এই লেখার প্রথম দুটো পর্ব লিখেছিলাম তা প্রায় দেড় মাস হল। তারপর নানা কাজের চাপে আর লেখা হয়ে ওঠে নি। হয়তো পাঠকের মনে সাসপেন্স অনেক থিতিয়ে গেছে। তবু বিশেষ মানুষের বিশেষ অনুরোধে আবার গল্পটা শুরু করতে হল।
—————————————-
……..অপারেশনের জন্য অজ্ঞান চেক-আপে দেখা গেল রোগীর ফুসফুস সংক্রান্ত কিছু সমস্যা আছে। পুরো অজ্ঞান করতে বেশ সমস্যা। তবে মেরুদন্ডে ইঞ্জেকশন দিয়ে পা অবশ করে অপারেশন করা যেতে পারে।
অপারেশনের দিন পিঠে ইঞ্জেকশন দিতে গিয়ে ভয়ঙ্কর সমস্যা তৈরি হল। আজকাল স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়ায় যেমন খুব সরু এবং প্রয়োজন মত দৈর্ঘ্যের সূঁচ পাওয়া যায়, তখনকার দিনে, বিশেষতঃ সরকারী হাসপাতালে সেসব পাওয়া যেত না। তৎকালীন সরকারি হাসপাতালের ওইরকম মোটা সূঁচ দেখে রোগী চিল চিৎকার জুড়ে দিল। সে কিছুতেই পিঠে সূঁচ ফোটাতে দেবে না।
হাঁট্টাগোট্টা-মোটাসোটা রোগী, বিরাট চেহারা। আজকালকার উন্নত ট্রেনিং ও টেকনোলজির যুগেও এরকম রোগীর স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়া বেশ কঠিন। যদিও বা বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করানো হল, প্রথমবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতেই রোগী হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল। কিছুতেই সে অপারেশন করাবে না। তখন উপায়ান্তর না দেখে সিনিয়ররা নিদান দিলেন, ট্র্যাকশনেই চিকিৎসা চলুক। পরে প্লাষ্টার করে দেওয়া হবে। রোগীকে বলা হল, তার পা একটু ছোট হয়ে যেতে পারে এবং হাঁটু পুরো ভাঁজ হবে না। সে সেটা মেনেও নিল।
তখনকার দিনে মেডিক্যাল কলেজগুলোয় অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের বেশ কিছু রোগী প্রায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যেত। কারো ট্র্যাকশন চলত, কারো মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্টে হাড় বাদ হয়ে বা ইনফেকশন হয়ে হাত-পা অকেজো হয়ে গেলে সেসব ঠিক করতে তিন-চারটে অপারেশন লাগত। এসব রোগীর হাড় বাদে শরীরের বাকি অংশ- বিশেষতঃ বুদ্ধিবৃত্তি- সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকায় এবং সেই যুগে স্মার্টফোনের আগমন না হওয়ায় সারাদিন তারা পরনিন্দা পরচর্চা, খবরের কাগজ, রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য শোনা, তাসখেলা ইত্যাদিতে ব্যস্ত থেকে সময় কাটাত।
চিরঞ্জিত লাহিড়িও এবার সেই দলে যোগ দিল। নার্স ও জুনিয়র ডাক্তারদের হালহকিকত তার মুখস্ত। কোন নার্স কার সাথে প্রেম করে, কোন ডাক্তার পরীক্ষায় ফেল করেছে, কোন রোগীকে ছেলেমেয়েরা দেখে না- এইসব তার নখদর্পণে।
কয়েকদিন বাদে লক্ষ্য করলাম লাহিড়ীর বিছানার চাদর, বালিশ বোম্বে ডাইং-এর না হলেও বেশ রঙীন ও ঝকঝকে। সরকারি হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের সাথে মোটেই মানানসই নয়। তিনি ওয়ার্ডের কোনার একটা বেডে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং সেই কোনাটি রঙীন মহিলা কূলের আনাগোনায় আরো রঙীন হয়ে উঠেছে। আরো আশ্চর্যের ব্যপার, আমাদের ইউনিটের রোগী, কিন্তু আমাকে এই রোগীর জন্য কিছুই করতে হচ্ছে না। অর্ঘ্য (নাম পরিবর্তিত) অন্য ইউনিটের ডাক্তার হয়েও বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে এই রোগীর দৈনন্দিন খোঁজখবর, দেখাশোনা করছে। কাজের ভার কমলে কে না খুশি হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা পিজিটিরা কেউই পুরোপুরি খুশি হতে পারছিলাম না। কবিতা-সঞ্চিতারা দিনে অন্ততঃ একবারও এসে জিজ্ঞাসা করবে না, ‘বাবা কেমন আছে?’ অথবা ‘বাবার প্লাষ্টারটা কবে হবে?’ – এটা সেই বয়সে কার ভাল লাগে?
সুতরাং বাকি সবাই মনে মনে অর্ঘ্যকে হিংসা করতে লাগল। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার-দাবার অর্ঘ্য-র জন্য আসছে- এমন খবরও কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল। যা রটে, তার কিছু তো বটেই! একদিন রাউন্ডের শেষে ওয়ার্ডের টেবিলে বসে ফাইলে লেখালেখির কাজ করছি। এমন সময় রুচিরা-দি বললেন, ‘ষোলো নম্বরের পেশেন্ট আপনার সাথে কি কথা বলতে চাইছে।’
ষোল নম্বর বেড মানে চিরঞ্জিত লাহিড়ী। কি বলবে কে জানে!
বেডের কাছে যেতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘তুমি তো আর এদিকে আসোই না!’
কি পরিপ্রক্ষিতে লোকটা সব জুনিয়র ডাক্তারদের তুমি বলে সম্বোধন করার অধিকার অর্জন করেছে- বলা দুষ্কর।
‘আমি তো রোজই দুবেলা ওয়ার্ডে রাউন্ড দিই। কেন, আপনার কি কিছু অসুবিধা আছে?’
‘না, না অসুবিধা কিছু নেই। কতগুলো কথা ছিল।’
সিষ্টারদের থেকে খবর পেয়েছি, গতকালও এই রোগীর কাছে থানা থেকে পুলিশ এসেছিল। একটা সামান্য পা-ভাঙা কেসের জন্য পুলিশ বার-বার হাসপাতালে এসে তদন্ত করবে- ব্যপারটা খুব অস্বাভাবিক লাগল। ভাবলাম, এই ব্যপারটা জিজ্ঞাসা করবে। তা নয়,বলল-
‘আচ্ছা অর্ঘ্য কেমন ছেলে?’
‘ভালই। খুব হেল্পফুল, সবার সাথেই ভাল সম্পর্ক। কাজকর্ম, পড়াশোনায় খুবই ভাল। দোষের মধ্যে একটু বেশী সিগারেট খায় আর মাঝে মাঝে রেগে যায়।’
হোষ্টেলের পার্টিতে মাঝে মাঝে মদ খেয়ে আউট হয়ে যায়- সেটা আর বললাম না।
‘না, সেকথা জিজ্ঞেস করিনি। সে আমি জানি। জানতে চাইছি, ওর ফ্যামিলি কেমন?’
‘তা তো জানি না! আমি তো ওর বাড়িতে কখনো যাই নি। আর, ফ্যামিলি দিয়ে আপনি কি করবেন?’
‘বিরক্ত হয়ো না। অর্ঘ্য তো তোমার সিনিয়র।’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি তো বিয়ে করে ফেলেছ।’
‘না করিনি। করব।’
লোকটা হাসিমুখে বলল, ‘ভুবনেশ্বরে?’
‘না, কটকে পড়াশোনা করছে।’
এ ব্যাটা এত কথা জানলো কী করে? নিশ্চয় সিস্টারদের থেকে! কর্মক্ষেত্রে ডিউটি নিয়ে যতই খুনসুটি হোক, সিস্টাররা আসলে জুনিয়র ডাক্তারদের পারস্পরিক পরিপূরক। শুধু তাই ই নয়, বহু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগে থেকে টের পেয়ে সিস্টাররা জুনিয়র ডাক্তারদের উন্মত্ত জনতার হাতে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে- এমন উদাহরণ বহু আছে। আমি নিজেই দু’বার এভাবে বেঁচেছি। কিন্তু সিস্টারদের এই একটা বিষয়- জুনিয়র ডাক্তারদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে পিএনপিসি করা- আমি একদম অপছন্দ করি।
‘কবে বিয়ে করবে?’
‘জানি না। আপনি আমাকে অন্য কিছু বলতে চাইছিলেন। সেটা বলুন।’
‘সেটাই তো বলছিলাম। অর্ঘ্যর ফ্যামিলির সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যায়?’
এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। বিদ্রুপের স্বরে বললাম, ‘কেন ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করবেন? না কি মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করবেন?’
চিরঞ্জিত বাবু হাসতে হাসতে বলল, ‘প্রথমটা তো পারব না। যদি দ্বিতীয়টা ভাবি?’
আমি এবার আশ্চর্য হলাম। বলে কী লোকটা! এখানে চিকিৎসার জন্য এসেছে, নাকি ছিপ ফেলতে।
লোকটা বোধহয় টেলিপ্যাথি জানে! উত্তরে বলল, ‘বাবা হয়ে মেয়ের জন্য পাত্র দেখা কী অপরাধ?’
বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এবার থামানো দরকার। তাই বললাম, ‘সে আপনি যা ইচ্ছে করুন। কিন্তু ঘটকালি আর অন্যের টাকা গোনা- আমার দ্বারা কোনোদিন হবে না। বাই দ্য ওয়ে, পুলিশ কী জিজ্ঞেস করছিল?’
দেখলাম লোকটার মুখ চুন হয়ে গেল। জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেরকম হয়।
‘সেকথা তোমায় আমি বলতে বাধ্য নই।’……….
(এরপর পরের পর্বে)
ছবি: অন্তর্জাল