জন্ম গত শতাব্দীর শুরুর দিকে, আমেরিকায়। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ছিলেন কেউ ছিলেন কবি, কেউ আবার শিল্পী, সাহিত্যিক। ছেলেটিও বড় ভালোবাসত ছবি আঁকতে। বন্ধুরা যখন খেলে বেড়াচ্ছে, সে বসে থাকত কাগজ-পেন্সিল-রঙ নিয়ে।
লেখাপড়ায় ভালোই ছিল। কিন্তু, স্বপ্ন একটাই – ছবি আঁকবে সে। হাইস্কুলে পড়ার সময়ই পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেল – যে সে প্রতিষ্ঠান নয়, একেবারে ডাকসাইটে ন্যাশনাল স্কুল অফ ডিজাইনে – স্কলারশিপও মিলল – সকালে ইস্কুল আর রাত্তিরে ছবি আঁকার শিক্ষা – এভাবেই চলতে থাকল।
কিন্তু, মা বড় দুশ্চিন্তায় পড়লেন। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দুচারজন শিল্পী থাকার সুবাদে শিল্পীর দৈনন্দিন জীবনের অনিশ্চয়তার খবর তিনি ঠিকই রাখতেন। অতএব, ছেলেকে নিরস্ত করার চেষ্টায় খামতি রাখলেন না। বোঝালেন, শিল্পীর জীবন দুর্বিষহ – নগ্ন মডেলদের সাথে দিনরাত কাটানো – রোজগার ঘোর অনিশ্চিত – বিলাস-ব্যসন তো দূর, রোজকার খাওয়াপরা জোটানোই কঠিন – সাধ করে এমন জীবন কেউ বাছে!!! সব শুনেটুনে শিল্পীর জীবনটা ছেলেটির তেমন একটা কিছু খারাপ বোধ হল না – কিন্তু, মায়ের কথা তো ফেলে দেওয়া যায় না।
অগত্যা ইস্কুলের গণ্ডী পার হয়ে ছেলেটি ভর্তি হল ডাক্তারি পড়তে।
এই পর্যন্ত গল্পটা অচেনা নয়। অনেক ডাক্তারের জীবনের গল্প, এমনকি অনেক প্রথিতযশা ডাক্তারবাবুর পূর্বাশ্রমের গল্প থাকে এমনই – কেউ হয়ত শিল্পী হতে চেয়েছিলেন, কেউ কবি, কেউ খেলোয়াড় – বাড়ির চাপে, আয়ের নিশ্চয়তার সন্ধানে বা এমনই কোনো বাস্তব যুক্তির পথ বেয়ে ডাক্তারি পড়ার পথে পা বাড়ানো।
কিন্তু, এ গল্প আরো অনেক ডাক্তারের চাপা স্বপ্নের বা অবদমিত শিল্পচেতনার গল্পের মধ্যে তেমনই একটি হলে, সে কাহিনী ফেঁদে বসে আপনার সময় নষ্ট করতাম না। আমাদের গল্পের ছেলেটি সর্বার্থেই ব্যতিক্রমী – ধরাবাঁধা পথের মধ্যে এগিয়েও যে নিজের পথ খুঁজে নেওয়া যায় – এমনকি, বাধ্য হয়ে চলা পথের মাঝেও যে তৈরী করে নেওয়া যায় স্বতন্ত্র পথ – এবং স্বপ্ন আর কঠোর বাস্তবের মেলবন্ধন ঘটিয়ে যে হয়ে ওঠা যায় কিংবদন্তী – ছেলেটির গল্প জানা জরুরী একারণেই।
ছেলেটির নাম – ফ্র্যাঙ্ক হেনরি নেটার। ডাক্তারির বইয়ে যে ছবি থাকে, যে ছবির মধ্যে দিয়ে শরীরের গভীর গভীরতম অসুখ চিনতে শেখে ছাত্রছাত্রীরা – সেই ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তিনি কিংবদন্তী – নেটার-কে বলা হয়, মেডিসিনের মাইকেলেঞ্জেলো – এই শিরোপা প্রসঙ্গে তিনি নিজেই রসিকতা করে নিজের অ্যাটলাস অফ হিউম্যান অ্যানাটমি বইটিকে আখ্যা দিয়েছিলেন, তাঁর সিসটিন চ্যাপেল হিসেবে।
কিন্তু, সেসব তো অনেক পরের কথা।
ফ্র্যাঙ্ক নেটার ডাক্তারি পড়তে ঢুকলেন – যদিও, ডাক্তারি পড়ার চাইতে মন পড়ে রইল ছবিতে। হাসপাতাল, রোগী, অসুখে বিকৃত হয়ে যাওয়া প্রত্যঙ্গ – এইসব ইমেজারি ঘিরে ধরল তাঁকে – হোস্টেলে ফিরে বন্ধুরা যখন বই নিয়ে পড়াটুকু ঝালিয়ে নিচ্ছেন, ফ্র্যাঙ্ক বসতেন তুলি আর কাগজ নিয়ে। কখনও ধরা পড়ত হাসপাতালের আলোআঁধারিতে ঢাকা করিডোর, কখনও খেলতে গিয়ে হাতভাঙা বাচ্চা ছেলের যন্ত্রণাক্লিষ্ট কিন্তু দুষ্টুমিতে ভরা মুখ।
না, পরীক্ষা পাশ করতে অসুবিধে হল না। ফ্র্যাঙ্কের জীবনে পরীক্ষায় পাশ করা কখনোই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি – সে ন্যাশনাল স্কুল অফ ডিজাইনে স্কলারশিপ পাওয়াই হোক, বা ডাক্তারিতে ঢোকার সুযোগ – কাজেই, যথাসময়ে ফ্র্যাঙ্ক পাশ করে বেরোলেন। এমনকি, পাশ করার পরে সার্জারির ফেলোশিপ সম্পূর্ণ করতেও অসুবিধে হল না।
কিন্তু, পাশ করে বেরোলেন বড় গোলমেলে সময়ে। গত শতকের তিরিশের দশক – মার্কিন মুলুকে ভয়াবহ আর্থিক মন্দা – দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন। মানুষের হাতে কাজ নেই – যাঁদের চাকরিবাকরি ছিল, চাকরি হারিয়ে বেকার হচ্ছেন তাঁরাও – নতুন কলকারখানা খোলা তো দূরে থাক, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চালু ব্যবসাও। এই অবস্থায় নতুন পাশ-করা ডাক্তারের প্রাইভেট প্র্যাক্টিস জমার আশা!!! তবে যে মা বলেছিলেন, শিল্পীর আর্থিক নিরাপত্তা নেই – ডাক্তারের জীবন স্বচ্ছল ও স্বাচ্ছন্দ্যের?? ফ্র্যাঙ্ক চোখে অন্ধকার দেখলেন। টিকে থাকার অস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরলেন তুলি।
পড়ার সাথে সাথে ছবি আঁকা তো চলছিলই – সার্জারির ফেলোশিপের সময় জটিল অপারেশন চলাকালীন জীবন্ত মানুষের শরীরের ভিতরের দৃশ্যাবলী ছবিতে ধরতেন ফ্র্যাঙ্ক – কাজেই, এই বিশেষ ক্ষেত্রে ফ্র্যাঙ্ক নেটারের সুনামের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল আগেই। সুতরাং, ডাক্তারির পাঠ শেষ করে, প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের বাজারে সুবিধে করতে না পেরে, তিনি যখন ছবি এঁকে উপার্জনের সিদ্ধান্ত নিলেন, কাজের অভাব হল না। শুরুটা হল বইয়ের ছবি এঁকে, ইলাস্ট্রেশনের পথ ধরে – কিন্তু, বড় দরজাটা খুলে গেল বছরকয়েকের মধ্যেই।
আর্থিক মন্দার সময় পাশ করে বেরিয়ে ফ্র্যাঙ্ক নেটার যদি প্রাইভেট প্র্যাক্টিস না জমাতে পেরে বেকায়দায় পড়েন, তাহলে ঠিক তার পরের দশক থেকেই তাঁর সামনে উপস্থিত হয় এক আশ্চর্য সুযোগ – রমরমা বাড়তে শুরু করে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির – বাজারে আসতে থাকে একের পর ওষুধ – আর যেহেতু সেই ওষুধ যতক্ষণ না পর্যন্ত ডাক্তাবাবুরা প্রেসক্রাইব করছেন, ততক্ষণ আর্থিক মুনাফার সুযোগ নেই, ওষুধ-কোম্পানিরা ভাবতে থাকেন নিত্যনতুন পথে ডাক্তারিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উপায়ের কথা – খুঁজতে থাকেন নতুন বিপণনের পথ।
নতুন গবেষণা, নতুন ওষুধ, তার নতুন কার্যপ্রণালী – অনেক অনেক কথা বলে বোঝানোর চাইতে ঢের সহজ যদি একটি রঙচঙে ছবিতে ব্যাপারটা ধরা যায়। ফ্র্যাঙ্ক নেটার তখন বেশ কিছুটা সুনাম করে ফেলেছেন। কাজেই, তাঁর খোঁজ পেতে ওষুধ-কোম্পানির অসুবিধে হল না। চকচকে প্রোডাক্ট ব্রশিওর, তার মধ্যে বাস্তবের ছোঁয়ামাখা ডায়াগ্রাম – আর এরই মধ্যে ভরে দেওয়া কোম্পানির নতুন ওষুধের চমৎকারিত্ব – যা এখন দৈনন্দিন ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানসম্মত ছবি আঁকার মাধ্যমে সেই বিপণনের ব্যাপারে ফ্র্যাঙ্ক নেটার প্রায় পথিকৃৎ।
কিন্তু, কেবলমাত্র বিজ্ঞাপনী ছবির মাধ্যমে ওষুধ-কোম্পানির সহায়ক শিল্পী হিসেবেই যদি ফ্র্যাঙ্ক নেটার স্মরণীয় হতেন, তাহলে তাঁকে নিয়ে, হয়ত, এত কথা লিখতাম না।
চল্লিশের দশক নাগাদ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানী সিবা (পরবর্তীতে যাঁদের নাম দাঁড়ায় সিবা-গাইগি) ফ্র্যাঙ্ক নেটারকে একটি বড়সড় প্রোজেক্টে কাজে লাগান। শরীরের একটি একটি করে বিভাগ ধরে তার স্বাভাবিক অ্যানাটমি, ব্যধিগ্রস্ত অবস্থার চেহারা, অপারেশন চলাকালীন পরিস্থিতি, প্যাথলজি – এককথায়, প্রায় সবরকমের সম্ভাব্য পরিস্থিতি – আঁকতে থাকেন ফ্র্যাঙ্ক। এ এক মহাকাব্যিক প্রয়াস – চলতে থাকে চার দশকেরও বেশী সময় জুড়ে – শেষ খণ্ডটি প্রকাশ পায় ফ্র্যাঙ্ক নেটারের মৃত্যুর পরে।
চিকিৎসাশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সিবা কালেকশন অফ মেডিক্যাল ইলাসট্রেশনস নামে এই অসামান্য সঙ্কলনের গুরুত্ব আলাদা করে উল্লেখ না করলেও চলে। বিশ্বজুড়ে ছোট ছোট অংশে এই সংগ্রহ বিনামূল্যে বিতরিত হয় ডাক্তারদের মধ্যে – এবং, এই বইয়ের কোনো একটি ছোট খণ্ডও কখনও হাতে নিয়ে দেখেননি, এমন চিকিৎসকের দেখা পাওয়া মুশকিল – কাজেই, এই বইয়ের প্রভাব কতখানি গভীর, সে অনুমান কঠিন নয়।
এসবের মাঝে, কিছু ছবি বেছে সংগৃহীত হয় নেটারের বিখ্যাত অ্যাটলাস অফ হিউম্যান অ্যানাটমি – বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই চিকিৎসাশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে তা অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচিত হয়।
ফ্র্যাঙ্ক নেটার আসার আগে ডাক্তারি বইয়ে ছবি থাকত না, এমন তো নয়। ছবি – অর্থাৎ ইলাস্ট্রেটিভ ডায়াগ্রাম – চিরকালই চিকিৎসাশিক্ষার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তাহলে, নেটারকে নিয়ে এত কথার মানে কী? এর উত্তর পেতে গেলে, নেটারের আঁকা ছবিগুলো দেখুন – এককথায়, স্পষ্ট বোঝা যাবে। netterimages.com ওয়েবসাইটে অনেক ছবি আছে – আন্দাজ পেতে অসুবিধে হবে না।
মানবদেহের জটিলতা, তার ভেতরের প্যাঁচপয়জার, নানাবিধ রঙ ও টেক্সচার আশ্চর্য নিপুণতায় ধরেছেন তিনি। ফটোগ্রাফের চাইতেও সহজে অনুধাবনযোগ্য তাঁর হাতে আঁকা ডায়াগ্রাম। সার্জারি বা ক্লিনিকাল প্রসিডিওরের মুহূর্তেও কোন লেয়ারের পর ঠিক কী প্রত্যাশিত – একটি সরিয়ে পরের লেয়ারে যেতে ঠিক কোন ইনস্ট্রুমেন্ট কেমন করে ব্যবহৃত হয় – সেও নিখুঁতভাবে ধরেছেন তিনি। প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি, প্রথম অঙ্গ প্রতিস্থাপন, প্রথম জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট – ছবিতে পর্যায়ক্রমে ধরেছেন তিনি। একইসাথে ডাক্তার এবং বড় শিল্পী, এই দুর্লভ যোগাযোগ একমাত্র নেটারের ক্ষেত্রেই ঘটতে পেরেছে।
মানবদেহের জটিলতার ছবি আঁকতে চেয়েছেন অনেকেই – অসামান্য কাজ করেছেন ভেসালিয়াস, দ্য ভিঞ্চি, তারপর উইলিয়াম হান্টার বা গ্রেজ অ্যানাটমির হেনরি গ্রে। নেটার বলতেন, এঁদের সকলের কাজের গুরুত্ব অপরিসীম – কেননা, মানবদেহের অ্যানাটমি তো একযুগ থেকে অন্যযুগে বদলে যায় না – কিন্তু, বারবার নতুন ছবি জরুরী, কেননা অ্যানাটমি না বদলালেও, বদলে যায় সেবিষয়ে আমাদের ধ্যানধারণা, বদলে যায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা। হ্যাঁ, ঠিক সেকারণেই ফ্র্যাঙ্ক নেটার আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতম ইলাস্ট্রেটর – শিল্পী।
তবু, বিতর্ক কি নেই? আছে নিশ্চিত। আজীবন ওষুধ কোম্পানির সাথে হাত মিলিয়ে ছবি আঁকলেন তিনি – যে ছবি বিনামূল্যে বিতরিত হল বিশ্বের সর্বত্র – বিনামূল্যে হলেও, মূল্য তো আদায় হলই, কিন্তু কোন পথে? নেটারের ছবির হাত ধরে সিবা-গাইগি ঢুকে পড়ল ডাক্তারের চেম্বারে – সেখান থেকে হয়ত মেডিক্যাল প্রশিক্ষণের মাঝেও – বেড়া যে লঙ্ঘিত হলনা, সে নিশ্চয়তা দেবে কে? এসব বিতর্ক অন্য প্রসঙ্গ।
সে তো আরো বড় বিতর্ক রয়েছে গতশতকের আরেক অসামান্য অ্যানাটমির অ্যাটলাস ঘিরেও। কিন্তু, আজ থাক, সে গল্প পরে আরেকদিন।
ডক্টরস’ ডায়ালগ কত নতুন তথ্য পরিবেশন করছে আমাদের সামনে। চিকিৎসার সঙ্গে সম্পর্কিত অজানা দিগন্তছোঁয়া মানুষ। আশ্চর্য যাপন। আজকের এই লেখাটি তেমনই কিছু!
Oshadharon….. opurbo…… tothyo somridhha lekhar jonnyo dhonnyobad……?
Dr Basu অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এমন সুন্দর লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
Chamatkrita holam…The great netar aomporke ektu janlam
Beautiful
Ki darun likhechen dada, gray er first edition niye tar illustration er mughdhota mone pore gelo……
এ এক অসাধারণ লেখা।
Like!! I blog quite often and I genuinely thank you for your information. The article has truly peaked my interest.
A big thank you for your article.
Thanks for fantastic info I was looking for this info for my mission.