“কেবল একটি পাথরের টবে হৃৎপিণ্ড যত্নে রেখেছি
তুমি এসে দাঁড়ালেই সে ফুটে উঠবে”–জাহাঙ্গীর আবেদিন
ওয়ার্ডের ভেতরটা বয়লারের মতো ভ্যাপসা। নবনীতাদি বসে বসে খাতায় ডাক্তারের অর্ডার তুলছে। এরপর লিনেন ইন্ডেন্ট করা। ওষুধ। সোমা একবার পারা-চটা আয়নায় ঝাপসা মুখটা দেখে নবনীতাদির পাশে গিয়ে বসে।
“নবাদি, ডিহাইড্রেটেড বাচ্চাটার ড্রিপ চালানো গ্যালো না……একদম ডিহাইড্রেটেড…..স্কিন পর্যন্ত কাপড়ের মতো হয়ে গেছে… কুশলস্যর (আরএমও) এখনও চেষ্টা করছে…এবার খেয়ে নিয়ে…তুমি ওয়ার্ডে যাও…আমি খাতায় ডায়েট ফায়েট তুলছি” নবনীতা একবার সরু পুরোনো হাতঘড়িটা দ্যাখে। রাত বারোটা দশ।
“হ্যাঁ, রাত হলো, তুই খেয়ে এসেছিস?”
সোমা ঘাড় কাত করে। নবাদি উঠে গেলে সোমা একবার মোবাইলটা খুলে মেসেঞ্জার দ্যাখে।একজন লিখেছে “তোমার হরিণ চোখ দেখে আমি ফিদা। অপেক্ষায় আছি। সারা জীবনের।”
(দেখেছো কি বিরামহীন রাত্রি জাগরণে, চোখের তলায় কুঞ্চিত রেখারা চিহ্ন রেখে যায়)
সোমার বয়স আঠাশ। অবশ্যই অবিবাহিত। গোলাপী স্কুটিতে হাসপাতালে আসে। তাই দৃষ্টি আকর্ষক। “পরে, সব কাজ শেষ হলে উত্তর দেবো” সোমা ভাবে
জীবনের ঘোড়া ছুটে চলেছে, দেখো কোথায় থামে; না হাতে আছে লাগাম, না পা আছে রেকাবে|–গালিব, সৈয়দ মুজতবা আলী। বালিকা কাজ কবে শেষ হয়?)।
নবাদি (আমরাও নবাদি বলে ডাকবো) ইঞ্জেকশন, ড্রিপ সব ঠিক করে এসে বসলো-তখন ভোর হয় হয়। ওয়ার্ডের ভেতরে রাত দিন বোঝা দুষ্কর। সব সময়ই-ওষুধ পূঁজ রক্ত পূরিষের সঙ্গে গরীবের গায়ের বোঁটকা গন্ধ। সব সময়েই আলো জ্বলে। শিশু কান্নার শব্দ ছাপিয়ে মায়েদের কান্নার শব্দ ওঠে-মাঝে মাঝে।
“খাতায় সব তুলেছিস?”
“হ্যাঁ, কয়েকটা ডায়েট বেশী তুলেছি” (বাচ্চাদের ওয়ার্ডে অনেক মায়ের খাবার আসে না বাড়ি থেকে, এই ছাতা পড়া বাসি পাঁউরুটি, ফ্যান মেশানো ডাল-আহা সে অমৃত-যত সব হাঘরের কাছে)।
“ঠিক আছে”
একটু পরে কুশল এসে বসে। হাত তুলে জল খাওয়ার ভঙ্গি করে। সোমা জলের বোতল এগিয়ে দ্যায়।
“খেয়েছেন?” সোমা প্রশ্ন করে।
কুশল এড়িয়ে যায়। “নবাদি ড্রিপ চালাতে পারলাম না- ভেইন পেলাম না”
নবাদি চিন্তিত মুখে চেয়ে থাকেন। সোমা ওয়ার্ড দেখতে চলে যায়। নবাদি পিছু ডাকেন “সোমা, একটু আদিত্যদাকে ডেকে দিয়ে যা তো….”
সোমা সবাইকার অক্সিজেন, স্যালাইন দেখে’ ইঞ্জেকশন বাকিগুলো দিয়ে যখন ফেরৎ আসে তখন আদিত্যদা ফিরে এসে বলছে “দুটো সাপেকাটা, এক গাদা ফলিডল পয়জনিং, ডাইরিয়া, শ্বাসকষ্ট নিয়ে ডাক্তার ঘোষ আটকে আছে, ওয়ার্ড একদম ফুল- বললো হাত ফাঁকা হলেই ড্রিপ চালাতে আসছে”
নবাদির মুখটা গম্ভীর হলো। খানিক পরে একটা শ্বাসকষ্টের বাচ্চা ভর্তি হলো। সোমা তখন হীটারে চা বসিয়েছে। নতুন পেশেন্টের বাড়ির লোকের শরীরের ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে বাইরেটা একটু ঠান্ডা। ভেতরে তো শব্দময় ফ্যানের-বায়ুহীন ঘূর্ণিপাক। তখনও কুশলদা নার্সদের রুমে -চায়ের লোভে। উঠে গেলো,নবাদি সঙ্গে। সোমা একটা কাচের জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। প্রথম এপ্রিলের হিমে ভেজা কাচ। ফাঁক করতেই হিম লেগে ঠান্ডা হয়ে’ যাওয়া চৈত্র বাতাস, একটা লাল ফুলের আভায় আকাশের একটা দিক লালচে। এখনও ফুলটা ফোটে নি। লাল ফুল-বেলা বাড়লে হলুদ হয়ে যায়।
কেন রে কচির কচি ভোরবেলা আসে? আমার পরের ভোর কাছে ডেকে আগুন জ্বালায়-– জয় গোঁসাই
সোমার মনটা কার জন্য যেন উদাস হয়। ফর্সা আঙুলে চূণির সে দুল-রক্তের ফোঁটার মতোন।মাথায় ফুলের মুকুট, যে আছে অপেক্ষায়, যে ঝগড়ায়, ভালবাসায়, আঙিনা ভরে তুলবে।আনাড়ি হাতে রান্না করে’ চমক লাগাবে। বড়ো সহজ একটা স্বপ্ন। বড়ো কি কঠিন সেটা পাওয়া?
নবাদি ফিরে এসে বসে। “চায়ের জল তো ফুটে গেল! নে হীটার অফ করে চা পাতা দে….কুশল আপনি বসুন। চা খেয়েই রুমে যান….বাজে নাইট গেলো… সেই ডিহাইড্রেটেড বাচ্চাটাও এক্সপায়ার করলো…..”
সোমা বিস্কুটের কৌটো খুলে’ দুটো বিস্কুট বেশী বার করে। চা খেয়ে একটা ফেলে যাওয়া বাচ্চার ঘুমভাঙা হাতে বিস্কুটদুটো দিয়ে চললো দুজনে মেইল মেডিসিন ওয়ার্ডে। বাঁ হাতে মুড়ির বাটি নিয়ে, হাই পাওয়ার চশমা চোখে দিয়ে ডাক্তার ঘোষ ছুটি লিখছে, ফ্রেশ অর্ডার লিখছে-মৃত্যুর কাগজ লিখছে-ব্যস্ততম রাতের শেষে-নিত্যকর্মপ্রণালীর মতোন।
নবাদি ঘোষণা করা “আপনার একটু সময় হলো না ডক্টর ঘোষ?….বাচ্চাটা মরে গেল”
মরা মাছের মতো চোখ করে’ সাপেকাটার মৃত্যু সার্টিফিকেট লেখা বন্ধ করে’ ডক্টর ঘোষ তাকিয়ে থাকে। সাপেকাটা’টা বড্ড দেরীতে এনেছিলো। নিউরোটক্সিন। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু।ডাক্তারেরও যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। চোখের সামনে জরাজীর্ণ শিশুটি, সদ্যজাত-সব দেওয়াল ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে খিলখিলিয়ে চলে যায়। মোটা চশমা আর কোঁকড়া কাঁচাপাকা চুল নিয়ে ঘোষ স্তম্ভিত জলছবি।
“ডক্টর ঘোষ, আপনি তো রাতে খাওয়ার সময় পাননি-মুড়ি কটা খেয়ে নিন” মেইল মেডিসিনের খুকুদি যেন কুয়াশার আড়াল থেকে কথা ভাসিয়ে দেন।
সোমা জিনস, টিশার্ট পরে’ গোলাপী স্কুটিতে, গোলাপী হেলমেট…ফিরে যায় গায়ে রোদ্দুরের হলুদ মেখে। পীচ রাস্তায় গোলাপের পাপড়ি পড়ে’ পড়ে’ সেজে ওঠে মুগ্ধ জনতা। রাস্তায় কাত্তিককাকার সঙ্গে দেখা।
“কাত্তিককা একবার বাড়ি আসবে? টিনের চালটা এবার ঢালাই করতে হবে”
“হবে না রে বুড়ি… তোর বাবা তো ভিতটা দিতে পারে নি ভালো করে’… ছাতঢালাইয়ের লোড নেবে না”
এই লোডটাও এখন পড়লো এসে সোমার ঘাড়ে। গতমাসে ফ্রীজ কিনেছে। মা গেছে ইস্কুলে।অঙনওয়াড়ি। ইস্কুলে রান্না করতে যায়। গরীব ছাত্রছাত্রীরা খায়। পড়াশোনার অবস্থা তথৈবচ। তবু খাবারটা ওদের জোটে। সোমা জামাকাপড় কেচে মেলতে থাকে। সে অপেক্ষায় থাকে সেই মানুষটির, যে হাতে রুটি আর ডিমভাজা নিয়ে আঙিনায় থাকবে। বহে চলে ক্ষীর নদী, বালুচর কোলে-কিন্তু এসব পরাবাস্তবে। বাস্তবে? বাস্তবে তারপর ফ্রীজ থেকে তরকারি বার করে গরম করা, ক্যাসারোল (মাইনের টাকা দিয়ে সদ্য কেনা) থেকে রুটি নিয়ে বারান্দায় বসে পেটভরানো।মা পায় চার হাজার। মাস গেলে।সে টাকায়ই ছিলো লেখা পড়া, সাজগোজ-সব।
মেসেঞ্জার টিং টং করে “অপেক্ষায় আছি। উত্তর দাও”। সোমার কাজ শেষ হয় না। উত্তর দেওয়া হয় না। মাছ কিনে, কেটে কুটে রান্না করে’ দুপুরের খাবার। বাকিটা ফ্রীজে ঢোকানো। চোখ টেনে আসে। পুরুষ মহাকর্ষের তীব্র আকর্ষণে মহাশূন্য দুমড়ে যায় তো সোমা তো ছার। কিন্তু বড়ো ঘুম পায়, চান পায় না, প্রেম পায় না, খোলা দরজায় ঘুমিয়ে পড়ে বালিকা। ঘুম ভেঙে দেখে মা এসেছে। সঙ্গে দুটো ডিম সেদ্ধ। তিনটের সময় মায়েঝিয়ে ভাত খায়।
রোদ্দুর নামতে নামতে নেমে এলো পায়ের তলায়-জয়নাল আবেদিন
একদিন ডে ডিউটি। নবাদি ঝগড়া করছে কতোগুলো লুচ্চা ছেলের সঙ্গে। “ভিজিটিং আওয়ার ছাড়া ঢুকতে দেবো না। অন্য মায়েরা আছে.. সম্ভ্রম থাকবে না….সবার পোশাক আশাক ঠিক থাকে না”
একটা মাত্র ফোন। হুকুম হয়ে গেল ভেতরে যাওয়ার। যাওয়ার সময় বললো “কি ব্বে খানকি মাগী… কুছু করতে পারলি?”
“একটা খানকিও নিজে গতর খাটিয়ে খায়, তোদের মতো পা চেটে চলে না” সোমা নবাদির মুখ চেপে ধরে। কথাটা বলা হয় না। সোমা বুঝতে পারে নবাদির বয়স বাড়ছে। চামড়া খসখসে হয়ে গেছে। সোমারও চুল কমে এসেছে, রাত্রি জাগরণে চোখের কোণে বলীরেখা বেড়েছে বয়সের তুলনায় অনেক বেশী। এখন সোমাও মুখ ছোটায়। চোখ মুখ বিকৃত করে’ জিঘাংসায়, নখে দাঁতে লড়ে যায়। নকল বুঁদির গড়। ওরাই রক্ষা করে। ভেন্টিলেটর নেই, আইসিইউ নেই, এনআইসিইউ নেই, মেডিসিন নেই, স্টাফ নেই। আছে তো একা কুম্ভরা। একা নয় নারীরা সিস্টার, পুরুষরা ডাক্তার। যে সম্মানের অফিসিয়াল স্বীকৃতি নেই, সেই সম্মানের জন্য লড়ে যায়। অহং বুঝলেন?সবটাই অহং। দ্যাখো আমি, আমরা পারি। মৃত্যুর সাথে লড়ি পঞ্জা।
গভীর রাতে ঝরঝর ঝরে সাতটা ঘোড়ার রক্ত, আট নম্বর ঘোড়া ছিলো রাজার ভীষণ ভক্ত-একটা গল্প বলি-ভালোমানুষ, কেয়া চক্রবর্তী
তবুও বাড়িটা শেষ হতে আট বছর লাগলো। টাকা জমিয়ে, জমিয়ে। মা আর অঙনওয়াড়ি নয়।পা ভেঙে অক্ষম। এখানে হিপ প্রস্থেসিস হয় না, শহরে যেতে হয়। সোমা ছুটি পায়নি। রিলিভার নেই। নবাদির পক্ষে একা ওয়ার্ড চালানো অসম্ভব। লোক নেই, কিন্তু ভীড় বাড়ছে। মৃতপ্রায় রোগী রেখে অমানুষের মতো দোকানের রুটি, ডিম-তড়কা খেতে হয়। চিত্রা এই করে’ একবার না খেয়ে অজ্ঞান হয়ে মাথা ফাটিয়ে, ব্যান্ডেজ নিয়েই ডিউটি করেছে। পরে সিটিতে সাব ড্যুরাল হেমাটোমা ধরা পড়লো।
সোমার যত মুগ্ধ ভ্রমর এসেছে-সব ওর সরকারি মাইনের লোভে, না হলে তারা চাকরি ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে-বিনা পয়সায় রাঁধা, বাড়া, বিছানা, পুজোর কাপড় ফ্রি। তাহলে এখন যে ফেলে যাওয়া নতুন মেয়েবাচ্চাটা ওয়ার্ডে পড়ে আছে, তার খাবারকে ইন্ডেন্ট করবে? নববর্ষের ফ্রক কেনা আছে, পুজোতেও দিতে হবে, ও তো এই ওয়ার্ডের সবার বাচ্চা (হিন্দুও নয় মুসলমানও নয়, একটা কেবল-শিশু)। গতবছর হাতে খড়ি হয়েছে। নাম রেখেছে মামন। ও স্কুলে যাবে। সোমার ইচ্ছে সুপারস্যরকে বলে ও মামনের দায়িত্ব নেবে। ওর হনু উঠে এসেছে, সহস্র বলীরেখা মুখময়-মাকড়সার জালের মতো,শুধু চোখদুটো আজও হৃদস্পন্দন থামিয়ে দ্যায়। এখন আর চুলে কলপ করে না।
এই ভাবে কবিতা ফুরিয়ে যেতে যেতে, অবশিষ্ট থাকবে চার ফর্মা ভালবাসা…….ওই টুকুই চেয়েছি শুধু-জাহাঙ্গীর আবেদিন
নবাদি রিটায়ার করেছে, কুশল এখন মস্তো বড়ো চোখের ডাক্তার-চিনতে পারে না। ডাক্তার ঘোষ কোমর ভেঙে অক্ষম। তবু নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর, চাকরি ছেড়ে বরের কাছ থেকে, আবার সিনেমা দেখার ফুচকা খাওয়ার টাকা চাইতে কখন যেন সোমা লজ্জা পেতে পারে। তাই এক প্রেমিক ডাক্তার বাতিল হয়। প্রেমের থেকে স্বাধীনতা ভালো। সোনার খাঁচায় ঢুকতে চায় না সোমা।
সব মেনে নিতে শিখবো আমিই,
উদাসীনতাই যদি তোমার অভ্যাস হয় তো হোক--আসাদুল্লাহ খাঁ গালিব, সৈয়দ মুজতবা আলী
সোমা, এখন তোমার সে উদাসীনতা, সত্য কিনা জানে না। এখন আর মেসেঞ্জারে টিং টং করে না। সোমা সব কাজ শেষ করে’, অপেক্ষায় থাকে সেই চুড়িদার পরা কিশোরের (আজও কিশোর, নবীন চোখ টানা টানা ভুরু, দুহাতে দুপুরের খাবার নিয়ে সে থাকে অপেক্ষায়।) শুকনো পাঁউরুটি সোমা সেই স্বপ্ন মাখিয়ে খেয়ে নেয়। তখন ওর সেই ক্লান্ত পাঁউরুটিও ভালো লাগে। তখন ওর পাকা চুল জ্যোৎস্নার রং মেখে উজ্জ্বল হয়। এক দিন, হয়তো পরের দিন,ভোর বেলা অবিবাহিতা বুড়ি সিস্টার বিছানায় ঘাড়মুড় গুঁজড়ে পাখা ভাঙা কবুতরের মতোন পড়ে থাকে। আসলে সে ঐ সিমেন্টের দেওয়াল টপকে সেই যে সদ্যজাত শিশুটি, তার কাছে চলে যায়।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলি নি
সে আমার ঈশ্বর জানেন।….
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য
আমার গায়ে জ্বর এসেছে
তোমার জন্য।…..
আমার ঈশ্বর জানেন-
আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
শুধু তোমার জন্য।–নির্মলেন্দু গুণ
অসামান্য !
প্রণতঃ
প্রণতঃ দাদা।সবই চোখে দ্যাখা।শরীরের প্রতিটা কোষে কোষে লেখা আছে, এদের কথা।