ট্রি রয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে রোগীকে বাঁচানো যায়নি। কেন বাঁচানো যায়নি সেই নিয়েও কাঁটা ছেড়া করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ এবং ছাত্রছাত্রী প্রত্যেকেরই এই বইটি পড়া উচিৎ। আমাদের দেশে বছরে প্রায় ১ লক্ষ লোক মারা যান সাপের কামড়ে। তাদের বেশিরভাগই প্রান্তিক মানুষ। প্রান্তিক মানুষের জীবন নিয়ে সরকার বিশেষ মাথা ঘামায় না, কর্পোরেট হাউসগুলি মাথা ঘামায় না, মিডিয়া মাথা ঘামায় না। তাই এই মৃত্যু নিয়ে তেমন হইচই নেই। কিন্তু সাপের কামড়ে যারা মারা যান তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নবিত্ত পরিবারটির প্রধান উপার্জন ক্ষম ব্যক্তি। এবং সবাই মিলে চেষ্টা করলেই এই মৃত্যু মিছিল আটকানো সম্ভব।