শুরুর কথা
“সাপ” নামটার সাথে ভূত নামটির অদ্ভুত মিল। দুটি নাম শুনলেই কেউ ‘রামনাম’ কেউ ‘আস্থিক মুনি’ বলে জীবনের রক্ষাকবচ হিসেবে শব্দ দুটিকে বহন করে চলেছেন।অথচ ‘ভূত’ শব্দটি একটি কাল্পনিক আর ‘সাপ’ বাস্তব চরিত্র।দুটি শব্দের সাথে মানুষের মননে জড়িয়ে আছে ভয় নামক অদ্ভুত শব্দটা।
ছোট বেলা থেকেই সাপ শব্দটির নানান রোমহষর্ক গল্প শুনতে শুনতে আমার মনে হয় ভূতেরাও আজ সাপের কথা শুনলে বাঞ্ছারামের বাগান ছেড়ে শিবপুর কলেজে গিয়ে আশ্রয় নেবে।জানি যেখানে অন্ধকার সেখানেই বিরাজমান ভূতের প্রকট। আর মানুষের জ্ঞানের আলোতে ভূতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
দাদাগিরির ভুত দাদাগিরিতেই চলে বাস্তবে মানুষের কল্পনার ভুত শুধুমাত্র থাকে গল্প। ভূতের চাষ মানুষের অজ্ঞতায়, কিন্তু সাপ নামক ভূত এটা বাস্তব। যেখানে অজ্ঞতা,ভয়,ভীতি, ভুল ধারণা, ওঝা গুনিন, ঝাড়ফুঁক তুকতাক, সেখানেই জম্ম নেয় মানুষের শত্রু ‘সাপ’।
আসলে সাপ নয় কুসংস্কার আমাদের শত্রু। এই বোধ যতদিন আমাদের মননে গড়ে না উঠছে ততদিন সাপ নিয়ে আমাদের ভয়,ভীতি চলতেই থাকবে। যেমন ভাবে ভূতের ভয় দেখানো হয়। জানিনা ভূতেদেরও মধ্যে শ্রেণীবিভাগ আছে কিনা। আজ অবধি শুনিনি, গরু ভূত, ছাগল ভূত, সাপ ভূত ইত্যাদি। তবে রাতের বেলা যে এখনো অনেকেই সাপের নাম শুনলেই আৎকে ওঠেন এতে ভূতেদেরও ঈর্ষা হবারই কথা।
আসলে সাপ নিয়ে প্রকৃত সঠিক ধারণাগুলো সহজ সরল ভাষায় গল্পের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা এটা বড়ই অভাব।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে ভাবে সাপের কামড়ে গ্রামেগঞ্জে মৃত্যুর মিছিল বয়ে চলছে এখনও যদি আমরা সচেষ্ট না হই তবে আগামীদিনে সাপ এবং মানুষের অবস্থা ভূতের ভবিষ্যৎ-এর মতোই দেখা দেবে।
‘চন্দ্রবোড়া’ নাম শুনলেই যেনো ভূত দেখার অবস্থা–
সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে এসেও আমাদের রাজ্যে বেশ কিছু অঞ্চলে গত কয়েক বছরে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটছে এটা বাস্তব। প্রশ্ন উঠছে তামিলনাড়ু থেকে তৈরী সাপ কামড়ের ওষুধ আমাদের রাজ্যের বিষধর সাপের কামড়ে আদৌও কাজ করছে কিনা। সম্প্রতি চন্দ্রবোড়ার কামড়ে এক বিজ্ঞান কর্মীর মৃত্যু সাধারণ মানুষের কাছে এই সাপটিকে ঘিরে যেমন আতঙ্ক, ভয় আরও প্রকটভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি একই সাথে তামিলনাড়ু থেকে আসা সাপ কামড়ের ওষুধের গুণমান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বেশ কয়েকটি জেলা জুড়ে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মৃত্যু, বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছে। কয়েকদিন আগে চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মেদিনীপুরের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের মৃত্যুও প্রশ্নচিহ্ন উঁকি দেয় ভিন রাজ্যের থেকে আসা সাপ কামড়ের ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে।
ইদানিং এই সাপটিকে ঘিরে আতঙ্ক আমাদের রাজ্য জুড়ে সবত্র। কারও বাড়ির কাছে বাগানে, পাশের জঙ্গলে, এই সাপটিকে দেখলেই ফোন করে জানাচ্ছেন কি করবেন। আগে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লে জানাতেন এখন সাপটিকে দেখলেই ভয়ে আৎকে উঠছেন। বাঁকুড়া জেলার গ্রামের কৃষকরা অনেকেই মাঠে ঘাটে যেতে ভয় পাচ্ছেন। পাশাপাশি এই সাপটিকে দেখলেই মেরে ফেলার প্রবণতাও মানুষের মধ্যে প্রবলভাবে জেগে উঠছে। সবাই যেনো চন্দ্রবোড়ার ভূত দেখছেন।
এমতাবস্থায় কী করণীয়–
প্রথমত সাপ বিষয়ে মানুষকে সঠিক শিক্ষা দান। যা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম, সোশাল মিডিয়া, সরকারি টিভি চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত সাপ নিয়ে অহেতুক আতঙ্ক দুর করার জন্য সচেতনতা মুলক অনুষ্ঠান।
দ্বিতীয়ত আমাদের রাজ্যেরই বিষধর সাপের বিষ সংগ্রহ করে এ রাজ্যেই সাপের বিষের ওষুধ তৈরী করা। সোজা কথায় যে বেঙ্গল কেমিক্যাল ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে গেছে তাকে পুনরায় চালুকরা বা অনত্র এই রাজ্যেই সাপের বিষের ওষুধ তৈরীর জন্য নতুন বেঙ্গলকেমিক্যাল স্থাপন করা। যতদুর জানি বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে বিষ সংগ্রহ কেন্দ্র তৈরী করার প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া আছে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে।
বিষধর চন্দ্রবোড়া নিয়ে দু’ একটি কথা–
সাপটি এক নজরে একবার দেখলেই চিনে নেওয়া সহজ। দেহ মোটাসোটা এবং ভারি লেজের দিকটা হঠাৎ সরু হয়ে গেছে। পিঠের দিকটা হলদে বাদামী বা মেটে হলুদ। মাথাটি ত্রিভুজাকৃতি ও গলা সরু। পিঠের উপর তিন সারি গোল গোল কালো বা বাদামী ছোপ থাকে। পিঠে শিকলের মতো এই দাগের জন্য ইংরেজিতে ‘চেইন ভাইপার’ও বলে।
বাহারী সাপ এই চন্দ্রবোড়া। ভাইপেরিডি গোত্রের এই সাপটিকে ইংরেজিতে বলে ‘রাসেল ভাইপার ‘। ১৭৯৬ খিস্টাব্দে ডঃ পি. রাসেল প্রথম চন্দ্রবোড়া সম্মন্ধে বিস্তৃত বিবরণ দেন। তাঁরই নাম অনুসারে চন্দ্রবোড়াকে ‘রাসেল ভাইপার’ বলে। ৪২ মিলিগ্রাম বিষ একটি মানুষের মৃত্যুর পক্ষে যথেষ্ট। সাধারণত চন্দ্রবোড়া ৫ মিলিগ্রাম থেকে ১৮০ মিলিগ্রাম একবার কামড়ে বিষ ঢালতে পারে।
সাধারণত চন্দ্রবোড়ার কামড়ে যে উপসর্গ বা লক্ষণ গুলো দেখা যায়:-
- কামড়ানোর দশ মিনিটের মধ্যে দংশন স্থানে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয়।
- ক্ষতস্থান ফুলে যায়।
- যতদেরি হবে ফোলা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
- আস্তে আস্তে এই ফোলা দেহের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
- জিভে আড়ষ্ট ভাব এর ফলে খাবারের কোনো স্বাদ বোঝা যায় না।
- চন্দ্রবোড়ার কামড়েও পেট ব্যথা, বমির ভাব, সারা শরীর ভারি মতো মনে হয়।
- যত দেরি হবে দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। যেমন চামড়ার নিচে, পুরোনো ক্ষতস্থান থেকে,নাক, কান, মুত্রনালি, মুখ থেকে থুতু ও বমির সাথে।
- আরো দেরি হলে প্রস্রাবের সাথে রক্তক্ষরণ হয়। এবং চোখের সাদা অংশেও রক্ত লক্ষ করা যায়।
- ক্ষতস্থানের স্বাভাবিক চামড়ার রং কালচে মত হয়ে যায়।
- ক্ষতস্থানের পাশে ফোস্কা মতো পড়ে যতদেরি হবে ফোস্কা তত আরো বিস্তৃত হয়।
ডায়ালিসিস – এর প্রয়োজন কখন —
চন্দ্রবোড়ার বিষ যেহেতু হেমোটক্সিন মানব দেহের শরীরের রক্ত তঞ্চনটাকে নষ্ট করে দেয় সেকারণে সময়মতো এই সাপের বিষে চিকিৎসা শুরু না হলে ভীষণ ভাবে কিডনি দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে এ,ভি,এস, দিয়ে চন্দ্রবোড়ার বিষ থেকে মুক্ত হলেও মুত্রথলি থেকে রক্ত বের হওয়ার কারণে ডায়ালিসিসের জন্য রোগীকে অনত্র রেফার করা হয়। সাধারণত দেখা গেছে এই সাপ কামড়ানোর এক ঘন্টার মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা শুরু হলে রোগীর ডায়ালিসিসের প্রয়োজন পড়ে না। প্রকৃত সত্য আরো বড় নির্মম অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অপুষ্টি, শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা এই বিষয়গুলোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই বিষধর সাপের কামড়ে দুটি ভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে আলাদা রকমের শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যেতেই পারে।
20 WBCT রক্ত পরীক্ষা আসলে কি —
WBCT কথাটি হলো Whole blood clotting test. মানব শরীর থেকে কিছুটা রক্ত টেনে নিয়ে বিশুদ্ধ টেস্ট টিউবে ২০ মিনিট রাখার পর যদি দেখা যায় রক্ত জমাট বাধেনি তাহলে ধরে নিতে হবে যে রক্তে হোমোটক্সিন বিষ আছে। আর জমাট বেধে গেলে বুঝতে হবে এই বিষের লক্ষণ নেই। নিউরোটক্সিন বিষের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষায় কোনো লাভ নেই এই নার্ভ বিষের ক্ষেত্রে শারীরিক লক্ষণ – উপসর্গ দেখেই চিকিৎসক নিশ্চিত হন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চন্দ্রবোড়ার কামড়ে অনেকক্ষেত্রে কামড়ানোর কিছু পরেই এই পরীক্ষায় সঠিক ফল পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় বারের পরীক্ষায় দেখা গেলো রক্তে হেমোটক্সিন বিষের লক্ষণ আছে।
উপসংহার–
আমরা জানি সাপের বিষের একমাত্র ওষুধ এভিএস তৈরী হয়, ঘোড়ার শরীরে একটু একটু করে সাপের বিষ ইনজেকশন দিয়ে। যে সাপের বিষ ইনজেকশন দেওয়া হয় তার প্রতিষেধক তৈরী হয় ঘোড়ার রক্তে। আমাদের দেশের সাপের বিষ ইনজেকশন দিয়ে এ দেশের মুলত চারটে সাপের বিষের ওষুধ এভিএস তৈরী হয়। গোখরো, কেউটে কালাচ,চন্দ্রবোড়া। রাজস্থান, গুজরাটে চন্দ্রবোড়া পাওয়া যায়না ওখানে আছে ফুরসা। কিন্তু এই দুটি সাপের বিষের প্রকৃতি এক। জেনে রাখুন অষ্ট্রেলিয়া বা জাপানের তৈরী সাপের বিষের ওষুধ এভিএস কিন্তু আমাদের দেশে অচল।
ঠিক একই ভাবে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালের পর থেকে আমাদের রাজ্যে তামিলনাড়ুর সাপের বিষ দিয়ে তৈরী যে এভিএস প্রস্তুত হয় তা এই বাংলার সাপের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রে। কিছু ক্ষেত্রে কোবরা প্রজাতির সাপের বিষেরও একই চিত্র। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করেও রোগীকে বাঁচানো যাচ্ছে না। সোজা কথায় বলা ভালো বর্তমান এভিএস প্রায় কাজই করছে না। এই বিষয়ে ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকরা সাবধান করছেন যে,ভারতে অন্তত তিন – চারটি রিজিওনাল ভেনাম কালেকশন সেন্টার হওয়া উচিত। ২০১৭ সাল থেকে, এ নিয়ে ডাক্তার দয়াল বন্ধু মজুমদার, যুক্তিবাদী সমিতি সহ বেশ কিছু সচেতন মানুষ চিঠি চাপাটি দিয়েছেন সরকারের কাছে এমনকি ব্যক্তিগত ভাবে ডাক্তার দয়াল বন্ধু মজুমদার নিজে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের বিষ সংগ্রহ কেন্দ্র করার প্রস্তাব হিসেবে। ডাক্তার মজুমদার সহ এই বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসক অনেকেই লিখিত আকারে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে প্রতিলিপি জমা দিয়েছেন। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় সেই প্রস্তাবটি এখনো স্বাস্থ্যদপ্তরের প্রধান সচিবের কাছে পড়ে আছে। জানিনা কোন ভূতের ভয়ে প্রস্তাবটি অন্ধকারে নিদ্রায়।