।। তোমার সৃষ্টির পথ ।।
আমরা আমাদের কথাবার্তার (আলোচনার?) একদম শেষ পর্বে এসে পৌঁছেছি। আপনারা যে গুটিকয় পাঠক এই জার্নিতে আমার সাথে ছিলেন তাঁরা নিশ্চই হতাশ হয়ে বলছেন চেতনা নিয়ে যা শুরু হল তা শেষ হল পদার্থবিজ্ঞানের কচকচিতে। চেতনার মত এক জৈবিক সত্তার উপলব্ধি হল কোথায়? আসলে চেতনাকে নানাজন নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং প্রত্যেকেই চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন। এটা তাঁদের দোষ নয়, দোষ চেতনার। কারণ তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমি একটি দিকেই আলো ফেলতে চেয়েছি যেটি নিয়ে আমি সামান্য হলেও আলাপ বিস্তার করতে পারব। তাই সবকিছু নিয়ে বলা আমার জ্ঞানের বাইরে। আমার সাধ্যাতীত।
এই আলাপচারিতায় আমরা যা বুঝলাম চেতনা যেহেতু আমাদের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তার এক আধার প্রয়োজন। এই আধার হল বহির্জগত বা ব্যপকতর অর্থে এই মহাবিশ্ব। তাই চেতনাকে বুঝতে হলে আমাদের মহাবিশ্বকে বুঝতে হবে। আমরা তাকেই বোঝার চেষ্টা করলাম। মহাবিশ্ব যেহেতু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সাব অ্যাটমিক পার্টিকল নিয়ে তৈরি তাই আমরা পদার্থের ‘মন’ জানার চেষ্টা করলাম। আমরা দেখলাম আমরা যত গভীরে যাচ্ছি তত যেন আমাদের বোধ বা চেতনা যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। এমন একটা সময় আসছে যখন বিজ্ঞান সরাসরি স্বীকার না করলেও সে দর্শনের হাত ধরে ফেলছে।
অনেকের মত আমিও মনে করি চেতনা বা মহাবিশ্বের রহস্য জানতে হলে আমাদের কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে না বুঝে উপায় নেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরাই যে বলছেন তাকে বোঝা সম্ভব নয়, তাহলে? রজার পেনরোজ এক্ষেত্রে একটা দারুণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, একথা ঠিক যে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বোঝা যায় না কিন্তু একথাও ঠিক যে এই তত্ত্বকে না জানলে আমরা মহাবিশ্ব নিয়ে অজ্ঞই থেকে যাব। এই তত্ত্বকে বুঝতে হলে এই তত্ত্বকে আমাদের চেতনার সাথে জড়িয়ে নিতে হবে। আমাদের মস্তিষ্ক ক্ল্যাসিকাল ফিজিক্সের তত্ত্বগুলো উপলব্ধি করতে পারে কারণ সেগুলো তাদের রিয়্যালিটির সাথে খাপ খেয়ে যায়। আমাদের নিউরোনগুলোকে কোয়ান্টাম চেতনায় টিউনিং করে নিলে তবেই আমরা এই জগতকে কোয়ান্টাম দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে পারব। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমাদের ক্লাসিকাল চেতনাকে কোয়ান্টাম চেতনায় পরিবর্তিত করা সম্ভব হয় নি। হয়ত কোনোদিন সম্ভবই নয়। তাই এই মহাবিশ্বকে আমরা যে দৃষ্টি দিয়ে দেখি তা সত্য নয়। সেটা ইলিউশন। ২+২ সবসময় ৪ হয় না কিন্তু আমরা জানি ২+২ সবসময় ৪ হবে। তাই আমাদের চেতনা ও জ্ঞান অপূর্ণ।
বিজ্ঞান কোনোদিনই হয়ত চেতনাকে ব্যাখ্যা করতে পারবে না কারণ বিজ্ঞান ছোট ছোট দৃষ্টিকোণে সবকিছুর নিরীক্ষা করে। তার পক্ষে সার্বিকভাবে নিরীক্ষণ করা সম্ভব নয়। চেতনার বহুমাত্রিকতা তাই বিজ্ঞানের চোখে ধরা দেয় না। দার্শনিকদের সমস্যা তাদের মতের ভিন্নতা। বিজ্ঞানে একটা জায়গায় এসে সকলেই সহমত হয়, দার্শনিকদের মধ্যে সহমত বলে কিছু হয় না। কবি কখনও চেতনার ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী হন না কারণ তিনি চেতনাতে মুগ্ধ, চেতনাতেই লীন। তার জীবনের সাথে চেতনা এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে তিনি তাকে নিজের থেকে আলাদা করতে পারেন না।
চেতনার কথা এলেই দুটো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ভীষণ প্রয়োজন একটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অন্যটি পরলোকের। আমার লেখা আপনারা যাঁরা পড়েন তাঁরা অনেকেই মনে করেন আমি হয়ত সাত্ত্বিক, ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং পরলোকেও বিশ্বাস করি। আমার নিজের সম্পর্কে একটা কথাই বলতে চাই যে আমি ‘অ্যাগনস্টিক’। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না। আমি এও বিশ্বাস করি যে কেউই সঠিক কিছু জানে না। সঠিক বলে হয়ত কিছু হয়ও না। তাই যারা ডগম্যাটিক তাদের থেকে আমি দূরে থাকার চেষ্টা করি। অনেক পাণ্ডিত্য আমাদের সঙ্কীর্ণ করে, সেই ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার ‘জ্ঞানগরিমা ও বয়সের ভারে মন্থর অধ্যাপকের’ মত। তবে আমি জানার চেষ্টা করি। যদি কোনোদিন আমার জীবৎকালে আমি সত্যির কাছাকাছি আসি তবে মেনে নেব ‘ঈশ্বর’ আছেন নাকি নেই- এর কোনো একটা।
তিনচুলেতে বেড়াতে গেছি একাই। তখন কালীপুজো। এত বড় সুন্দর হোটেলে একটি লোকও নেই। সকালে ক্যামেরা নিয়ে পাখির ছবি তুলতে বেরিয়েছি। একটা উঁচু পাহাড়ের ওপর যখন উঠব তখন দেখলাম এক অলৌকিক কুয়াশা ও মেঘ ধীরে ধীরে সারা পাহাড়কে ঘিরে দিল। কেউ কোত্থাও নেই। নির্জন, নীরব চারিদিক। আমি স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার কেমন যেন বোধ হল। সেই সৌন্দর্য ও নির্জনতায় আমার চেতনা যেন মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে অন্য কোথাও ছুটে গেল। আমার মন আকস্মিক কেমন যে এক পুলকে ভরে উঠল আমি এর ব্যাখ্যা দিতে পারব না। আমার মনে হল সেই পুলকের অনুভূতিটিই যেন আমার কাছে ঈশ্বর। জীবনে সেই প্রথমবার আমার ঈশ্বরের বোধ হয়েছিল।
আমি খুব সামান্য কয়েকজন আমার লেখা পড়বে জেনেও প্রতিদিন যেমন তীব্র মানসিক আবেগ ও পাগলামো থেকে আমার লেখার কি-বোর্ডে ফিরে ফিরে যাই সেই উন্মাদনাটাই আমার ঈশ্বর। কেউ বলে লেখালেখি অনেকটা সন্তানের জন্ম দেওয়ার মত। যতক্ষণ না ‘ডেলিভারি’ হচ্ছে ততক্ষণ শান্তি নেই। কিন্তু আমার কাছে এ দুটোকে তুলনা করা যায় না কারণ যে মুহূর্তে আমি লিখে ফেলি সেই মুহূর্তে লেখাটি থেকে আমার মন আলাদা হয়ে যায়। পুরনো লেখার প্রতি আমার প্রায় কোনো আকর্ষণই থাকে না। মা কিন্তু তাঁর সন্তানকে সারা জীবন আগলে রাখেন। যত দিন যায় তত প্রেম স্নেহ বেড়ে যায় বই কমে না। ঈশ্বর যদি কেউ থাকেন আমার কাছে তিনি চেতনাই। চেতনা যদি ইলিউশন হয় তবে তিনিও ইলিউশন।
তিনচুলেতে জীবনে প্রথমবার যেদিন আমার জীবনে ভগবৎবোধ এসেছিল তেমন তীব্র না হলেও আমি প্রকৃতির মধ্যেই বারবার সেই বোধের সঞ্চরণ প্রত্যক্ষ করি। তাই বারবার আমি প্রকৃতির দিকে, পাহাড়ের কাছে, অরণ্যের কাছে ফিরে যাই। সেদিন সকালবেলায় তিনচুলেতে আমি কতক্ষণ পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমার মনে নেই, আমার চেতনা ফিরল যখন তখন দেখি হাজার হাজার হিল ময়না আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে এসে আমার মাথার ওপরের সবকটি গাছ দখল করে বসল। কী আনন্দ ওদের, কী হল্লা, কী চিৎকার আপনি নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। আমার মনে হল আমার মনে জেগে ওঠা আনন্দ যেন তাদের আনন্দ হয়ে সারা চরাচরে ছড়িয়ে পড়েছে। এই বোধ এই চেতনা বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে না। এ এক উপলব্ধি যা জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে প্রবাহিত হয়ে যায়।
আমার মাঝেমাঝে মনে হয় আমি বরং বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী যে কোনো একটা হতে পারতাম, এতে অনেক শান্তি আছে। কিন্তু আমি আমার যে অবস্থান বেছে নিয়েছি তার কারণ এই নয় যে আমি ভীরু, এর কারণ আমি জানতে চাই। আমি বিশ্বাস করি এ জানার কোনো শেষ নেই। তাই এই অনন্ত জ্ঞান হয়ত আমার মত সাধারণের পক্ষে অলভ্য।
চেতনা নিয়ে এতদূর যা লিখলাম তা আমার জানার শেষ নয় সবে শুরু। আমি যা পড়ি তাই লিখি কারণ সেটা আমার চেতনাকে সচল রাখে। আমার কল্পনাকে পল্লবিত করে। আমি যা বলছি তা আমার কথা নয়। আমি এতদিন যা যা পড়েছি তার প্রতিফলন। এতে আমার উপলব্ধি ছাড়া আমার নিজের কথাটুকু প্রায় কিছুই নেই। তাই চেতনা নিয়ে আমি নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারলাম না কারণ আমার জানা একদম আদিম অবস্থায় আছে। আমার জীবৎকালে তা যদি আরো গড়ে ওঠে, হয়ে ওঠে তাহলে আবার লিখব।
গুরুদেব শিরোনামহীন তার শেষ যে কবিতাটি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে রচনা করেছিলেন, সম্ভবত রানী চন্দ সেটি লিপিবদ্ধ করেন তাতে তিনি বলছেন-
‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে’।
কবিতাটি পড়লে দেখবেন একজন চির ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ তাঁর মৃত্যুর আটদিন আগেও যখন তাঁর চেতনা ক্ষীণ হয়ে আসছে, দেহ স্থবির হয়ে আসছে তখনও তিনি তাঁর বিশ্বাসে কত অটল। জীবনদেবতার প্রতি তাঁর কোনো অনুযোগ নেই। তিনি কত সহজে বলতে পারছেন-
‘কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার’।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কেন এমন বিশ্বাস পেলাম না! কেন আমার মন কেবল ছুটে বেড়ায়। কেন আমার চেতনা কোথাও বিশ্বাসে স্থির হতে পারে না। কিন্তু এটাই আমি। আমরা প্রত্যেকে একজন আরেকজনের চেয়ে যে আলাদা তা তো কেবলই চেতনায়। চেতনা যেহেতু বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করেছে তাই তা যতই মায়া হোক না কেন সেই মায়ার বাঁধনে আমাদের না জড়িয়ে কোনো উপায় নেই। তাই যিনি অন্তরের পথ রুদ্ধ করে যোগাসনে বসে সত্যকে খুঁজছেন তিনি খুঁজুন আমি শুধু দু-চোখ ভরে এই মায়ার জগতকে দেখে নিই।
(শেষ)