অনেকেই খুব সহজভাবে বলেন আমরা যেহেতু প্রাণী তাই ভোজন আর ওটির জন্যই মূলত বেঁচে আছি। কথাটা লঘু হলেও মিথ্যে নয়। স্টেশনে যে বাচ্চাগুলো অ্যালুমিনিয়ামের থালা বাজিয়ে ভিক্ষে করে তারা যখন বলে, “দশটা টাকা দাও, ভাত খাব।” অথবা শিয়ালদা স্টেশনের পাশে বিদ্যাপতি সেতুর নিচে ড্রেনের ওপর বেঞ্চ পেতে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের পাশে যারা উদয়াস্ত পুরি-সবজি বিক্রি করে, তাদের কষ্ট দেখে এক বন্ধু যেমন বলেছিল, “শুধু একটু খাওয়ার জন্য এত পরিশ্রম বুঝলে। এদের জীবনে আর কিছুই নেই।” তখন মনে হয় এরা সত্যি কথাই বলছে। সারা ঋকবেদে যত ঋক্ আছে তাদের অনেকগুলোতেই খাদ্যের জন্য প্রার্থনা আছে। শুধু ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি নয় সরস্বতী, পুষা, রুদ্র প্রমূখ দ্বিতীয় সারির দেবতাদের কাছেও খাদ্যের জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। ঋকবেদে অন্নকে দেবতা বলা হয়েছে। সুতরাং খাদ্যের জন্য আমাদের যে আর্তি তা নতুন নয়। অনাদিকাল থেকেই চলে আসছে।
সময়ের সাথে সাথে সেই খাদ্যের অনেক বিবর্তন হয়েছে। যত দিন গেছে খাদ্য তত আন্তর্জাতিক ও বাজারি অর্থনীতির ভিত্তি হয়ে উঠেছে। আমি ‘বাংলার বিরিয়ানিনগরী’ ব্যারাকপুরের বাসিন্দা এই কথাটা ফেবুতে অনেকবারই বলেছি। শক্তিগড় যেমন ল্যাংচা, মালদা যেমন কানসাট, কৃষ্ণনগর যেমন সরভাজা, বনগাঁ যেমন চোলাইয়ের জন্য বিখ্যাত আমাদের ব্যারাকপু্রও তেমন বিরিয়ানির জন্য খ্যাত। কিভাবে গুচি বা অ্যাডিডাস ছোট কোম্পানি থেকে বিলিয়ন ডলারের ব্র্যান্ড হয়েছে আমি তা শুনেছি। দেখি নি। কিন্তু কিভাবে ‘দাদা বৌদি বিরিয়ানি’ ড্রেনের পাশের একটা পুঁতিগন্ধ ছড়ানো দোকান থেকে আজ বাংলার ব্র্যান্ড হতে চলেছে তা আমি জন্মলগ্ন থেকেই দেখেছি। মালদায়, শিলিগুড়িতে, সোদপুরে, কলকাতায় দাদা বৌদির নামে দোকান দেখেছি। সেদিন পুরুলিয়া থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যেয় আদ্রা স্টেশনে ক্ষুধার তাড়নায় ‘দাদা বৌদির বিরিয়ানি’ নামের এক দোকানে অখাদ্য বিরিয়ানি খেলাম। আমি নিজে যদিও বিরিয়ানি বিরোধী এবং একদিন মাত্র ব্যারাকপুরের দাদা বৌদি খেয়েছি, তবু স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে অরিজিনাল বা ‘আদি’ দাদা বউদির স্বাদের কোনো ভাগ হবে না।
ক্ষুধা থেকে বিরিয়ানি এল আর বিরিয়ানি থেকে এসে পড়ছে ডায়েট চার্ট। আজ সকালে দই-মুড়ি-আম মেখে খাবার সময় দুই চামচ চিনি নিতেই বউ রসিকতা করে বলল, “তুমি ডাক্তার হয়ে চিনি খাচ্ছ? আর আমাদের স্কুলের সবাই চিনি ছেড়ে ব্রাউন সুগার, জ্যাগারি এসবে চলে যাচ্ছে”। একথা মিথ্যে নয়। অনেক পন্ডিতেরাই বলেছেন যেদিন থেকে মানুষ শিকার ছেড়ে কৃষিকাজ ও পশুপালনের দিকে ঝুঁকেছে সেদিন থেকেই তার স্বাস্থ্যের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। আর যেদিন থেকে সে চিনি খাওয়া শুরু করেছে সেদিন থেকে তার দাঁত ও পরিপাকযন্ত্রের দুর্দশার সূত্রপাত। আসলে মিষ্টি আমাদের ব্রেনের প্লেজার সেন্টারের ওপর কাজ করে। তাই কারো কারো মিষ্টির ওপর অমন ভয়ঙ্কর লোভ থাকে। আমি নিজে যদিও একেবারেই সেই দলে পড়ি না। তবে কিছু কিছু ডায়াবেটিক পেশেন্টরা সুগার কমে যাবার পরে যখন মিনতির সাথে বলে, “ডাক্তারবাবু, এবার কি চায়ের সাথে একবার সকালে চিনি খাওয়া যাবে?” তখন তাদের প্রতি সত্যিই মমতা হয়।
এই যে সারা গরমকাল গেল সবাই মুখে স্বীকার না করলেও লোভে পড়ে অনেক আম-কাঁঠাল খেয়ে সুগার বাড়িয়ে নিয়ে আসবেন- এটা প্রায় সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৪০০ ক্যালোরি, ১৬০০ ক্যালোরি ডায়েট চার্ট দেওয়াই সার, খুব কম লোকই সেসব মেনে চলেন। রুগিদের যত বেশি নিয়মের বাঁধনে বাঁধতে যাবেন তারা তত বেশি বেঁকে বসে। তাই ডাক্তার হিসেবে আমি সব সময় একটা ‘মঝাঝিম’ বা মধ্যপন্থা নিয়ে চলি। থাইরয়েডের রুগি কী খাবেন না তাও না হয় বলা যায় কিন্তু ইউরিক অ্যাসিড যাদের বেড়ে গেছে তারা কী খাবেন না তা বলা খুব কঠিন। কারণ ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমাটো, বীনস, সীম, ভেন্ডি, পটল, মুসুর ডাল, সোয়াবিন, মাটন, চিকেন, সামুদ্রিক মাছ মায় ইলিশ সব খেলেই ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে। আদপে এমন কিছু সবজি নেই যা খেলে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে না। তাই রুগিদের বলি সবই খাবেন তবে কম করে খাবেন।
সবচেয়ে সমস্যা হয় কিডনির সমস্যায় ভোগা রুগিদের নিয়ে। তারা প্রায় কিছুই খেতে পারেন না। শাক খাবেন না। কুচো মাছ খাবেন না। পটল ভেন্ডি খেলে বিচি ফেলে খাবেন। বড় মাছ, সামুদ্রিক মাছ, মাংস খাবেন না। ফল পারতপক্ষে খাবেন না। পাকা পেঁপে কয়েক টুকরো খেতে পারেন। ডিমের শুধু সাদাটা খাবেন। দুধ-দই-ছানার মধ্যে যে কোনো একটা পরিমাণে অল্প খাবেন। এতসব বলার পর সত্যিই মনে হয় উনি খাবেনটা কী? আমার এক ডাক্তার দাদা আছেন যিনি একই সাথে সুগার ও কিডনির সমস্যায় ভুগছেন। তিনি সেদিন ফোনে দুঃখ করে বললেন, “কিছুই খেতে পারি না রে! আগে যখন খাবার সামর্থ্য ছিল না তখন ইচ্ছে থাকলেও খেতে পারতাম না। আজ চারপাশে এত খাবার অথচ খেতে পারি না”
এ তো গেল একদল মানুষের কথা যারা খাবার ইচ্ছে থাকলেও খেতে পারছেন না, অন্য একদল আছেন যাদের খিদেই চলে গেছে। খেতে হয় তাই খান। সুগারের ওষুধগুলোর প্রধান কাজই হল তারা খাবার ইচ্ছে নষ্ট করে দ্যায়। তাই ডায়াবিটিসের রুগিদের প্রধান অভিযোগই হল যে ওনারা একদম খেতে পারছেন না। এ অবস্থায় ডাক্তারবাবুরও কিছু করার নেই। কারন খিদে বাড়াতে হলে ওষুধই বন্ধ করে দিতে হয়। তা তো আর সম্ভব নয়। আর আমাদের বাংলায় জনসংখ্যার বিরাট এক অংশ তো আছেনই যারা গ্যাসের সমস্যায় অথবা আই.বি.এস.-র সমস্যায় ভুগছেন। তাদের পেটে কিছুই সহ্য হয় না। কিছু খেলেই পেট ফুলে যায় বা টয়লেটে যেতে হয়। আমরা বাঙালিদের যতই পেটরোগা বলে গালমন্দ করি না কেন, যারা এইসব অসুখে ভোগেন তাদের সারা জীবনব্যাপী এই কষ্টটা তো সহ্য করতেই হয়। কোথাও গিয়েই শান্তি না পেয়ে তারা বারেবারে বহু টাকার পরীক্ষা এবং বারেবারে ডাক্তার বদল করেন।
বিরিয়ানির কথা বললাম বটে তবে আজকের দিনে বিরিয়ানি ছাড়াও অন্য বিলিতি খাবারের কোনো অভাব আমাদের দেশে নেই। ভোজন এখন আন্তর্জাতিক বাজারের অন্তর্গত। আপনাকে শুধু জোমাটো বা সুইগিতে একটা অর্ডার দিতে হবে। জোমাটোর মত কোম্পানি যারা শুধু খাবারদাবার সরবরাহ করত তারা ব্যবসায় বিপুল ক্ষতির মুখ দেখার পরে গত দুটো কোয়ার্টারে বিপুল লাভের মুখ দেখেছে। আমার মত যারা জোমাটোর শেয়ার কিনেছেন তারা জানেন জোমাটো এখন মার্কেট ক্যাপে অনেক বড় বড় কোম্পানিকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। আপনি বলতেই পারেন যে এটা আমার স্ববিরোধিতা। আমি যেখানে বিরিয়ানি, পিৎজা খাবার বিরুদ্ধে কথা বলছি অন্যদিকে আমি নিজেই জোমাটোর শেয়ার কিনে অর্থোপার্জনের চেষ্টা করছি। সেটা ঠিকই কিন্তু তবুও আমি বলব শেয়ারে আমার লাভের গুড় না হয় পিঁপড়েয় খাক আপনি বরং ওইসব হাই-ক্যালোরি বিদেশি খাওয়া-দাওয়া থেকে দূরে থাকুন।
আপনি কি আর শুনবেন? কেউ কি শোনে? শেখ হাসিনার গণভবনের বাড়িতে ঢুকে যে ছেলেটি তার দুপুরের জন্য রান্না করা চিকেন কবজি ডুবিয়ে খেতে খেতে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়েছে তার বন্ধুরা তাকে হয়ত নাই করেছিল অমন করতে। যা হোক এতদিন আন্দোলন করে, সকাল থেকে হয়ত না খেয়ে ঢাকার রাস্তায় হেঁটে তার খিদে পেয়েছিল প্রচন্ড। আমি তাই তাকে দোষ দিই না। কিন্তু যে ছেলেটি শেখ হাসিনার অন্তর্বাস নিয়ে ছবি শেয়ার করছে সেটা অশোভন। আজ যারা তার শাড়ি-ব্লাউজ নিয়ে বীরত্বের সাথে পালাচ্ছেন তারা যদি ছিয়াত্তর বয়স্ক প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গভবনে জীবন্ত পেতেন তবে কী করতেন সহজেই অনুমেয়। স্বৈরাচারীদের পতন হলে কী দশা হয় আমরা জানি। আমরা গদ্দাফিকে দেখেছি, সাদ্দামকে দেখেছি, অনেক আগে মুসোলিনির খবর শুনেছি। মৃত্যুভয় সবার আছে। আমার সুযোগ আর ক্ষমতা থাকলে আমিও ওই অবস্থায় পালাতাম।
তবে ভোজন থেকে আমাদের পালাবার উপায় নেই। সে আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। আমি নিজে একদম এসব বিদেশি খাবারের বিরোধী। আমি স্প্যাগেটি, কর্ন ফ্লেক্স, ওটস, পিৎজা, বিরিয়ানি, চাইনিজ এসবের বিপক্ষে। আমার সব সময় মনে হয় সব কিছুর মত আমাদের পেটেরও একটা নিজস্ব ইতিহাস ও জেনেটিক্স আছে। সেটা হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হয়েছে। ভারতে এই বঙ্গভূমির অস্ট্রিক আদিবাসীরাই প্রথম ধান চাষ করে, মাছ ধরে, পান-সুপুরি খায়। আমাদের পেটের জিনে সেই ইতিহাসই লেখা আছে। তাকে একদিনে বদল করা অসম্ভব। তাই যিনি রেস্টোর্যান্টের বাহারি খাবার হজম করতে না পেরে বন্ধুদের কাছে বেইজ্জত হন তার একদম লজ্জার কারণ নেই। তাদের জিনে হয়ত মিউটেশন হয়ে গেছে। আপনার এখনো হয় নি। যতদিন না হয় ততদিন না হয় এসব থেকে দূরেই থাকুন।