এই লেখা শুরু করব একটা গল্প দিয়ে। এটা কারও কারও মজার বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে মোটেই মজার গল্প নয়।
কয়েক মাস আগে বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক এসেছিলেন এসেছেন চেম্বারে। তিনি বছর খানেক আগে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ককসিক্স বা Tail bone এর সমস্যা। বসতে গেলে নিতম্বে ব্যথা হয়। সাইকেল বা মোটরবাইক চড়তে খুব অসুবিধা হয়। ভীষণ বিরক্তিকর বিষয়।
সাধারণ কিছু চিকিৎসা বললাম।
‘ওসব করা হয়ে গেছে।’
‘গরম জলের সেঁক করুন।’
‘সব করা হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু, ব্যথা কমছে না। আপনি ওটিতে নিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিন।’
‘সব মানে? আর কি করেছেন?’
রোগীর স্ত্রী মাথা নীচু করে বললেন, ‘চুন-হলুদ গরম করে লাগিয়েছি।’
‘অ্যাঁ? ওখানে? পুড়ে যায় নি?’
ভদ্রলোক প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, ‘গেছিলো তো!’
গ্রাম্য মানুষ,যাদের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসার পরিকাঠামো তত সহজলভ্য নয় বা যাদের কাছে প্রাথমিক শুশ্রূষার ধারণা থাকে না, তারা তো বটেই। এমনকি দলে দলে তথাকথিত শিক্ষিত ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ-ও চোট লাগলে সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক শুশ্রূষা কিভাবে করতে হয় তা জানে না। তার একটা কারণ কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রাথমিক শুশ্রূষার বিষয়টা বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অনুপস্থিত ছিল। আর এখনও সিলেবাসের নানান প্রতিযোগিতামূলক বিষয়ের চাপে জীবনবোধের সাথে সম্পর্কিত এই পাঠটি চূড়ান্ত অবহেলিত হয়।
কলেজে সদ্য চাকরি পাওয়া তরুণী সহকারী অধ্যাপিকা স্কুটি চালাতে গিয়ে পা মচকেছেন। মারাত্মক ফোলা গোড়ালি নিয়ে হুইলচেয়ারে চড়ে চেম্বারে ঢুকছেন। পায়ের চামড়া পুরো হলুদ।
‘এটা কি লাগিয়েছেন?’
‘চুন-হলুদ।’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু লাগিয়েছেন কেন?’
‘সবাই তো বলে…’
‘সবাই মানে? কে বলে?’
‘মা, মাসি, বাড়ির বড়রা।’
‘বড়দের কথা আপনি সব শোনেন?’
তিনি আর জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকেন।
মাসি-পিসি, ঠাকুমা-দিদিমাদের কথা লোকে এত শোনে এবং বিনা প্রশ্নে বাধ্য ছেলেমেয়ের মত মেনে নেয়- ডাক্তারি পেশায় ঢোকার আগে এ আমার জানা ছিল না।
ক্ষত নিরাময়ে হলুদের সামান্য কিছু ভূমিকা থাকলেও চোট, ফোলা, ব্যথা, ক্ষত- সব ক্ষেত্রে চুন অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এটি ক্ষারজাতীয় পদার্থ। তাই শুকনো চুন বা চুনের জল- দুই-ই ত্বকে রাসায়নিক দহন করতে পারে। এতে ত্বক ফুলে যায়, লাল হয়ে যায়, চাকা চাকা র্যাশ বা ফোস্কা পড়তে পারে। টিস্যু-র প্রদাহ বেড়ে যায় এবং ক্ষত নিরাময়ে দেরী হয়। চোট লাগার অব্যবহিত পরে আহত অঙ্গে যে ফোলা ও ব্যথা হয়- চুন তাতে সন্দেহাতীতভাবে পরিস্থিতি আরো খারাপ করে দেয়।
অবশ্য হলুদ অতটা খারাপ নয়। হলুদে ‘কার্কিউমিন’ থাকে। এই ‘কার্কিউমিন’ প্রদাহ এবং অক্সিডেশন কমিয়ে ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে। এটি ত্বকের ক্ষতগুলিতে শরীরের প্রতিক্রিয়া কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে টিস্যুতে কোলাজেন তৈরীতে হলুদ সাহায্য করতে পারে।তবে সে সবই দীর্ঘকালীন প্রভাব। চোট লাগার অব্যবহিত পরে এর কি গুরুত্ব জানা নেই।
স্বভাবতঃই চুন ও হলুদ- এই দুই রাসায়নিক বস্তু মিশিয়ে গরম করে চোট পাওয়া অংশে লাগালে ফোলা বা ব্যথা কমার সম্ভাবনা তো নেই-ই – বরং এতে ত্বক এবং ত্বকের নীচের টিস্যু ক্ষতি হওয়া, ফোলা বেড়ে যাওয়া, র্যাশ বা ফোস্কা পড়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
ফ্র্যাকচার, হাড় সরে যাওয়া বা লিগামেন্টে চোট থাকলে তার উপরে যদি র্যাশ বা ফোস্কা পড়ে তবে চিকিৎসা করা দূরূহ হয়ে পড়ে। প্লাষ্টার বা অপারেশন প্রয়োজন হলেও কোনটাই তক্ষুণি করা যায় না। ত্বক,মাংসপেশী ও অন্যান্য টিস্যুর ক্ষত, ফোস্কা বা র্যাশ যতক্ষণ না নিরাময় হচ্ছে ততক্ষণ হাড়ের চিকিৎসা আটকে থাকে। চিকিৎসা দেরীতে শুরু হওয়ার জন্য নানান জটিলতা তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে হাড়ের চিকিৎসা- সে প্লাষ্টার বা অপারেশন যাই হোক- তার ফলাফল অনেক সময়ই ভালো হয় না।
সুতরাং, শরীরে চোট লাগলে কখনই চুন-হলুদ লাগাবেন না। এতে কোনো রকম সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা তো নেই-ই, বরং ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা একশ শতাংশ।
চোট লাগলে প্রথম ৪৮ ঘন্টা সেখানে ভালো করে বরফ লাগান। প্রথম প্রথম দু-তিন ঘন্টা অন্তর অন্তর ১৫-২০ মিনিট করে। তবে বরফ সরাসরি ত্বকে ঘষবেন না। পাতলা প্লাষ্টিক প্যাকেটের মধ্যে ভরে অথবা রুমাল বা অন্য কাপড় জড়িয়ে নিন। আইস প্যাক বা আইস ব্যাগ থাকলে আরো ভাল হয়।
চোট লেগে হাত বা পা ভেঙে গেছে মনে হলে আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গকে স্প্লিন্ট বা স্লিং-এর সাহায্যে সাপোর্ট দিয়ে রোগীকে হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া দরকার- যাতে রোগীর যন্ত্রণা কমে এবং চোট থেকে চিকিৎসা শুরু পর্যন্ত আর কোনো ক্ষতি না হয়।