একটা দশতলা উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে একটা ছোট্ট পাথর ফেলে দিন।সেটা ক্রমশ ভরবেগ বাড়িয়ে যখন নিচে পৌঁছবে তখন সেটা একজন মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অথচ প্রথম অবস্থায় পাঁচ ফুটের মধ্যেই কারো মাথায় পড়লে তেমন কিছুই হবে না।
দুর্নীতির ক্ষেত্রেও ঠিক এই ঘটনাটা ঘটছে। যতদিন যাচ্ছে দুর্নীতির তীব্রতা, গভীরতা ততই বাড়ছে।
যদি চোখ রাখি শিক্ষাক্ষেত্রে-তাহলে কী দেখবো?
শিক্ষার দুর্নীতি ছিলো অণুবীক্ষণিক। কী ভাবে কিছু আপাত নির্দোষ ঘটনা ধীরে ধীরে কর্কট রোগের মত ছড়িয়ে পড়লো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে,তৈরি হলো দুর্নীতির সাগর।
একদম প্রথমে স্কুলে শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেটে পড়া দিয়ে শুরু হলো।নির্দোষ ঘটনা। একজন দুজন যেতো।কেউ বেশী ভালো করে জানতে যেতো। তখনও শিক্ষকরা অনেকেই টাকা না নিয়েই পড়াতেন এবং সেরা পড়ানোটা ইস্কুলেই পড়াতেন। আমার উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্টের রেজা়ল্ট খুব খারাপ হয়েছিলো।আমার ইস্কুলের এক মাস্টারমশাই বাড়ি এসে বলে গেছিলেন “দীপঙ্কর আগামীকাল থেকে ভোরবেলা টিফিন করে বইপত্র নিয়ে আমার বাড়ি চলে যাবে, দুপুরে বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে আবার আমার বাড়ি গিয়ে পড়বে, রাতে বাড়ি ফিরবে”
আমার ভালোমন্দ যা হয়েছে সব কিছুর জন্য সেইসব মাস্টারমশাই দিদিমণিরা দায়ী।
তারপর এলো মাইনে নিয়ে পড়ানো।
বেশী ছাত্র মানে বেশী টাকা।
শুরু হলো ইঁদুর দৌড়। ছাত্রদের দৌড়। ছাত্রদের ফলাফল হয়ে উঠলো অভিভাবকদের সম্মান, অপূর্ণ আশা পূরণের ইঁদুর দৌড়। প্রথম হওয়ার দৌড়। জ্ঞান নয়,ভালো ফলাফল মানে ভালো চাকরি। ক্রমশ শিক্ষার থেকে ডিগ্রির দাম বেশী হয়ে উঠলো।
এই সমগ্র চিত্রনাট্যের মূল রচয়িতা কে সেটা বলা বেশ মুশকিল, তবে অভিভাবকদের দায় বড়ো কম নয়।সঙ্গে ভোগবাদ, পুঁজিবাদ আর বিশ্বায়নের একটা মস্তো ভূমিকা থাকছে। তাঁরা বুঝলেন এই সব ইস্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হয়ে কোনও লাভ নেই। আসল হলো পর্ষদের পরীক্ষাগুলো। শুরু হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস করার যুগ। গজিয়ে উঠলো অসংখ্য টিউটোরিয়াল, যাদের সাজেশন শতকরা একশো ভাগ মিলে যাবে। জ্ঞান পড়ে রইলো পেছনের সারিতে। নম্বর পাওয়াটাই হয়ে গেল মূখ্য।এখন আর টিউটোরিয়াল নয় সরাসরি ছাত্ররাই প্রশ্ন কিনতে লাগলো।
আমার ডাক্তারি জীবনের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে।
খুব জ্বর নিয়ে একটি মেয়ে এসেছে আমার চেম্বারে।মেয়েটি হবু ডাক্তার। সামনেই তার ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষা। প্রেসক্রিপশন লেখার সময় মেয়েটির মা প্রশ্ন করলেন “ডাক্তারবাবু মেয়েটার টাইফয়েড হয় নি তো?”
আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম “বল তো মা টাইফয়েড হলে প্রথম সপ্তাহে কি কি লক্ষণ দেখা যাবে?”
মেয়েটি অম্লান বদনে বললো “কাকু, টাইফয়েড আমি পড়ি নি, ওটা গত বছর এসে গেছে”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
শিক্ষকতা জীবনে এমন ছাত্র পেয়েছি যারা ঠিকভাবে নিজের নাম,রোল নম্বরটাও লিখতে পারে না। অথচ জয়েন্ট এন্ট্রান্স পাস করেছে। তারা হয়তো নিজেরা জয়েন্ট পরীক্ষাটাও দেয় নি। তাদের হয়ে অন্য কেউ দিয়েছে।এগুলো কি অভিভাবকদের অজ্ঞাতসারে সম্ভব? এবং তারা এমন কি নাড়ি দেখতেও জানে না, প্রেসার মাপতে পারে না-কিন্তু তারা পাস করছে। মিশে থাকছে শত ডাক্তারের ভীড়ে। আপনি কিন্তু তাদের চিনবেন না।
দশতলা থেকে পড়তে থাকা সেই ছোট্ট পাথরটা আজ ভয়ঙ্কর ভরবেগ সঞ্চয় করে সব কিছু ভেঙেচুরে দিতে উদ্যত। আপনি বাড়ি তৈরি করুন বা থানায় নালিশ করুন বা আদালতে বিচার চাইতে যান-আপনাকে দুর্নীতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আপনার হকের কাজটুকু করতে হবে,,দুর্নীতির পতনশীল পাথরের আঘাতে আজ সব চূর্ণবিচূর্ণ।
রাজনীতি, শিক্ষকতা, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, সাধরণ চাকুরিজীবী… যেদিকে তাকাবো চোখ অন্ধ করে দেওয়া এক দুর্নীতির ঢেউ।
তারমধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো একদল ডাক্তারি পড়ুয়া মরণ পণ করে সত্যের পথে লড়ছে। কোথা থেকে যেন লক্ষ মানুষ এসে তাদের হাত ধরেছে। তারা হারবে না জিতবে, নাকি দুর্নীতির করালগ্রাসে তিলোত্তমার মতো দুমড়ে মুচড়ে আকাশে রক্তঝরা চোখ মেলে উৎসবমুখর জনতার পায়ের তলায় নিথর পড়ে থাকবে, জানি না। শুধু এইটুকু জানি আজও প্রাণ আছে, আশা আছে। কি জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি।
এই তীব্র আবেগ বেঁচে থাকুক। আমার এই সহস্র সন্তান দৃপ্ত চোখে বেঁচে থাকুক। তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাতে ভেঙে যাক যত অন্যায় আর অবিচারের শৃঙ্খল।
আমরাও বিচার চাই, তোমাদের সঙ্গে।