সেটা ২০০০ সালের ১৮ই মে। দার্জিলিঙের পাহাড় থেকে অনেক লড়াই করে জয়েন করার শেষদিনে শেষ বিকেলে কলকাতা পৌঁছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে জয়েন করেছি। দুদিন পরে কি একটা কাজে কলেজ অফিসে যেতে হয়েছিল। কাজ সেরে বেরিয়ে আসছি। এমন সময় পেছন থেকে ডাক- ‘এদিকে আসুন’।
ঘুরে দেখলাম নয়নবাবু (নাম পরিবর্তিত)। আপার ডিভিশন ক্লার্ক। শুনেছিলাম ভদ্রলোক কাজকর্ম তাড়াতাড়ি করে দেন। কিন্তু দু-দশ টাকা উপরি নেন। অনেকদিন পরে উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় ফিরেছি। ভয়ে ভয়ে আছি। আবার টাকাপয়সা চায় কি না।
‘আপনি তো ট্রান্সফার অ্যালাউন্স পাবেন। অ্যাপ্লিকেশন করে দিন।’ দেখলাম উনি আমার ন্যায্য প্রাপ্য পাইয়ে দেওয়ার কথা বলছেন।
‘কিভাবে করব?’
‘ফর্ম দিচ্ছি। ফিলাপ করে দিয়ে যান। কিসে এসেছেন?’
‘ট্রেনে।’
‘রেলের থেকে একটা কোটেশন নিতে হবে। আর রোড ট্রান্সপোর্টের থেকে আর একটা। যেটা কম হবে সেই টাকাটা পাবেন। তাও পাঁচ-ছ হাজার তো বটেই।’
কি করে সেই কোটেশন জোগাড় করেছিলাম সে আর এক গল্প। পরে সময়মত বলব।
‘এই নিন, এটা ফিলাপ করুন।’
একটা ফর্ম। এরকম ফর্ম জীবনে দেখিনি। আর এ জীবনে দেখব বলে মনেও হয় না। লালচে রঙের পোকায় কাটা একটা সাইক্লোষ্টাইল করা কাগজ। তাতে ইংরেজীতে যা লেখা তার মোদ্দা কথা হল- কোথা থেকে এসেছেন? কবে এসেছেন? কিভাবে এসেছেন? হাতিতে চড়ে না গাড়ীতে? হাতিতে চড়ে এলে হাতির ভাড়া লিখুন। ফর্ম ভরতে গিয়ে হেসে মরি। বিব্রত নয়নবাবু সাফাই দেন- বৃটিশ আমলের ফর্ম তো! তাই ওইসব কথা রয়ে গেছে।
‘ফর্মটা নতুন করে তৈরী করা যায় না?’
‘বেড়ালের গলায় ঘন্টা-টা কে বাঁধবে বলুন?’
সত্যিই তো! ঘন্টা কে বাঁধবে? আর তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭৩ বছর বছর পরেও ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন বহাল তবিয়তে বজায় থাকে। কেন না, আমরা নতুন কিছু করতে সবসময় বাধার সৃষ্টি করি।
যাই হোক, ফর্মে লেখা থাকলেও সেবার হাতী ভাড়ার কোটেশন আমায় জোগাড় করতে হয় নি।
হাতি নিয়ে হাতাহাতি করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।বরং আসল কথায় আসি।
নতুন কিছু ভাবতে গেলে বা করতে গেলে সবসময় এদেশে একদল লোক রে রে করে তেড়ে ওঠেন।
আচ্ছা বলুন তো, আগেকার লোকে কলকাতায় ঘোড়ায় চড়ে অফিসে যেত বলে আপনিও এই ২০২০ সালে ঘোড়ায় চড়ে অফিসে যাবেন? সময়ের সঙ্গে, পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে বদলাবেন না?
করোনা অতিমারীর শুরুতেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে সংক্রমণ ঠেকাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ টেলিমেডিসিনকে একটা অতিরিক্ত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। মেডিক্যাল কাউন্সিলের অবর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার গত ২৫শে মার্চ ২০২০ টেলিমেডিসিন-কে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আইনগত মান্যতা দিয়ে একটা অধ্যাদেশ জারি করে।
একথা অনস্বীকার্য যে, টেলিমেডিসিন কখনো ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সম্পূরক হতেই পারে। বিশেষতঃ বর্তমান পরিস্থিতিতে। একবার একজন রোগীকে দেখার পরে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে রিপোর্টিং এবং ফলোআপ তো সহজেই করা যায়। নতুন করে বিশেষ জটিলতা দেখা না দিলে সেই রোগীর ক্লিনিক বা ওপিডিতে আসার প্রয়োজনই হয় না।
একটা উদাহরণ দিই। আর জি করে অর্থোপেডিক আউটডোরে একজন মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন (একজন ডাক্তার যিনি শুধুমাত্র আউডোরে রোগী দেখেন)। তাঁর ঘরেই সবচেয়ে বেশী ভীড়। প্রায় সবই নন-অপারেটিভ ফলো আপ করাতে আসা রোগী। এক-দুঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তারা প্রেসক্রিপশন হাতে পেত। তাতে লেখা থাকত- ‘রিপিট অল’ অর্থাৎ আগের ওষুধ গুলোই চলবে। সে অনেকদিন আগের কথা।
বলুন তো, আজকের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ইন্টারনেটের যুগে এই ‘রিপিট অল’ লেখাতে আসা রোগীদের টেলিমেডিসিনে সার্ভিস দেওয়া যায় না? এর জন্য আউটডোরে বা ক্লিনিকে আসার খুব দরকার আছে কি?
এর সঙ্গে যুক্ত হবে সাধারণ কোমর ও ঘাড়ে ব্যথা। এগুলো প্রাথমিক অবস্থায় টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায় বৈকি। প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ-ব্যয়াম ইত্যাদি প্রেসক্রাইব করার জন্য রোগীকে ক্লিনিকে বা আউটডোরে এনে ভীড় বাড়ানোর দরকারটা কি? হ্যাঁ,জটিলতা বুঝলে অবশ্যই তাকে দেখতে হবে। মেডিসিন বিভাগের বহু রোগী, চর্মরোগ, মানসিক রোগ, অর্থোপেডিক্স, রিউম্যাটোলজি এবং আরো অনেক বিভাগের বেশ কিছু রোগীর চিকিৎসা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে করা সম্ভব।
কোনো কোনো চিকিৎসক এবং চিকিৎসক সংগঠন ইদানিং এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সার্জারি কিভাবে হবে? একটি সংগঠন তো একরকম হুলিয়া জারি করেছে যে, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সার্জারি করা যাবে না, ইত্যাদি। টেলিমেডিসিনের প্রবক্তারা কি উন্মাদ নাকি, যে বলবে ‘টেলিসার্জারী করা যাবে’! অথবা জটিল হৃদরোগের চিকিৎসা টেলিমেডিসিনে করা যাবে। প্রযুক্তি এখনো সেই স্তরে পৌঁছয় নি। কিন্তু একশ বছর বাদেও যে পৌঁছবে না, তা কে বলতে পারে! ১৯৭০ সালে কল্পবিজ্ঞান লেখকরা বাদে কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল যে আই ফোনের ছোট্ট ক্যামেরায় এত অসাধারণ ছবি তুলে মূহুর্তের মধ্যে বিশ্বের অন্য প্রান্তে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে? এমনকি মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় আস্ত এক-একটা সিনেমার শ্যুটিং সেরে ফেলা যাবে!রিমোট সার্জারি এখনো বাস্তব নয় ঠিকই, কিন্তু রোবটিক সার্জারি এসে গেছে। এমনকি পিজি হাসপাতালেও বসে গেছে এই যন্ত্র। একযুগ আগে ফেলোশিপ করতে গিয়ে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে রোবোটিক সার্জারি বিভাগে ঢুকে ‘দ্য ভিঞ্চি’ রোবট দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। আজকের ছাত্র-ছাত্রী সার্জেনরা কিন্তু এতে অবাক হয় না। কারণ, রোবটিক সার্জারি এখন এদেশে বাস্তব।
প্রত্যেক রোগীকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে না দেখলে কারো কারো ভাত হজম হয় না। তাদের জন্য একটা সুসংবাদ দিই। ব্লু-টুথ প্রযুক্তি ভিত্তিক স্টেথোস্কোপ এসে গেছে পৃথিবীতে। আপনি যুগের সাথে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করুন। না হলে সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে যাবে পৃথিবী। আর আপনি পড়ে থাকবেন ফিল্মওয়ালা কোডাক ক্যামেরার মত, বাতিল খেলনা হয়ে।
২০০৮ সালে, তখনো মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয় নি, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বসে বহরমপুর হাসপাতালের রোগীদের স্কাইপে টেলিমেডিসিনে দেখে এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমারও খুব সন্দেহ ছিল। যেমন ইলেকট্রনিক মেডিক্যাল রেকর্ড নিয়ে আগের প্রজন্মের অনেকের অ্যালার্জি ছিল। কিন্তু সেই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে। কারণ যুগ এগিয়েছে। ১৮৭১ সালে লেখা ‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী’ পড়ে সেই যুগে কে ভেবেছিল মাত্র একশ বছর বাদে শত শত ‘নটিলাস’ ঘুরে বেড়াবে সমুদ্রের তলা দিয়ে!
এক হাসপাতালের রিপোর্ট তো বটেই, অন্য হাসপাতালের ইলেকট্রনিক রিপোর্টও অনলাইনে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। প্যাকস, আর আই এস বা ডায়াকম ভিত্তিক কাগজ বিহীন এক্স রে, সিটি স্ক্যান, এম আর আই রিপোর্ট ও ছবি সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং দূরে অবস্থিত বিশেষজ্ঞের মতামত আদান-প্রদান চলছে।
২০১৪ সালে লন্ডনে একটা কনফারেন্সে বক্তৃতা দিতে গিয়ে দেখলাম এক ইরানি ডাক্তার মোবাইল ফোনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর ভিত্তিতে তৈরি একটি মেডিক্যাল চিকিৎসার অ্যাপ দেখাচ্ছেন। বেশ কাজের জিনিস বলে মনে হল। তখন মনে হয়েছিল কবে থেকে ভারতে এটা সহজলভ্য হবে!
এবার দেখে নেওয়া যাক, টেলিমেডিসিনকে কোন কোন ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায়-
১. রিপোর্টিং
২. ফলো আপ
৩. অপারেশন রোগীর রিপোর্ট দেখা
৪. অর্থোপেডিক্স, চর্মরোগ, মানসিক রোগ, গ্যাস্ট্রো, পেডিয়াট্রিকস, হেমাটোলজি, রিউম্যাটোলজি, নিউরোলজি এবং আরো অন্য কয়েকটি বিভাগের বেশ কিছু ক্ষেত্রে।
৫. অপারেশন-এর আগে দ্বিতীয় মতামত নেওয়ার ক্ষেত্রে।
আর কখন টেলিমেডিসিন একেবারে অচল ( এটা বোঝার জন্য কোনো পুরস্কার নেই)-
১. সার্জারী
২. প্রসূতিবিদ্যা
৩. চক্ষু (স্ক্রিনিং বাদে)
৪. হৃদরোগ
৫. জটিল বক্ষরোগ
৬. ফ্র্যাকচার
৭. নিউরো সার্জারি
ও
৮. সমস্ত রকম এমার্জেন্সি
এভাবে টেলিমেডিসিন ব্যবহার করে ২০-৩০ শতাংশ রোগীকেও কে যদি বাড়িতেই সুস্থ করে তোলা যায়, বিশেষতঃ কোভিড-১৯ অতিমারীর মত এর মত এমন একটা জটিল পরিস্থিতিতে, তাতে খারাপ-টা কি? ক্লিনিকে, আউটডোরে ভীড় কমে। সম্পদ ও লোকবল সঠিক ভাবে ব্যবহার করা যায়। জটিল রোগী দের উপযুক্ত সময় দিয়ে ক্লিনিকে বা আউটডোরে দেখা যায়।
অতীতে দেখা গেছে ভুমিকম্প, সাইক্লোন ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় টেলিমেডিসিন সবচেয়ে বেশী কাজে লেগেছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সঞ্জয় গান্ধী পিজি আই, শ্রীচিত্রা, অরবিন্দ আই হাসপাতাল, স্যার গঙ্গারাম, অ্যাপোলো, নারায়াণ হৃদয়ালয়ের মত বড়বড় সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল টেলিমেডিসিন ব্যবহার করে।
সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে দেখা গেছে টেলিমেডিসিন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০০৫ সালের প্রতি হাজারে ০.০২ থেকে বেড়ে ৬.৫৭ হয়েছে ২০১৭ সালে। আরো অনেক বাড়ত, যদি না স্বঘোষিত কিছু বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে পদে পদে বাধা দিত।
আমাদের দেশে যেখানে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অপ্রতুল, রোগী প্রতি ডাক্তারের সংখ্যা খুব কম, যোগাযোগ ব্যবস্থা তথৈবচ,অথচ সস্তার ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন সহজলভ্য, সেখানে টেলিমেডিসিন একটা উপযোগী বিকল্প হতে পারে।
সেই লক্ষ্যেই ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিলের অনুপস্থিতিতে কাজ চালানো ‘বোর্ড অফ গভর্নরস’ ২৫ মার্চ ২০২০ এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করেন।
পরিশেষে বলি,কারো যদি মনে হয় তিনি এই প্রযুক্তি নির্ভর প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত নন, তিনি এটা ব্যবহার করবেন না। কে বাধ্য করেছে তাকে? কিন্তু ভুল তথ্য দিয়ে অন্যদের প্রভাবিত করে ক্ষতি করছেন কেন? টেলিমেডিসিন ছিল, আছে এবং বাড়বে। যে বা যারা একে টেনে নামাতে চাইছে- তারা অচিরেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
1.https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6618173/
2.https://www.google.com/amp/s/www.thequint.com/amp/story/voices%252Fopinion%252Fcoronavirus-pandemic-healthcare-india-telemedicine-urban-rural-outreach-accessibility.
3.https://books.google.co.in/books?id=R165DwAAQBAJ&pg=PA115&lpg=PA115&dq=how+many+percentage+of+patient+can+be+catered+by+telemedicine&source=bl&ots=HipzWVdoV4&sig=ACfU3U3YUnAXmt-8Wb95AkdFUVULN6PdFQ&hl=en&sa=X&ved=2ahUKEwiIz_ecvoTqAhX47XMBHdf5DGoQ6AEwEXoECAUQAQ#v=onepage&q=how%20many%20percentage%20of%20patient%20can%20be%20catered%20by%20telemedicine&f=false
4.https://www.lexology.com/library/detail.aspx?g=a1d76ffa-1853-4c7a-84e8-f8ef37d44525#:~:text=These%20guidelines%20finally%20clarify%20India’s,requirements%20of%20the%20Telemedicine%20Guidelines.