পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর আর রাজা রামমোহন রায়।ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসের দুই যুগপুরুষ। দুজনের জীবনের মধ্যে এক আশ্চর্যজনক মিল। দুজনেই লড়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। অদম্য জেদ আর হার না মানা মানসিকতা থেকে ঘুরিয়ে দিতে পেরেছিলেন সংখ্যাগুরুর মতামতকে।আজও বোধহয় এই টালমাটাল সময়ে তাদের মতো মনীষীদের আবার ফিরে আসার সময় হয়ে গিয়েছে।
একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে দুজনের টাইমলাইনে।
১৮৩৩ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বরে ব্রিস্টলে যখন রাজার মৃত্যু ঘটছে, ঠিক তার আগের দিন ২৬ শে সেপ্টেম্বরে তের বছরে পা দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। জীবন মরণেও যেন মিলে গেলেন দুজনে!
এই লেখাটির অবতারণা হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগের একটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে, তার প্রতিবাদ স্বরূপ।
আমার পুরনো বন্ধুরা অনেকে পড়ে থাকবেন হয়তো।
দুই মহাপুরুষকে মিলিয়ে দেবার একটি ছোট প্রচেষ্টা।
_____________________________________
একটি কাল্পনিক কথোপকথন
ঘুমটা হঠাৎই ভেঙে গেল ঈশ্বরচন্দ্রের। অনেকদিনের অভ্যাস তো। ধীরে ধীরে দু চোখের আঁধার কেটে গেলে দেখলেন চারিদিকে একটা যুদ্ধের পরিস্থিতি। ছেলে মেয়ে জোয়ান বুড়ো সবাই হৈ হৈ করে দৌড়চ্ছে। এদিকে ওদিকে বিক্ষিপ্ত আগুন জ্বলছে। ইঁটের টুকরো ভেসে আসছে অবিরত। একটা তার শরীরের মধ্যে দিয়ে চলে গেল।আচমকাই দেখতে পেলেন একটি পাথরের মূর্তি মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। বেশ চেনা মুখ। ও হরি ওটাতো নিজেরই মুন্ডু। নিজের অজ্ঞানতায় হেসে উঠতে যাবেন ওমনি লক্ষ্য করলেন মাথায় ফেট্টি পড়া এক ছোঁড়া কাটা মুন্ডুর মাথায় চ্যালাকাঠ দিয়ে ঘা কতক বসিয়ে দিলে।
প্রতিবর্ত্ত ক্রিয়াতে তার হাতটা ছেলেটির কানে গিয়ে পৌঁছালেও, ধরতে পারলেন না ঈশ্বরচন্দ্র। পারলে এখনো তিনি শায়েস্তা করতে পারতেন এই সমস্ত সমাজের আগাছার। এসব অনেক করেছেন উনি সেইসময়ে, যখন অধ্যক্ষ ছিলেন সংস্কৃত কলেজের….! গোটা সমাজটাই তো কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছিল একসময়….আজ থাক সে কথা!
“ছাড়িয়া দাও ঈশ্বর! আমাদের যুগ আর নাই।অমোঘ কাল মুছিয়া দিয়াছে সব ইতিহাস।” বজ্রগম্ভীর গলায় চমকিত হলেন তিনি। সাধু ভাষায় এই সম্ভাষণ এত রাত্রে!
কর্তার চেহারাটাও ভারী পরিচিত, উনার মাথার শিরস্ত্রানের মতোই।
“রাজাসাহেব” বলে পদধূলি নিতে নীচু হতেই ঈশ্বরকে জড়িয়ে ধরলেন রামমোহন। “বয়সে কনিষ্ঠ হইলেও কর্মে তুমি কম কিসে? সনাতন হিন্দু সমাজের বহুযুগ ধরিয়া প্রবহমান কুসংস্কারের মূলে তুমি কুঠারাঘাত করিয়াছিলে ঠিক আমারই মতো। ‘সতীদাহপ্রথা রদ’ হইতে ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্তন’কম হইলো কি? আমি বিধবা মৃত্যু বন্ধ করিতে পারিয়াছি আর তুমি তাহাদের নূতন জীবন দিয়াছো! শুধু তাহাই নহে তুমি তাহাদের শিক্ষিত করিবার বন্দোবস্ত করিয়াছো। বাঙলা তথা ভারতের নারী প্রজন্ম চিরঋণী হইয়া থাকিবে তোমার প্রতি।”
ঈশ্বরচন্দ্র রামমোহনকে তার সতীদাহপ্রথা রদ নিয়ে আরো হয়তো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাচ্ছিলেন। আচমকাই দেখলেন কিছু সাদা পোশাক পরিহিত মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে।
“ইহারা আধুনিক প্রহরীর দল। সব ঘটনার পরে আসিয়া সর্দারি করে। তোমার মূর্তির মুন্ডচ্ছেদ একটি রাজনৈতিক ঘটনা। এরা কিছুতেই দোষীকে হেফাজতে নিবে না।”
“রাজনৈতিক কেন? এতদিন বাদেও আমাকে নিয়ে রাজনীতি? এটা কোন সময় একটু বলবেন রাজাসাহেব?”
“ইহা ২০১৯ খ্রীস্টাব্দ। ইংরাজি মে মাস। ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন চলিতেছে। এই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে একটি জাতীয়তাবাদী আর একটি বঙ্গীয় শক্তির তুমুল বাকবিতন্ডার ফলাফল আজকের ঘটনা। প্রসঙ্গত বলিয়া রাখি বঙ্গ ভাগ করিয়া গিয়াছে ইংরাজরা। আমাদের বঙ্গদেশ আজ আর নাই।
এইসব কুনাট্য দেখিয়া কাজ নাই। চলো একটু পদব্রজে গমন করি। চারিটি গঙ্গার হাওয়া অশরীরি দেহকে শীতল করিবে।”
আস্তে আস্তে প্রখর বুদ্ধিমান ঈশ্বরের জ্ঞানচক্ষু খুলতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা তাঁর রামমোহনের চেয়ে কোন কালেই কম ছিল না। নয়তো ভোট তাঁর বিরুদ্ধে বেশি থাকা সত্ত্বেও বিধবা বিবাহ আইন পাশ করিয়ে আনতে পারেন! ঠিক রামমোহনের মতো করেই।তবে তাঁর ছাত্রাবস্থায় কলেজে পড়া ‘আইন’ বিষয়টি সাহায্য করেছিল নিঃসন্দেহে!
সবার বিপক্ষে গিয়ে সংস্কৃত কলেজ সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দিতে পেরেছিলেন অধ্যক্ষ হয়ে, যা আগে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ আর বৈদ্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকত। শুধু বেথুন সাহেবকে দিয়েই মেয়েদের স্কুল শুরু করান নি, নিজেও তৈরি করেছেন একাধিক স্কুল। সেই বেথুন স্কুল থেকে প্রথম মহিলা স্নাতক হন কাদম্বিনী আর চন্দ্রমুখী। একজন পরবর্তী কালে প্রথম মহিলা ডাক্তার এবং আরেকজন প্রথম মহিলা অধ্যক্ষা।
তাঁর লড়াই ছিল রামমোহনের মতোই সনাতন গোঁড়া হিন্দু সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী শিক্ষাব্যবস্থার আলো যাতে আমাদের সমাজের আঁধারকে সরিয়ে দিতে পারে সেই ছিল এই মানুষ দুটিরই প্রচেষ্টা। হিন্দু সমাজের মাথারা তাঁদের অপমান করতে ছাড়েনি। প্রাণসংশয় হয়েছে কয়েকবার। দুজনেই কুলীন ব্রাহ্মণ, ইচ্ছে করলেই সব কুসংস্কার মেনে নিয়ে সমাজের মাথা হয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু দুজনেই একই পথের পথিক হলেন।পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো প্রবেশ করিয়ে প্রাণসঞ্চার করলেন ভারতীয় সভ্যতার। নবজাগরণ শুরু হল।
একে একে সেই বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন আরো অনেক মহাপুরুষেরা। আধ্যাত্মিকতায় রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র, বিজ্ঞানে জগদীশ ও প্রফুল্লচন্দ্র।আর সবকিছুকে মিলিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রাচ্যের এই সভ্যতা যে পাশ্চাত্যের পরিপূরক হয়ে উঠতে পেরেছে সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, আধ্যাত্মিকতায় এ তারই ফসল। আজ যে শক্তিশালী ভারতের গর্ব করা হয় তার মূল তো নিহিত আছে এরই মধ্যে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই নবজাগরণের দুই যুগপুরুষ কখন যে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে পৌঁছেছেন, বুঝতে পারেন নি। ঈশ্বর আর রামমোহন হিন্দু কলেজ আর সংস্কৃত কলেজ দেখে যারপরনাই আনন্দিত হলেন।
“তোমার মুদ্রিত বর্ণপরিচয় কিন্তু এখনো পাঠ্য হিসাবে চলিতেছে! অতএব বাঙলা চলিত ভাষাকে তুমি যেরূপে আধুনিকা করিয়াছিলে তার প্রভাব অদ্যপি বিদ্যমান। ”
মৃদু হাসির রেখা খেলে গেল ঈশ্বরের মুখে। এও এক বড় লড়াইয়ের জিত তার। একেশ্বরবাদী রামমোহনের সময়কার গোমড়ামুখো বাংলাভাষাকে ঈশ্বর উদাসীন ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কার করে সমসাময়িক তৈরী করেন। উনার ভাষাতেই এখনকার বাঙালি কথা বলে।
“কিন্তু রাজাসাহেব এরা সব নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে কেন? এখন তো জমিদারি শোষণ বা ইংরেজ পরাধীনতা কোন টাই নাই!”
“বুঝিলে না ইহা ক্ষমতার লড়াই। যুগ যুগ ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে। ভারতবর্ষে এখন যে নব্যজাতীয়তাবাদ জাগিয়া উঠিতেছে সনাতন হিন্দু ধর্মের স্নেহচ্ছায়ায় তা দেশকে পুরাতন অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগে প্রক্ষেপণ করিবে কিনা তা একমাত্র সময় বলিতে পারিবে। কিন্তু সম্ভাবনা দিন দিন বাড়িতেছে।”
“আমরা আমাদের সময় অনেক কঠিন লড়াই লড়েছি রাজাসাহেব। কুসংস্কারাছন্ন হিন্দু সমাজ আর তাদের নেতারা আমাদের প্রাণের পিছনে পড়ে ছিল। এই রাধাকান্ত আপনার আর আমার দুই কালেই হিন্দু কুলতিলক হয়ে আমাদের বিরুদ্ধাচারণ করে। কিন্তু জয় শেষ পর্যন্ত ন্যায়ের পথেই হয়। সে তুলনায় আজকালকার শত্রু রা তো নস্যি। এদের জন্য আমার তালতলার চটিজোড়াই যথেষ্ট। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা আবার ফিরে আসবো পুরনো লড়াই নতুনভাবে লড়তে।কি বলেন?” মুচকি হাসলেন ঈশ্বরচন্দ্র। কিন্তু চোয়ালটা একটু যেন শক্ত হল।
রাজাও সম্মতি দিলেন। হাত ধরাধরি করে দুই মহাপুরুষ আবার হাঁটা শুরু করলেন।
কলেজ স্ট্রীটের নিওন লাইটগুলো আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে। অদূরে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে প্রথম ট্রেন যাত্রা শুরু করতে চলেছে। প্রিন্সেপ ঘাটে গঙ্গার গায়ে নতুন ভোরের গোলাপি আভা।
আরেকটা দিন শুরু হল।
দুই পুরনো কলকাতাবাসীর কথোপকথনের কোন সাক্ষী রইলো না।