(১)
“নতুন জীবন যখন দিলে, তখন এরকম জীবন কেনো দিলে ঈশ্বর!!”
“আরে, নতুন জীবন তো তোমার ডাক্তার দিয়েছে…তুমি তাকেই ধরো। ফালতু আমাদের ঈশ্বরের বদনাম করছো কেনো?”
বিশুবাবুর কানে কথাগুলো যেতেই বেশ অবাক হয়ে দেখলেন রাস্তার পাশের একটা বারান্দায় মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক বসে আছেন। কাছে যেতেই একটা তীব্র গন্ধ নাকে এলো। নাহ্ এটা তাঁর হ্যান্ডস্যানিটাইজার থেকে আসছে না!
একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন তিনি, “সাত সকালে উঠেই নেশা করে নিয়েছেন?”
বিশুবাবুকে দেখেই মহিলা বলে উঠলেন, “ওনার কথায় কিছু মনে করবেন না। করোনা ওনার সব কেড়ে নিয়েছে। গতবছর স্ত্রী করোনায় মারা গেছেন। ছয় মাসের মধ্যে একমাত্র ছেলে ঈশ্বরও চলে গেলো। একমাত্র উনিই বেঁচে গেছেন। কিন্তু ছেলের মৃত্যু ওনাকে সবথেকে বড় আঘাত দিয়েছে। সারাদিন নেশা করে থাকেন, রাতেও ঘুমান না…চেঁচামেচি করেন…”
করোনা বিশু বাবু কেও তো ছাড়েনি। ওনার মত এত বড় আঘাত হয়তো পান নি, তবে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে তিনি ফিরে এসেছেন। কিন্তু ঘরে ফিরেও তো মুক্তি নেই! শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা রয়েই গেছে, মাঝেমাঝে খুব বেড়েও যাচ্ছে। দু পা হাঁটলেই বসতে হয়, সিঁড়ি দিয়েও উঠতে পারেন না। কিন্তু বাড়ি থেকে না বেরোলেও তো উপায় নেই। ওনারা দুজন বয়স্ক স্বামী-স্ত্রী বাড়িতে একাই থাকেন, ছেলে মেয়েরা কর্মসূত্রে ভিনরাজ্যে। নতুন জীবন যেন কাঁটার মালা! কী ভাবে যে মুক্তি পাবেন?
(২)
“নাহ্ কাজটা মনে হচ্ছে চলেই যাবে!” অস্ফুটে বলে ওঠে রমা। গিন্নীমা রেগে আছেন আজ সকাল থেকেই। বাড়িতে লোকজন আসবে নাকি, অনেক কাজ। কিন্তু ঘর পরিষ্কার করতেই এত বেলা হয়ে গেলো। এরপর থালা বাসন মাজতে হবে, তারপর রান্না শুরু হবে। কখন যে করবে এত কাজ! শরীরে যে কী হলো করোনা হওয়ার পর থেকে! আগে যে কাজ এক ঘণ্টায় শেষ হয়ে যেত, এখন তা তিন ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে পাঁচবার বসতে হচ্ছে। ক্লান্তিভাব যেন কাটেই না, সবসময় অলস লাগে, শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এভাবে আর কদিন চলবে? লকডাউনে স্বামীর কাজ গেছে। এখন তার কাজটাও চলে গেলে ছোট ছোট দুটো বাচ্চাকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে!
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর হাসিমুখের বদলে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখেই এখন বেশি দেখা যায় গিন্নীমাকে। ইষ্টাদেবতার আশীর্বাদে তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু এখন বাতের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। গোটা শরীরে এতো ব্যথা যে মনে হচ্ছে কেউ লাঠিপেটা করে গেছে, রাতে ঘুমাতে পারেন না। তার সাথে বুক ধড়ফড় করছে, মাথায় যেন তাপ উঠে যাচ্ছে, যখন তখন সবাইকে উল্টোপাল্টা বলে দিচ্ছেন। রমাও এখন ঠিকমত কাজ করছে না। ঘরের কাজ সব আগেই মাথায় উঠেছে। এখন বিছানা ছেড়ে বাথরুম অব্দি যাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(৩)
আজ খুব ভেঙে পড়েছে রতন। বড় আশা করেছিল এবারে ভোটে দাঁড়ানোর টিকিট সে পাচ্ছেই। কিন্তু খবরটা শুনে মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো তার। এ এলাকায় তার মতো ডাকাবুকো যুব নেতা আর দ্বিতীয়টি নেই। সে থানার বড়বাবুকে হুমকি দেওয়াই হোক, বা বিডিওকে ঘেরাও করাই হোক, কিংবা হাসপাতালের ডাক্তারের কলার ধরে চড় কষানোই হোক….সবেতেই তার জুরি মেলা ভার। সে বাড়ি থেকে বেরোলেই খবরের চ্যানেলের লোকেরা ক্যামেরা তাক করেই থাকতো, কখন কী ঘটে।
“দাদা নওয়াজ সাহেবকে একবার জানালে হত না?”
যদুর কথাটা বেশ মনে ধরলো রতনের। নওয়াজ সাহেব একসময় ডাকসাইটে নেতা ছিলেন, বেশ কয়েক বারের মন্ত্রীও ছিলেন। এখন যদিও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন, তাও তাঁর কথা পার্টি ফেলতে পারবে না। আর উনি রতনকে বড় স্নেহও করেন। সেই যেবার ওনার গাড়ির ওপর নাজমুল হকের লোকজনেরা হামলা চালিয়েছিল, সেবার রতন একাই হক সাহেবের চার পাঁচটা সাগরেদের হাত পা গুড়িয়ে দিয়ে এসেছিল। তার জন্য অবশ্য তাকে কয়েকটা মাস জেলেও থাকতে হয়েছিল।
“স্যার আমি রতন।”
সবে মাত্র দু দিন হল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন নওয়াজ সাহেব। বেশ কয়েক দিন একমো সাপোর্ট থাকতে হয়েছিল তাঁকে। এখন বিছানা ছেড়ে কোথাও যেতে পারছেন না, স্মৃতিশক্তির হালও খুব খারাপ।
রতন প্রাণপণে নিজের নামটা মনে করানোর চেষ্টা করে গেল। কিন্তু কোন লাভ হল বলে মনে হল না। শেষে ওনার অ্যাটেনড্যান্টকে ডেকে সঙ্গে আনা বড় ব্যাগটা ধরিয়ে বললো, “এতে কিছু ফলমূল আর হাজিসাহেবের দোকান থেকে আনা স্পেশাল বিরিয়ানি আর কাবাব আছে, উনি খুব ভালোবাসতেন কিনা!”
রতন মনে মনে ভাবলো, অতি পছন্দের খাবার খেয়ে যদি তার কথা একটু মনে পড়ে!
–“ধূর মশাই, উনি তো কিছু খেতেই পারছেন না। গিলতে গেলেই কষ্ট, জোর করে কিছু দিতে গেলেই কাশি শুরু হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু তাই সব পেস্ট করে সুপ বানিয়ে খাওয়াতে বলেছেন।”
————–
জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় সকলেই করোনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কেউ স্বজন হারানোর বেদনায় নিমজ্জিত, তো কেউ মরণ বাঁচন লড়ে হয়ত ফিরে এসেছে, কিন্তু তার ক্ষত এখনও শুকোয়নি। এই ক্ষত-বিক্ষত শরীরকে সারিয়ে তুলে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে রিহ্যাব চিকিৎসার গুরুত্ব অপরিসীম।
কোভিড পরবর্তী রিহ্যাবের জন্য প্রয়োজন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ রিহ্যাব টিম। এই রিহ্যাব টিমের নেতৃত্ব দেন একজন ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ (ফিজিয়াট্রিস্ট বা রিহ্যাব ফিজিশিয়ান)। টিম গঠন করা হয় ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, প্রস্থেটিস্ট-অর্থটিস্ট, রিহ্যাব নার্স, ভোকেশনাল কাউন্সিলর, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, সোশ্যাল ওয়ার্কর, গভর্নমেন্টাল ও নন গভর্নমেন্টাল অর্গানাইজেশন এবং প্রয়োজন অনুসারে পালমোনোলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও যে উপসর্গগুলি সবথেকে বেশি দেখা যায়, তার মধ্যে প্রধান হল ক্লান্তিভাব, শ্বাসকষ্ট, কাশি, মাংসপেশি বা গাঁটে ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ ও স্মৃতিলোপ। কোভিড পরবর্তী রিহ্যাবের মূল লক্ষ্য হল এই উপসর্গগুলি থেকে মুক্তির পাশাপাশি রোগীর দৈনিক কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান ও চারিত্রিক উন্নতি।
প্রথমে রোগীর সমস্যাগুলো নথিভুক্ত করা হয়। তারপর রোগী ও রোগীর বাড়ির লোকের সাথে রিহ্যাব টিমের সদস্যরা বসে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করেন। সেই লক্ষ্য পূরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা, ফার্মাকোলজিক্যাল (ঔষধ), ননফার্মাকোলজিক্যাল চিকিৎসা (ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, অর্থোসিস), ইন্টারভেনশনাল প্রসিডিওর (বিশেষ পদ্ধতিতে ইনজেকশন) বা সার্জারি করা হয়। তবে এক্ষেত্রে রোগী বা রোগীর বাড়ির লোকের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।
শ্বাসকষ্ট শুরু হলে কোন পজিশনে থাকতে হবে, বাড়িতে নিয়মিত কিভাবে ব্যায়াম করতে হবে বা কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে…এসব বিশদে জানা খুবই জরুরী। রিহ্যাব স্পেশালিস্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ ও বিভিন্ন থেরাপি প্রেসক্রিপশন, ইন্টারভেনশন করার পাশাপাশি সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের দ্বায়িত্বেও থাকেন। ফিজিওথেরাপিস্টরা বিভিন্ন শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, কফ বের করার পদ্ধতি, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যায়াম, স্ট্রেচিং, ওয়ার্ম আপ…এগুলো শেখান। প্রস্থেটিস্ট-অর্থটিস্টরা প্রয়োজনীয় যন্ত্র, ক্র্যাচ, ব্রেস, স্প্লিন্ট ব্যবহারের ব্যবস্থা করেন। অকুপেশনাল থেরাপিস্টরা সেখানে বিছানা ছেড়ে ওঠা, বসা, দাঁড়ানো বা হাঁটার টেকনিক, সহজে দৈনিক কাজ করার পদ্ধতি, অস্থিসন্ধির সুরক্ষা, দৈহিক শক্তি সংরক্ষণের উপায় এবং প্রয়োজন অনুসারে বাড়ির খুঁটিনাটি পরিবর্তনের ব্যাপারে ট্রেনিং দেন। সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলররা যেমন মানসিক চাপ, অবসাদ, দুশ্চিন্তা কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করেন; তেমনি ভোকেশনাল কাউন্সিলরের কাজ হচ্ছে রোগীকে উপযুক্ত পেশায় নিয়োজিত করা। এছাড়াও সোশ্যাল ওয়ার্কার এবং বিভিন্ন অর্গানাইজেশনেরও বড় ভূমিকা থাকে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর ক্ষেত্রে।
বিশ্বসেরার মুকুট পড়েও মেসি-রোনাল্ডোরা সহখেলোয়ারদের সহযোগিতার অভাবে বিশ্বকাপ আনতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বসেরা বোলিং লাইন আপ নিয়েও টিম ইন্ডিয়া কিছুই করতে পারবে না, যদি না ব্যাটিং ফর্মে ফেরে! কারণ এটা টিম গেম, সবার সামগ্রিক প্রচেষ্টাই টিমের সাফল্যের চাবিকাঠি। সঠিক রিহ্যাব চিকিৎসার ফলে হয়তো বিশুবাবু, রমা, গিন্নীমা আবার পুরোনো ছন্দে ফিরতে পারবেন। নওয়াজ সাহেব হয়তো আবার কাবাব বিরিয়ানি খেতে পারবেন, রতনকে হয়তো আবার চিনতে পারবেন…কে বলতে পারে রতন এবার ভোটে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী হবে না! কিন্তু দুঃখের বিষয় এ সম্পর্কে সর্বস্তরের রোগী ও চিকিৎসকদের একাংশের সচেতনতার বড়ই অভাব! অনেক চিকিৎসক শুধুমাত্র ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে রোগীকে পাঠিয়েই নিশ্চিন্ত হন, কিংবা রোগীরা নিজে থেকেই যান। এর ফলে রোগী ‘কম্প্রিহেনসিভ রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম’ থেকে বঞ্চিত হয় এবং সমাজের মূলস্রোতে ফেরা তাদের কাছে দিবাস্বপ্নই থেকে যায়। অবশ্য এর জন্য অনেকাংশে সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি লোকবল ও পরিকাঠামোর অপ্রতুলতাই প্রধান কারণ বলে মনে হয়েছে। তবে আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই এই চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে।
দারুন লেখা। প্রচুর লোক উপকৃত হতে পারে এই লেখার মাধ্যমে।মফস্বলের অবস্থা আরও করুন।